ডেমছড়া ধরে আমরা হাঁটতে হাঁটতে গন্তব্য অনাআবিস্কৃত ঝর্ণায় || গোবিন্দ ধর
ডেমছড়া ধরে আমরা হাঁটতে হাঁটতে গন্তব্য অনাআবিস্কৃত ঝর্ণায়
গোবিন্দ ধর
★নান্দীপাঠ
লংতরাইভ্যালী মহকুমার মনু ব্লকের অন্তর্ভুক্ত ডেমছড়া।ধলাই জেলার পশ্চিম উত্তর অংশে ডেমছড়া অবস্থিত। ডেমছড়ার একটি অঞ্চলের নাম বৃক্ষরাম পাড়া।এখান থেকেই গত ২৫ আগষ্টের এক সকালে আমরা বেরিয়েছিলাম অনাবিস্কৃত ডেমছড়ার উৎসের ঝর্ণা দেখবো বলে।স্থানীয়রা ছড়াটির নাম দু'পাট্টা বলেন।
★অনাবিস্কৃত ডেমছড়ার উৎস দু'পাট্টা ছড়া
লংতরাই পাহাড়ের খাড়াই চড়াই বেয়ে দীর্ঘ বিশ কিমি ছড়া ধরে হাঁটতে হাঁটতে যে ঝর্ণা তা ডেমছড়ার উৎস।
আমরা এই প্রথমবার এই ঝর্ণা আমরা আবিস্কার করলাম।স্থানীয় রিয়াং জনজাতিরা দুপাট্টা ছড়া বলেন।ছড়াটার উৎসে দুদিক থেকে দুটি ছড়া এসে ডেমছড়ায় মিশছে।
★ডেমছড়ার পথ পরিক্রমণ
ডেমছড়া ধরে হাঁটতে হাঁটতে গন্তব্য বলতে প্রায় বিশ কিমি দূরে এক অনাআবিস্কৃত ঝর্ণায় পাথরের উপর বসলাম আমরা নয় জন।আমাদের বৃক্ষরাম ডিপি এস বি স্কুলের সহকর্মী পাঁচ জন।ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রাজু দাস,পান্ডব দেববর্মা, পতিরাম রিয়াং,ভুলুকুমার দেববর্মা এবং আমি।স্থানীয় জনজাতির দুজন সজমি রিয়াং ও স্কুল কমিটির সদস্য শুভরাম রিয়াং এবং রাজুবাবুর বোন জামাই জুটন দেব। আর আমার প্রিয় বন্ধু কবি ও কথাসাহিত্যিক হারাধন বৈরাগী। দীর্ঘ দিন থেকে এরকম এক আড্ডায় যাকে চেয়েছি বহুবার।তিনি কাঞ্চনপুর থেকে সকালে আমাদের আড্ডায় আসলেন।
★হারাধন বৈরাগী
হারাধন বৈরাগী পেশায় শিক্ষক। কবিতা,গল্প ও গদ্যে সাবলীল বিচরণ। 'হাসমতি ত্রিপুরা', 'হৃদি চম্প্রেঙ', 'খুমপুই পাড়ায়'(কাব্যগ্রন্থ)। 'খুমপুই থেকে সিকামনুকতাই'-ত্রিপুরার জনজাতি জীবনের আদি হৃদিমালা;একটি ব্যতিক্রমী গদ্যগ্রন্থ।।'বুরাসা'(গল্পগ্রন্থ),'সমকালীন ত্রিপুরার পনেরোজন কবির কবিতা (যৌথসংকলন),'ব্যাটিং জোন'(অখণ্ড বাংলার নির্বাচিত অণুগল্প সংখ্যা/ যৌথসংকলন ),'নীহারিকা নির্বাচিত ত্রিপুরার তরুণ কবিদের কবিতা'(যৌথসংকলন)।'৫৪জন গল্পকারের ২১৬টি অণুগল্প' (যৌথসংকলন)।'ত্রিপুরার সাহিত্যে নদ-নদী ও গোবিন্দ ধর'(যন্ত্রস্থ),ছায়াতরু(ত্রিপুরার সাম্প্রতিক ছোটগল্প/যৌথসংকলন),'তবু ভালোবেসে যাবো'(একটি প্রেমের গল্প সংকলন /যৌথ)।নিয়মিত লিখে চলেছেন এপার ওপারের সমসাময়িক বিবিধ পত্রসাহিত্য ও লিটলম্যাগাজিনে। অসম্ভব জঙ্গলআউলিয়া।ভালোবাসা জঙ্গল,জনজাতি,জুমজীবন-জীবননিকষ।
★জার্নি টু গন্তব্য
তারপর আমরা ধীরে ধীরে গন্তব্যে হাটঁতে হাটঁতে বের হই।
বেলা তখন এগারটা অতিক্রম করেছে। সকালেও কেউ খাইনি।রান্নার আয়োজন করতে শুরু করলাম সকলেই।ভাত বসলো বাঁশের চোঙে। ভাত রান্না শেষ।প্রকৃতি দেখছি আর দেখছি চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। লংতরাই পাহাড়ের জনজীবনের নানা প্রাকৃতিক দৃশ্যে মোহিত।ঝর্ণার জলে বারবার চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। কেউ স্নান সারলাম।কেউ কেউ তো লতা বেঁয়ে উপরে উঠলাম।নামলাম।আবার উঠলাম।খাওয়ার আয়োজনের পাশাপাশি প্রকৃতির অপার বিস্ময় এই অঞ্চলে না এলে ইহ জীবনেও দেখার সুযোগ হতোনা।
এবার ভাতের থালায় কিছু তো চাই। পাহাড়ে সহজ উপায়ে রান্না করতে গোদকের জুড়ি মেলা ভার।যদিও পর্ক,চিকেন ছিলো।তবুও আজকের মেনু গোদক।
★গোদক
গোদক তৈরীর জন্য নানা রকম উপাদান ব্যবহার করতে পারেন।এখানে আমরা চিংড়ি মাছ,কাঁকড়া, লাঠিমাছ,পেঁয়াজ,জুমের খেত থেকে পুক মরিচ সংগ্রহ করে আনলাম।এগুলো প্রকৃতি থেকে আমরা সংগ্রহ করেছি
তাই এতে মিশানো হলো রসুন,নুন,কলাগাছের কচি অংশ, সিঁদল একটি মৃত্তিঙ্গাবাঁশের লম্বা আঁখ ওয়ালা অংশে প্রথম সব পদ ঢুকিয়ে দিয়েছি।তারপর উপরের ফাঁকা অংশ বন্ধ করে দিয়ে আগুনে হালকা আঁচে বসিয়েছি। একটু সময় বাঁশে আগুনের আঁচ লাগানো হয়ে গেলে বাঁশ একটু কালো কালো আকার ধারণ করতেই বুঝতে হবে গোদক রেডি।আগুন থেকে বাঁশ সরিয়ে নিন।তারপর কলা পাতায় সবগুলো ঢেলে নিন।
★সুঘ্রাণ ম ম
সুঘ্রাণ ম ম করবে।জুমের খেতের চাল আগে থেকেই ভাত রান্না ছিলো।পরিমান মতো নিন।খেতে শুরু করুন। জিবে রসনায় তৃপ্তির জল আসবে নিশ্চিত। যারা পাশে থাকবে তাদের জিবেও জল টলটল করবে।খিদে না পেলেও চেটেপুটে খাবার ইচ্ছে নিশ্চিত হবেই হবে।জুমের পুক মরিচ ঝালের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।আর তাতে রসনায়ও জল লকলক করে।মনে হবে আপনি অপার আনন্দসাম্রাজ্যে বসবাস করছেন।
★লক্ষরাম রিয়াং
জুমের ধান নিয়ে আসছেন রিয়াং পুরুষ। ক্লান্তি নেই শুধু বিজয়ের হাসি।এই পরিশ্রমী মানুষটির নাম লক্ষরাম রিয়াং।জুমে এখন ধান পাকার সময়।লক্ষরাম এরকমই দিনে কয়েকবার ডপমছড়ার জলপথে পায়ে হেঁটে ধান বয়ে আনেন বৃক্ষরাম পাড়ায়।পিচ্ছিল খাড়াই চড়াই এবং অসংখ্য পাথর বয়ে আনা ডেমছড়ার ছড়াজলের আঁকাবাঁকা পথ ধরে নিজেদের পাট্টা পাওয়া বনাঞ্চলের জুম খেত থেকে ফসল ঘরে আনতে হয় লক্ষরাম রিয়াংদের।
★জাপানজয় রিয়াং ও তাঁর কেটলি
একটি কেটলি। এটা কোন নির্বাচনী প্রতীক নয়।কিন্তু কেটলিটা বহুদিন ধরে জাপানজয় রিয়াংকে তাঁর পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে আসছে।
জাপনজয় রিয়াং বিগত সরকারের এডিসি প্রশাসনের একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি।
পরিবারের লোকসংখ্যা চারজন।দুই ছেলে। স্ত্রী পুত্র মিলে চারজন মিলে জাপনজয়ের সংসার।দুই ছেলেই বিয়ে থা করে পৃথকভাবে পাশ্ববর্তী ডেমছড়ায় থাকেন।তাঁর স্ত্রী বৃক্ষরাম সিপি এস বি স্কুলের কুক কাম হেল্পার।
জীবন যুদ্ধে জাপনজয় এখন নিয়ম করে ডেমছড়া বাজারে চা-বিক্রেতা।
আমি ডেমছড়া ভিলেজের বৃক্ষরাম সিপি এস বি স্কুলে জয়েনের পর থেকেই তিনি আমার বন্ধু।
কতদিন ডেমছড়া তাঁর বাসায় আড্ডায় সময় কাটিয়েছি।থেকে যেতে বলেছেন।এমন কি স্কুলেও তাঁর বাসা থেকে যাতায়াত করার জন্য বলে থাকেন।আমার সে সুযোগ হয়নি।আমিও মাঝ বয়সের সংসার নৌকায় অথৈজলে থৈ থৈ।
সে আর হলো কই।তাই প্রতিদিন নিয়ম করে ৫০ কিমি যাই।৫০ কিমি আসি।এরকমই আমারও জীবন।
একজন শিক্ষককেও এমন পরিস্থিতিতে জীবনকে চালাতে হয় জাপনজয়ের মতোই। তিনি যদিও জীবনের যুদ্ধে স্বাধীন। আমরা শিক্ষকরা পরাধীন।
আমি যে স্কুলে কর্মরত সেই অঞ্চল রিয়াং জনজাতি অংশের জনবসতি। স্কুলের শিক্ষার্থীরা রিয়াং ভাষায় কথা বলে।আমি বাংলা। এতে ওদের প্রকৃতপক্ষে যতটুকু দান করা প্রয়োজন আমার ততটুকু দিতে হলে ভাষাশিক্ষা প্রয়োজন। যা প্রায় অসম্ভব। অথচ আমাদের দপ্তরের আদেশ পাবলিক ইন্টারেস্টে আমিও জয়েন করতে হলো স্কুলে।কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কে সেই পাবলিক যার ইন্টারেস্ট আমাকেও রিয়াং অধ্যাষিত স্কুলে বাংলা ভাষা যার মাতৃভাষা তাকেই প্রয়োজন হলো।অথচ রিয়াং জনজাতির সেই ডেমছড়ার শূন্য থেকে প্রায় ১২-১৪ বছরের শিশুরা বাংলা ভাষা বলতে ও বুঝতে একদমই অপারগ। আমিও এই দুঃসাধ্য সাধন এ জীবনে অসম্ভব। সুতরাং যাই।আসি।আবার যাই।আবার আসি।আত্মগ্লানি প্রতিদিন চোখে মুখে জুমের বাঁশ পোড়া ছাইয়ের মতোই লেগে থাকে।
লেগে থাকে জাপনজয় রিয়াং এর কেটলির মতো।
★সৌন্দর্যের নিকট আদিমানব
এই অনাআবিস্কৃত ঝর্ণা একদিন হতে পারে পর্যটকদের নিকট সৌন্দর্য অবলোকনের ইলিপেন্টপলস।আর লংতরাই জুড়ে পাথরের প্রকৃত ম্যাচুরিটি যখন আসবে তখন ত্রিপুরা হতে পারে অর্থনৈতিক ভাবে এক সমৃদ্ধ রাজ্য।আমাদের পাথর পররাষ্ট্রের রপ্তানি হতে পারবে বিশ্বাস করি। এত পাথর। বড় ছোট মাঝারি। যে দিকে চোখ যায় পাথর আর পাথর।মনে হয় এখানেই থেকে যাই এক গুহামানবের মতো।
২৬:০৮:২০২২
0 Comments