গোবিন্দ ধর, যেটুকু জানি
শশাঙ্কশেখর পাল

ইতিমধ্যে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পনের। গোবিন্দ ধরের অক্ষরকর্মী হিসাবে এই সতত চলমান অবস্থান যে কোনো লেখকের কাছে ঈর্ষণীয়। তিনি গদ্য লেখেন, সে ভাষা সুষম ও সাবলীল। প্রকাশিত হয়েছে দুটি অণু গল্প গ্রন্থ ও একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ যা আমরা সবাই জানি। কিন্তু সব ছাপিয়ে আমার নজর তার বারোটি কাব্যগ্রন্থের প্রতি। সৌভিক পণ্ডিত সংকলিত ও সম্পাদনায় ক্রিয়েটিভ আর্ট এন্ড ক্রাফট সেন্টার, কুমারঘাট, ঊনকোটি থেকে প্রকাশিত কবি গোবিন্দ ধর: নিষ্ঠ আলোকপাত গ্রন্থে ত্রিপুরা সরকারে পুরস্কার প্রাপ্ত কবি তার অনুজ কবি সম্পর্কে যখন বলেন আমরা এঁড়িয়ে যেতে পারিনা, ‘…কবি গোবিন্দ ধরের কবিসত্তার, কর্মপ্রণতার একটা আস্থাঠিকানা পাওয়া যায়। কবি তাঁর যাপনে কবিতাকে যেমন লালন করেন, তেমনি কবিতাপ্রবণ বিচ্ছিন্ন আত্মাসমূহকে সংগঠিত করার ‘দ্রোহবীজ’ পোষণ করেন স্বীয় হৃদয়ের গ্রীণহাউসে’। আমাদের এর পর আর কী বলার থাকে! এক নির্ভেজাল কবি সত্বা সব আড়াল ভেঙে আমদের হৃদয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। 

একটি কবিতা হোক নগ্ন সময়কে কাপড় পরিয়ে দিই।
একটি কবিতা হোক সময়ের কথা বলবে। 

‘ইরিধান’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া প্রথম কবিতার এই লাইন দুটো কবি কবিতা সম্পর্কীয় একটি ধারণা স্পষ্ট করেছেন। কবি, কবিতা ও সমাজকে নিয়ে মেলবন্ধনের বার্তা আমদের প্রকৃত কবিতার কাছে পৌঁছে দেয়। এ পর্যন্ত তার সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘বর্গছকের বাইরের কবিতা’। তা থেকে কয়েটি লাইন—
 
কিছুই চিরন্তন নয় কিছুই সত্য নয়।
শীতের অতিথি পাখিটিও ফিরে যায় নিজ দেশ সাইবেরিয়া।
আমিও কী ফিরে যাব না?’  

বহু শ্রুত এই দার্শনিক ইমেজ তার বলার গুণে বুক শূণ্য হয়ে যায় নাকি? আমার আপনার, সকলের বুকে বয় শুষ্ক বাতাস। একটি সত্যের কাছে পৌঁছে যাই। হিংসা, দ্বেষ, ব্যক্তি স্বার্থ নিয়ে সমস্ত বাগারম্বড় থেকে নিষ্পৃহ নৈতিক ভারসাম্য সমাজের কথা বলে। ঋদ্ধ হই।

গোবিন্দবাবুর সাথে প্রথম দেখা হয় আমার জলপাইগুড়ি শহরে। তিনি আমার কর্মস্থলে এসেছিলেন হঠাৎ। সাথে ছিলেন অশোকানন্দ রায়বর্ধনসহ কয়েকজন।  এরপর দেখা ত্রিপুরা সরকারি বইমেলায়। রাখাল মজুমদার ও মন্টু দাসের আগ্রহে মঞ্চে কবিতা পাঠ করার সুযোগ পেয়েছিলাম এই জানুয়ারীর বইমেলায়। তারপর আনেকবার দেখা হয়েছে। তার আন্তরিক আমন্ত্রণে কুটুমবাড়ি, কুমারঘাট, সস্ত্রীক গিয়েছিলাম। উপহার পেয়েছি একব্যাগ ভর্তী বই। মন ভরে গিয়েছিল আথিতিয়তায়। ‘মনসুন মাছি’—  একটি কাব্যগ্রন্থের ব্যতিক্রমী নাম। সেই ব্যাগে ছিল। ‘দ্রোহবীজ পুঁতে রাখি’ একটি পাঠক প্রিয় কাব্যগ্রন্থ। আত্মমগ্ন চেতনায় যাপিত ধারাপাত। মিলনকান্তি দত্ত এ গ্রন্থ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কবি পীযূষ রাউতের চমৎকার উদ্ধৃতি তুলে এনেছেন, ‘আপন অন্তরের একনিষ্ঠ খননকর্মী’। সম্প্রতি ফেসবুকের ওয়ালে(৩০-৬-২৫)  গোবিন্দ ধরের ‘স্ক্যান্ডেল’ কবিতাটি পাঠের সুযোগ হয়েছে।
 
আমি বেকুবের মতো বিশ্বাস করি
আমি আবার বিশ্বাস করি
কারণ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেনঃ বিশ্বাস হারানো পাপ! 

কবির সংস্কার মুক্ত এ চেতনা পাঠককে কী প্রভাবিত করে না?  ছায়া ও আলোর ভেতরে ঘুরে বেড়ান কবি। কবির এই সংস্কার মুক্ত চেতনা পাঠকের চেতনাকে প্রভাবিত করে না কি? এতদসত্বেও ‘মনসুন মাছি’ আমার ভালোলাগার কবিতাগুলোর মধ্যে খুব প্রিয়। 

৫। উড়তে উড়তে মাছিরা
      আকাশে ওড়ে
      আকাশের নীলিমা-- তারা জানে না।

৭। মাছিরা পাখি নয়
     পাখিরা মছি নয়
     মাছিরা পাখি পাখিরা মাছি

বিদ্যুতের মতো কানে কিযে বলে যায়! ভাবতে বসে মন। এলোমেলো করে দাও বসে মজা লুটি, একি মানব চরিত্রের ধারাবহিক গ্রাফচিত্র? ঘন ঘন চরিত্র বদলের ফ্লাস লাইট। সমগ্র গ্রন্থটি একনিমিষে পড়ে ফেলা যায়।

তার প্রকাশনা সংস্থা ‘স্রোত’ নিয়ে গণ্যমান্য ব্যক্তিরা অনেক সদার্থক কথা বলেছেন। প্রকৃত পক্ষে ‘স্রোত’ ত্রিপুরার প্রকাশনা জগতের একটি মাইল ফলক। গোবিন্দ ধরের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে অনেক সংকলন, গবেষণামূলক বই। বিভিন্ন তথ্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে ‘জোনাকি’ ত্রিপুরার প্রথম কবিতাপত্র সম্পর্কে। এ ছাড়াও ছিলেন বলিষ্ঠ উপদেষ্টামণ্ডলী। ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য এটি কবি গোবিন্দ ধর ও ‘স্রোত’ প্রকাশনার পক্ষে অতিব গুরুত্বপুর্ন কাজ।

0 Comments