মূ ল্যা য় ন
কবি গোবিন্দ ধর  
সাহিত্যাঙ্গনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
রনি অধিকারী


কবি গোবিন্দ ধর কবিতায় ও সাহিত্যাঙ্গনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। উত্তরাধুনিক শক্তিমান এক অগ্রসর কবির নাম। কবির জন্ম  ৩০ শে জুলাই,  ১৯৭১। জন্মস্থান  অফিসটিলা ধর্মনগর উত্তর ত্রিপুরা। পেশা  শিক্ষকতা। শিল্প-সাহিত্য ও সাস্কৃতি অঙ্গনে তিনি একজন আলোচিত মুখ। তিনি একজন সফল সংগঠক ও প্রতিষ্ঠাতা। তিনি প্রায় ত্রিশটি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত। গোবিন্দ ধর শুধু কবি নন। তিনি প্রবন্ধকার, গবেষক, শিশুসাহিত্যিক অন্যদিকে তিনি সংকলক ও সম্পাদকও বটে। বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশ, সম্পাদনায় তিনি সিদ্ধহস্ত। দেশ-বিদেশে তার পুরস্কার ও সম্মাননার কথা আজ নাইবা বললাম। আজ শুধু তার কবিতা নিয়ে দুটো কথা বলার সময় এসেছে।  
কবি গোবিন্দ ধর -এর কবিতায় ভিন্ন ভিন্ন স্বাদে, পাঠক হারিয়ে যাবেন অন্য এক মনোজগতে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তি জীবনের সহজ-সরল কথায় তুলে ধরেছেন তার কবিতা। তার কবিতায় পাঠক খুঁজে পাবেন- অবহেলিত প্রান্তিক জীবনের পল্লীবালা। এছাড়া সমাজ সংস্কার, সংগ্রাম, প্রেম-বিরহ, মৃত্যুচিন্তা ও আশা-প্রত্যাশার টানাপোড়েন। কবিতাপাঠ-

‘দূরে কোথাও ক্রমশ ফিকে হয়ে যাওয়া বিশ্বাস 
ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়ার পর চাঁদ
আমরা এখনো তোমাকেই সঠিক দিশারি মানি।
তুমি পলাশরাঙা স্বপ্ন ফেরি করেছিলে কাঁঠাল ত্রিপুরায়।
তুমি মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে তুলে ছিলে 
ঘরে ঘরে জুঁই ফুলের মতো থালায় সাদা ভাত ফুটুক।
কাঁঠালবিজি আর বন আলু ছিলো পূর্ব পুরুষের 
ক্ষুধা মেটানোর সম্বল।
সেখান থেকে আমাদের গর্বের স্মার্ট সিটি।
তুমিই রূপকার। 
তুমিই শৈল্পিক কলমে এঁকেছো
লংতরাই আমার ঘর। 
আমাদের ঘর হাপনরাজার সবুজ।’
(তোমাকে)

স্মৃতি সব সময়ই মূল্যবান। তার কবিতাটি পড়ে এটুকু বোঝা যায়- স্মৃতি হচ্ছে এমন এক ছাঁকনি, যার মাধ্যমে আমরা জীবনটাকে একেবারে নিংড়ে গভীরে গিয়ে দেখতে পারি। উপলব্ধি করি, এই অনুভব থেকেই কবি হয়তো স্মৃতির দিকে ধাবিত হন। একজন কবি একটা আখ্যানকে স্মৃতি-কল্পনা আর বাস্তবতার ছাঁচে ফেলে নতুনভাবে নির্মাণ করেন, যা পাঠকের কাছে হয়ে ওঠে আরও রহস্যময়।
কবিতা যেহেতু একটা শিল্প এবং অন্য সব শিল্পের মতোই সৃষ্টি, একজন পাঠক জেনে-বুঝেই সেই বানানো চালচিত্রে ঢুকে পড়েন। ফলে কাছের বা দূরের ঘটমান অথবা ঘটে যাওয়া নানা বিষয়-আশয় নিয়ে একেবারে যেন সত্যি সত্যি মনে হয়। কবিতাপাঠ :
‘মৃত্যুর নিকট থেকে ফিরে এলাম।
অথচ কেউ জানতেও চাইলো না।
মৃত্যুর রঙ কেমন
মৃত্যুর হাত পা হৃদযন্ত্র আছে কিনা
কেউ একজনও জানতে চাইলো না 
মৃত্যুর সময় কেমন অনুভব হয়
অথচ সূর্যের সব থেকে নিকটতম গ্রহে
আমার কোনো মিত্র নেই 
আমার কেউ নেই
সকল সুখী মানুষ নিরুত্তাপ উদাসীন নিষ্ঠুর,
কালঘুম ঘুমায়।
অথচ মৃত্যুর নিকট থেকে ফিরে আসার রঙ ঘ্রাণ 
তোতো না মিঠে কিংবা আরো কোনোরকম
কেউ জানতে চায়নি কেমন আছি শূন্য দশমিক এক মিনিট।’
(শূন্য দশমিক এক মিনিট)

মৃত্যুচিন্তা কবিকে ভাবায়। নির্লিপ্ত আর কিছুটা একরোখা মানুষের জটিল মনস্তত্ত্ব, সামাজিক অসংগতি আর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে কটাক্ষ করে গল্প বলে গেলেও  কবি গোবিন্দ ধর -এর কবিতার ভেতরে পাঠককে ঢোকাতে থাকেন সুকৌশলে, এমনকি তিনি পাঠককে দম নেওয়ার জন্য কবিতার ফাঁকে অনেকটা ‘স্পেস’ দেন, তাই কবিতা অনায়াসেই তিনি লিখে ফেলেন এমন বাক্য- 

‘...বিপন্ন মানুষের যন্ত্রণাগুলো বুকে লুকিয়ে রেখে/ দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিই। বেঁচে থাকা গোপনশিল্প/ বয়ন করি। ছিঁড়ে ফেলার সকল হাতছানি থেকে 
দূরে রাখি আমার অবয়ব।...’ (প্রতিদিনের কবিতা) 

‘প্রতিদিনের কবিতা’ -এর মাধ্যমে কবি কিন্তু পাঠককে তার লেখার সঙ্গে একাত্ম করে তুলছেন আর পাঠক নিজের অজান্তেই কবিতার জটিল সব মোড়ে ঢুকে পড়েন ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছেন কবিতার-আখ্যানের সঙ্গে। কবিতাপাঠ :
‘সন্ধ্যায় এক নীরবতা নেমে আসে সারা পাহাড় জুড়ে 
না পাহাড় কেবল নয় পর্বতেও,শহরেও। 
নিস্তব্ধতায় আদিম মায়া নামে সময় স্বরণী বেয়ে
ঘোর লাগে। কোথাও আলো নেই। দাবানল নেই। 
দিনেও নীলগিরি পর্বতে বাঘ হরিণ ভাল্লুক
নিজস্ব স্বাধীনতায় অভয়ারণ্য আমাজনে ঘুরে।
সন্ধ্যার মায়াবী অন্ধকার আরো গাঢ়তর হয়ে
চারদিক নিস্তব্ধ এখন দিকচক্রবালের কোথাও 
একটুও আলো নেই। পশুরা স্বাধীন। 
মায়া মোহনীয় নিকষ অন্ধকার সৌন্দর্যের বিস্তার 
সভ্যতা এখানে এসে থমকে দাঁড়ায়
জঙ্গলের আদিম সংগীত বাজে, লাভডুব লাভডুব।’ 
(নীলগিরি পর্বতে এক সন্ধ্যা)
‘নীলগিরি পর্বতে এক সন্ধ্যা’কবিতাটি পড়তে পড়তে আবিষ্কার করি-  কবিতায় গল্প বলার কায়দা ও ঢঙ। খুব জটিল কোনো বিষয়কে কবিতাগুলো গল্পের ছকে বেঁধে ফেলা যায়। আর এসব কবিতা আদলে পাঠককে স্বস্তি দেওয়ার জন্য লেখা নয়, পাঠকের বরফজমাট ভাবনায় চির ধরাতেই যেন কবি একেকটি গল্প ফেঁদেছেন। কবি গোবিন্দ ধর -এর কবিতায় অনেক রহস্য থাকে। কী সব রহস্য মূলত এমন প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজে পাওয়া যাবে তার কবিতার ভেতরেই। 




রনি অধিকারী 
কবি, সাংবাদিক 
সম্পাদক  অনুভূতি
ঢাকা, বাংলাদেশ

0 Comments