গোবিন্দ’ নামটি এতটা গুরুত্ব কেনো?
আলমগীর মাসুদ
তর্ক থাকাটা ভালো। তর্ক আর বিতর্কের মধ্য দিয়েই কিন্তু সৃষ্টিশীলরা অনেকবেশি সমৃদ্ধিলাভ—অনেকবেশি খ্যাতিলাভ করেন। গোবিন্দ ধর বাংলা সাহিত্য তথা ত্রিপুরা সাহিত্যের একজন স্বতন্ত্র পুরুষ এ-কথা বলতে কোনো সন্দেহ নেই। জোরদিয়ে বলা যায়, তাঁর সব কাজই নিজস্ব এবং পাঠকের জন্য আলাদা পাঠ্যরস। তাঁর নিজস্ব রঙের ধরন রয়েছে অনেক বৈচিত্র। কবিতা আবিষ্কারে তাঁকে খানিকটা পাঠকপ্রিয়তা করে তুললেও, ব্যক্তি গোবিন্দ ধর এককথায় তাঁর যাপিত জীবনের সুখদুখ আর হাসি কান্নার মাঝে রাজ্য জয় করে অলরেডি বসে আছেন। অবশ্য পৃথিবীর সকল শ্রেণির মানুষ নিজ নিজ ভাষায় আত্মজীবনী লেখা দরকার। আত্মজীবনী হচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম একটি গ্রন্থ। যেখানে মানুষ ও সমাজ, রাষ্ট্র, পৃথিবী আর নানা বৈচিত্রতায় ফুটে ওঠে সে গ্রন্থ। যা পরবর্তীতে সেসব জীবনী আমাদের জন্য অনেকবেশি অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। কবি গোবিন্দ ধরকে নিয়ে লেখা আমার পক্ষে কতটুকু সম্ভব জানি না। কারণ আমি যতটুকু জানি, গোবিন্দ ধর শুধু এ’কে সীমাবদ্ধ নয়, তিনি বহুজনে বহুমাত্রায় ছিটিয়ে যাওয়া একজন শক্তিশালী পুরুষ বটে। পৃথিবীর এহেন কোনো মানুষ নেই যে, যাদের নিয়ে দু-চারটি বিতর্ক নেই। দু-চারটি প্রশংসা নেই। হা, বিতর্ক-সুনাম দুটোই আছে। বির্তক আছে এবং প্রত্যেকটি মানুষের জন্য বিতর্ক থাকা জরুরি বলে মনে করি। কারণ এই বিতর্কের মধ্য দিয়েই কিন্তু একজন মানুষ সত্যিকারের শুদ্ধ মানুষে রূপান্তরিত হয়। এখন যদি বলি, কবি গোবিন্দ ধরকে নিয়ে বিতর্ক হয়নি? হ্যাঁ হয়েছে। প্রশংসা হয়নি? হ্যাঁ তাও বেশ হয়েছে। এখানো হয়ত হচ্ছে। হয়ত আরো হবে। এই হওয়াটা দিনদিন হয়ত আরো বাড়তে থাকবে। আর এই হওয়ার মাধ্যমে কবি ও সম্পাদক গোবিন্দ ধর আরো শক্তির জায়গায় দাঁড়াতে সক্ষম হবেন। অতএব একজন সৃষ্টিশীলকে নিয়ে যতবেশি সমালোচনা প্রশংসা আর তর্ক হবে, ঠিক ততটাই মঙ্গল আর সমৃদ্ধি লাভ করবে সে সৃষ্টিশীল মানুষটি।
     সম্ভবত বাংলা সাহিত্যেই একটি বেদনার নাম ‘লেখক সমাজ’। কবি গোবিন্দ ধর যখন বলেন, ‘পথ চলতে অনেকের সঙ্গ পাওয়া যায়। আবার অনেকেই সঙ্গ ছেড়ে চলে যায়। কোনো কিছুই কারো জন্য থেমে থাকে না। সব কিছু কী দুরন্ত গতিতে চলছে। এই গতির কাছে আমরা খড়। যে কোনো সময় মহকালেই হারিয়ে যাবার কথা। সুতরাং যারা সঙ্গে নেই আপনাদের জন্য আক্ষেপ শুধু। যারা আছেন আপনাদের সহযোগিতা আমাদের সম্পদ। সাথে আছেন তাই প্রেরণা পাই। বিনিময়ে কিছুই দিতে পারলাম না এই অক্ষমতা আমার। আপনাদের মহানুভাবতার কাছে নিজেকে খুব খাটোই লাগেছে তবু সাথে আছেন এই প্রাপ্তি ভুলবার নয়।’
     গোবিন্দ ধরের এ-কথা তাঁর নিজের হলেও, এখানে অবশ্যই জোর দিয়ে বলবো কথাটা কবির একার নয়। কবি’র এই কথা গোটা পৃথিবীর সকল মানুষের। হ্যাঁ এটা বলা যায়, পৃথিবীর সব মানুষ গোবিন্দ ধরের মতো এই প্রকাশটা এভাবে করেনি। হয়ত কেউ কেউ করেছে তার নিজের ভাষায়। কিন্তু একজন গোবিন্দ ধর সবার পক্ষ নিয়ে সবার কথাটি তাঁর কণ্ঠে অথবা কলমে জানান দিতে পেরেছেন বলে, এখানেই লেখক গোবিন্দ ধর বড়ো হয়ে উঠেন। কবি নিজে এও বলেছেন— ‘সব শাখা ভেঙে গেলে গাছ আর বৃক্ষ থাকে না/ যেন আমাজন পুড়ে পুড়ে জ্বালানী কাঠ/ আমি এই সময়ের কালিদাস নিজের মৃত্যু লিখি-নিজেরই কুঠার দিয়ে/ ডালে ডালে ফুল খুঁজি/ ডালে ডালে শাখায় শাখায় বিশ্রাম খুঁজি/ হরিৎ শস্যদানা ঠোঁটে চেপে পাখি ও পাখি/ এসো হাঁয়ের ভেতর দাও সবুজ লতাপাতা/ অথচ সকল গাছই বৃক্ষ হওয়ার আগে কেমন/ আমাজনে দাউ দাউ জ্বলে উঠে কাঠ।’
     এখানে একটা কথা বলে রাখি, মানুষ কিন্তু বরাবরই নিজ কৌশলটা খোঁজে নেয় সবার আগে। আর কৌশলগতভাবে কাজ করে প্রশংসা কুড়াতেও অনেকে অপেক্ষা করে। কিন্তু এখানে বলতে পারি, আমার নিজের মধ্যে নিজের বলা ভাষাটা কারো কাছ থেকে শিখা হয় নি আমার। কারণ আমার দুর্বলতা বলি আর ছোট্ট পথের ছোট্ট নাবিক বলি না কেনো, কবিকে নিয়ে এই লেখা লিখতে হবে বলে যে লিখছি এমন নয়। সৃজনশীলতার অপেক্ষায় আমরা সকলেই কিন্তু দৌড়ের পথেই দাঁড়িয়ে থাকি। আমি সবসময় ভেবেছি আমার ঘুমঘরে। আমি কল্পনা করেছি স্বপ্নের মধ্যে হেঁটে হেঁটে। আর আমার স্বার্থহীন বিরোধিতা লেখককে পাঠ করতে গিয়ে। অর্থাৎ একজন গোবিন্দ ধর যে সর্বদিক স্বতন্ত্রতা বহন করেন এতে কোনো সেন্দহ নেই। বরং আমি বিশ্বাস করি তাঁকে, বিশ্বাস করি তাঁর সকাল বিকাল দৌড়ানোকে। যেমন এখানে উপেক্ষা নয়, রাস্তায় কারো গা ঘেঁষে হাঁটার চেয়ে প্রধান সড়কে আস্তে আস্তে হাঁটা অনেক ভালো। এতে নিজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে সহজে পৌঁছানো যায়। আমি মনে করি, কবি গোবিন্দ ধর সেসব আর্বজনায় ঘেঁষাঘেঁষি না করে নিজের আবিষ্কৃত পথে নিজেকে দাঁড় করাতে পেরেছেন। এই জন্য দূর থেকে তাঁকে আমার ছোট্ট স্যালুট।

দুই.
কবিতার বাইরেও কবি’র যে আলাদা একটা প্রতিবাদের স্বর আছে তা হয়ত আমরা অনেকই জানি না। যেমন তিনি বলেন— ‘যানবাহনের গতিপয় চালক এখন রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু করতে গিয়ে আমাদের সমাজের ভিতকেই নড়বড়ে করে দিচ্ছেন। এই গতিপয় যানচালকের দৌরাত্মে শিক্ষার্থী নির্ভয়ে বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। অসুস্থ রোগীকে আগে যেতে না দিয়ে নিজের যানকে স্বর্গের রথ ভেবে উড়িয়ে পার হন পথ। এমন ঘটনা কারণে আমাদের সামনে পথ দুর্ঘটনায় বাড়বাড়ন্ত। এই অবস্থার পরিবর্তন অচিরেই প্রয়োজন। অন্যথায় অঘটন ঘটছে ঘটবে। আমরা তো তিমির বিলাসী নয়। তিমির বিনাসী হতে চাই।’
     এই যে কবির কণ্ঠে বেদনার বার্তা, এই বার্তা তো আমাদেরকেই লজ্জা দেয়। মানুষ সবকিছু সহজে নিতে চায় না। না, চায় না বললে ভুল হবে। বরং নিতে জানে না। আমরা একটু ইমোশনাল। আমারা একটু আবেগী। এই জাতীয় শব্দগুলো বাঙালির লেজের সঙ্গে বেধে দিলেও—একমাত্র বাঙালিই হচ্ছে হীনমন্যতায় ভরা অন্য জাতীদের চেয়ে আলাদা এক রূহ খবিশ জাতি। যেখানে আলোচনা বা সমালোচনা নয়—কুৎসাটাই বেশি উঠে আসে সবার মনে, মুখে, মস্তিষ্কে! যা আমাদের জন্য বরাবরই লজ্জাজনক এবং লজ্জাজনক। একইসঙ্গে দুঃখজনকও। দুঃখজনক বলবো এই জন্য, আমরা বরবরই কর্ম আর ব্যক্তি মানুষটাকে এক করে ফেলি! আমরা আমাদের জ্ঞানকেই মূল্যায়ন করতে পারি না। আমরা আমাদের সম্পদকে ভর্তা বানিয়ে বাসি করে জলভাত খাই। অতঃপর সে ভাত খেয়ে পেট বড়ো করে রাস্তায় একা একা হাঁটা ছাড়া নতুন কিছু দেখি না। নতুন কিছু শিখিতেও চাই না। জানি না—জানার চেষ্টাটাও করি না। কারণ ওই বাসি জলভাত দ্বারা আমরা হেঙ্ক হয়ে পরি দ্রুত।

তিন.
ত্রিপুরার যে ক’জন লেখককে আমি পাঠ করেছি, যেকজন ব্যক্তিসত্ত্বাকে আবিষ্কার করেছি—করছি, তাঁদের মধ্যে কবি ও সম্পাদক শ্রী গোবিন্দ ধর সম্পূর্ণ আলাদা একজন ব্যক্তি পুরুষ। শুরু এবং প্রথম কল্পনা থেকে আমি তাঁর মুগ্ধ একজন পাঠক ছিলাম। আর দেখার পর একজন গোবিন্দ ধর কেমন বৃক্ষ—সেটাই মর্মে মর্মে উপলক্ষ করেছি। ভারত বর্ষের ত্রিপুরা রাজ্যে বসবাস করা একজন গোবিন্দ ধরকে যে আমি আবিষ্কার করতে পেরেছি, এটাই আমার কাছে বিশ্বময় একটি বার্তা হয়ে ধরা দিয়েছে। তাঁর কথা ও কবিতা, তাঁর কণ্ঠ ও ভাষা যেমন একদিকে গণনা করা যায়, একইভাবে ব্যক্তি গোবিন্দ ধরকেও গল্পের বারান্দায়ও আঁকা যায় না। তাঁকে আঁকতে হবে আরো কোনো বড়ো জমিনে। গোবিন্দ ধর সে বড়ো জমিনে নিজেকে তুলে ধরার সে যোগ্যতা তৈরি করেছেন।
     সমুদ্রেকে পিছনে ফেলে আসলেও আমরা সমুদ্রজলকে ঠিক কাছে কাছেই রাখতে চাই। ত্রিপুরা রাজ্যের এক অজপাড়াগাঁয়ের গোবিন্দ ধর অলরেডি ইতিমধ্যে পাঠকের দুয়ারে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন। কম নয়, কম বললে ভুলও হবে আমাদের। তাঁর ধ্যান জ্ঞান তাঁর জীবনে যা-ই লিখেছেন সব নিজ ভাবনা আর সুচিন্তিতার মাঝে তিনি ত্রিপুরার সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণ করেছেন—এখনো করছেন সম্রাট বেশে। তাই এভাবেই বলতে হয়, আহা এই যেনো এক অন্য গোবিন্দ ধর। যিনি একাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বৃদ্ধ অলসতাকে যৌবনে টেনে নেন। তাই তো বলি, আমাদের কাছে ‘গোবিন্দ’ নামটি এতটা গুরুত্ব কেনো? গুরুত্ব এই জন্য, গোবিন্দ ধর তাঁর সকল কৌশল আর শব্দের সন্ধান করতে ও করার জন্যে দেশের এহেন কোনো জায়গা নেই যে—তিনি ঘোরেন নি বা পা রাখেন নি। একইসঙ্গে একই উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামও নিজের নামের সঙ্গে দারুণভাবে মিশে রাখার ক্ষমতা রাখেন। আর এই রাখাটা সবাইকে ধরা দেয় না। দেয় না বলেই একজন গোবিন্দ ধরকে গুরুত্ব মনে করে—আমরা তাকাই আর চারদিক খুঁজি জীবন যৌবনের স্বাদ। দেহে দেহে কাপন ধরার শিহরণ গ্রহণ করি—আজ বাংলা তথা ত্রিপুরার সাহিত্যঘরে বৃদ্ধ হয়েও তিনি বসে নেই, বরং তরুণবেশে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন পজিটিভভাবে। একা থাকার মাঝে যেনো সাবাইকে নিয়ে ঘোরেন-আবার সবার মাঝেই বসবাস করেন। পুরনো বলি অথবা নতুন—আমাদের সত্য রসবোধের তৃপ্তিতে বলতে হয়, শ্রী গোবিন্দ ধর সকল শাখায় তাঁর শক্তিমত্তার সাক্ষর রেখে তিনি আজ দারুণ পরিচিত। অতঃপর কামনা, একজন ‘গোবিন্দ ধর’ থাকুক আমাদের মস্তিষ্কে জিইয়ে হাজার বছর।

২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯
alamgirmasud11@gmail.com

শব্দসংখ্যা—১২১০

0 Comments