দ্রোহবীজ একা পুঁতে রাখার পর কবি যখন লেখেন দ্রোহবীজ:হারাধন বৈরাগী 


(১) দ্রোহবীজ পুঁতে রাখি একা

“দ্রোহবীজ পুঁতে রাখি একা”

তরুণ কবি গোবিন্দ ধরের আত্মখননের তর্জনী নির্দেশিত একটি কাব্যগ্রন্থ।ও‌ই কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করলে মনে হবে কবি তার শরীরে জড়িয়ে আছেন দ্রোহের নামাবলী ।আর ক্রমাগত জপ করে চলেছেন দ্রোহমালা।

গোবিন্দ ধর শুধু কবি নন, একাধারে স্রোত প্রকাশনা, বিবিধ সাময়িকী সম্পাদনা,তিনভুবনে  লিটল ম্যাগ আন্দোলন সহ বিচিত্রবিধ সাহিত্যবিষয়ক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত অতি জীবিত এক দ্রোহবাউল।কৈশোর থেকে‌ই  যাপনের খানাখন্দে বারবার ভূপাতিত হচ্ছেন।আর এই থেকে সৃষ্টি হচ্ছে ভেতরে অসংখ্য দ্রোহবীজ।আর এগুলো যেন নীলকন্ঠের মতো ধারণ করে কলুষমুক্ত করে চলেছেন জলজভেলা।এ তাঁর কাব্যগ্রন্থে স্বখোদিত ভাস্কর্যের মতো প্রস্ফুটিত।এই কাব্যগ্রন্থ পাঠের সাথে সাথে পাঠক তার স্বখননের সলিলে ডুবে যান নিজের অজান্তে‌ই ।এই কাব্যগ্রন্থে কবি যেন এক সুদক্ষ শৈল্যবিদের মতো নিজের জীবনকে নিজেই কাঁটাছেড়া করতে করতে বিশুদ্ধ উচ্চারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন জীবনবেদ।আর পাঠক সেই বেদবীজে খুঁজে পাচ্ছেন যেন নিজেরই দ্রোহবীজ।

এখানে কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক।
যেমন- “এতদিন পথকে /মুক্তির পথ ভেবে /হোঁচট আর খাবি খেতে খেতে/পায়ের নখ সব উল্টে গেছে।/সে’ক্ষত শুকিয়ে যাবার আগে পুন:ভব,/হোঁচটগুলির হজম প্রক্রিয়া/শেষ হতে না হতেই আবার/পথের এত কাঁটা /চক্র, চক্রব্যুহ, খানাখন্দ/ —মানুষ পার হতে পারে না/
”(পর্যবেক্ষণ) ।কবির কথাগুলো যত সহজ মনে হয়,আসলে তত সহজ নয়।আসলে মানুষ পার হয় খানাখন্দ ঠিকই কিন্তু ফের সেই আবর্তে‌ই পড়ে।তাই পথ পার হতে পারে না মানুষ।

কবি পথের নিছক অন্ধ ভক্ত নন।তবে পথকে বিশ্বাস করেন।বিশ্বাস করে মুক্তির আশায় জীবন নিংড়ে দিয়েছেন। কিন্তু ক্রমাগত আঘাতের পর আঘাত। পোড় খেতে খেতে পথের যাপন পর্যবেক্ষণ শেষে জীবন ছুয়ে দধীচির মতো ধারণ করেছেন নিজের বুকে দ্রোহবীজ।ধারণ কি এত সহজ,যা যে কোন সময় বিস্ফারিত হতে পারে।

আরও কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

”পথের এত ভাষা, পরিভাষা,উপভাষা/”(হৃদিকথা -১)

"পা ভুল না পথ ভুল/ এই চক্রে ঘুরপাক খায়/একটি লাটিম/(দর্শন)। তখন কবিকে আর চিনতে অসুবিধা হয় না।

”আমার নিজস্ব পথ গড়তে/পথে হাঁটি-/পথ বদলাই অন্যপথে হাঁটি।/বারবার বদলে ফেলি পরিচিতি” (নিজস্বপথ)

শুরুতে কবির পথের যে বিশ্বাস ছিল একসময় সেই বিশ্বাসে হোঁচট খায়। তিনি বলেন,-”বাম পথে যাবো,/ডানপথে যাবো-এই করে করে/আমার আলোর স্পষ্টতা নিয়ে দ্বন্দ্ব বাড়ে/”(ও চাঁদ,অধরা)

“অবলম্বন আর নেই, শুধু‌ই খাঁচা/খাঁচার দিকে /এগিয়ে গেলে খোঁয়াড়ে প্রবেশ/এই স্বৈরিণীমুখ।–”(অন্য নির্জণতা)

এই বিদীর্ণ উচ্চরণ থেকে কবি হৃদয়ের নিখাদ ভালোবাসা‌ই প্রকাশ পেয়েছে।কবির পথ শুধু নিখাদ নিজের জন্য নয়,মানুষকে মানুষের পথের নিশানার দিকে ইঙ্গিত করেন তিনি।এখানে কবি পথের থেকে মানুষের উপর‌ই আস্থা রেখেছেন বেশী। কেননা পথের মারপ্যাঁচে কবি বিদীর্ণ হয়ে চলেছেন। বিদীর্ণ হতে হতে অবশেষে পথসিদ্ধি লাভ করেন ।আর পথের লাটিম কবির, পথ অতিক্রম করতে না পেরে হয় আত্মপোলদ্ধি। আর নিজের দ্রোহ নিজেই শীতল করেন নিজের হৃদয় জলে।।নিজের মাঝেই স্বখোদিত সলীল আধারে।কবি বলেন,-”হদয়ে অনেকজল অনেক সমুদ্র/নিজেই নিজের জলে সাঁতার কাটি/নিজের উষ্ণতা করি শীতল।”(জলপদ্য)এ যেন বাউল কবির ভবসাগর থেকে মুক্তির জন্য দেহসাধনার নামান্তর। দেহের মাঝে‌ই যেন জীবনভেদী পথ বাউলের আরশিনগর।

কবির জীবদর্শণ  পাঠকের বুকে ঝার্ক সৃষ্টি করে ।যখন কবি বলেন-
          “ শরীর তৃপ্তি হোটেল নয়----/”(মেঘ নয় বর্ষা নয় একটু জল)

“বারবার পুড়তে হয় মাটি/বদলে নিতে হয় জমি/তবেই চাষ হয় জুম/”(জুম)

“টপকাতে চেয়েছি বারবার/—-----আল টপকাতে পারিনি বলে আমি জমিন”(আইল)

বলেন-”সর্বংসহা এই মাটি/---মাটিতেই বীজ জাগে/মাটিতেই বেড়ে ওঠে/—-মাটিতেই খাবি আর হোঁচট/মাটিতেই আমিত্ব শেষ”(মাটি)

“ভেতরে ভেতরে বাস্তুসাপ, কামড়ায় /মন,মেধা ও সংস্কৃতি “(বাস্তুসাপ)


               কিন্তু এরপর ও আলোর পিয়াসী কবির আবাহন—”শুভরেখা তুমি আলোতে থেকো”(অন্ধকার রাত্রি)।

”ভেতরে ভেতরে নিক্কণের শব্দ বাজে/বাইরে আমি একা/সমস্ত দ্রোহবীজ পুঁতে রাখি একা, একা।”এ যেন কবির শ্মশানউচ্চার ,যা পাঠকের শ্বাসকে ধ্যানস্থ করে। 
(দ্রোহবীজ পুঁতে রাখি একা)।


(২)লিখি দ্রোহবীজ 


দ্রোহবীজ পুঁতে রেখে এবার অনেক পথ এগিয়ে এসেছেন কবি।আরো রুধীর ঝড়েছে বুক থেকে। এখনো ঝরে চলেছে।গোবিন্দ হয়ে উঠেছেন তার্মপ্রবাহ ।আর হৃদসলিল থেকে গজিয়ে উঠেছে তার পুঁতে রাখা দ্রোহবীজগুলি।আর যা অবয়ব ধারণ করেছে তার নুতন আরেকটি কাব্যগ্রন্থ-”লিখি,দ্রোহবীজ”নামে।কবির দ্রোহের শেষ নেই।একের পর এক দ্রোহ।দ্রোহ  তার কবিতার ফ্যাসন।যেন তিনি নিজেই দ্রোহবীজ। আপাদমস্তক বাংলাকবি গোবিন্দ,কবিতা যার শ্বাস ও আশ,জীবন যাপন আশা হতাশা গোরস্থান। এই গ্রন্থে বীজগুলি চিহ্নিত করলেন কবি একে একে। অর্থাৎ প্রথম কাব্যগ্রন্থ “দ্রোহবীজ পুঁতে রাখি একা”তে কবি দ্রোহের যে বীজ পুঁতে রেখেছিলেন।এ কাব্যগ্রন্থে সেই বীজগুলি চিনিয়ে দিলেন পাঠককে।

যেমন,কবি যখন বলেন,-
"লিখি নিজেকেই।লিখি ক্ষরণ।লিখি দহন–
লিখি দ্রোহ।লিখি স্বপ্ন।—------লিখি কৃষি।
লিখি অহংকার।লিখি আনন্দ।লিখি একাকিত্ব।
লিখি অপরাধ। অপমান।লিখি বাতাসে উড়ে যাওয়া বসন্ত দিন। অবহেলা লিখি।আর লিখি ভালোবাসা কতটুকু মিথ্যা হলে অপত্যস্নেহ ভুলে যায় সময়।"(লিখি,দ্রোহবীজ)
শেষ কথাকলি নাড়িয়ে যায় পাঠকের লোমকূপ‌ অবধি!

সুদীর্ঘ যাপনে কবি ,কবিতার ঘর ও ঘরানা নিয়ে তার উপলব্ধি পাঠকের কাছে কাঁঠালখোয়ার মতো খুলে খুলে তুলে ধরেন। কবিতার সাথে নিরবিচ্ছিন্ন সুদীর্ঘ যাপন‌ই কবিকে পরিপক্ক উচ্চারণে বিদীর্ণ করেছে।তাই তিনি দিতে পারেন  পাঠককে ,নবপ্রজন্মকে, সতর্কতার দিশা।

আর অবলীলায় বলতে পারেন ,-
"তাকেই কবি বলি যার কবিতা একটি খাপছাড়া তরোয়াল।"(কবি)

কিংবা

“এ সময় চাইছে আত্ম উপাখ্যান। মুখাপেক্ষী নয়।বরং লিখে নিন আত্মার নিজস্ব পতাকা।/
—----------------------/লিখতে হবে আত্মার খুন দিয়ে।/”—----/
"কোথাও কি তরুণেরা থেমে গেছে?নাকি তরুণদের ঘুমের ট্যাবলেট কেউ রাতের ভাতে গোপনে মিশিয়ে দেয়?"/—------/
লিখে নাও নিজস্ব ভূগোল।(কবির ভূখণ্ড কবির কবিতা।)

কবিতার সাথে যাপন করতে গিয়ে কবি ও কবিতা যখন ফাল হয়ে ওঠে। আঘাতে আঘাতে রুধিরাক্ত করে কবিকেই।কবি দধিচীর মতো বলেন,-"কাজ বলতে সকলের ব্যাথাবেদনাগুলো আমার আমার‌ই লাগে।আর সকলের অপরাধে আমার মনেও লেখালেখিরোগ কেবল‌ই অসুখ আঁকে।"(লেখালেখি অসুখ)

কবি যেন এক জুমিয়া বরক।যার লেখালেখি আত্মকেন্দ্রিক হয় না। তিনি একটি পতাকা উড়িয়ে চলেন।আর নতুনদের হাতছানি দেন।আর এই পতাকার পালে ছুটে চলে নুতন ও তরুণ অনুজ কবির দল।আবার কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে অনেকেই পিছু পা হয়ে যায়।মুখ ফিরিয়ে চলেও আসে। কিন্তু তাতে তার যায় আসে না ।কবির পতাকা উড়তেই থাকে।এ যেন ট্রাফিক জ্যামের চিত্রকলা।ঢেউ আর ঢেউ। ঢেউ এ ঢেউ এ গাড়ি চলে ।মাঝে ফাঁক গলে পথিকের চলা।কিন্ত কবির পতাকার পত পত উড্ডয়নে ফাঁক ফোকর জুড়ে যায়। তিনি বলেন,-

"অনুজদের ভালোবাসি/ভালোবেসে কাছে ডাকি।/
পাশে রাখি। হাঁটব পথ।/সামান্য চেনা শেষে—--/
পথ বাতলে দিতে দিতে বেপথু/তরুণদের গড্ডালিকায় হেঁটে গেল/ম্রিয়মান মেটোপথ।/

কয়েকজন অগ্রজকে সড়ক দুর্ঘটনা থেকে/পথ চেনাতে চেয়েছি।অর্ধেক পথ হেঁটে‌ই/নমস্য শৈল্যবিদ মনে করতে করতে/তারাও চৈত্রপল্লব।/

খড়কুটো ধরে হাঁটতে হাঁটতে দীর্ঘ জার্নি আমার।/
হারাবার বা জেতার কিছু‌ই নেই।/------------------------বারবার শূন্য থেকে শুরু করে শূন্য‌ই আঁকি।"/(অনুজ অগ্রজের ক্রসিং লেভেল)

"না লিখে কি করতাম—-/কিছুতো করতাম‌ই,হয়তো/আবোলতাবোল বকতাম—সিস্টেমের বিরুদ্ধে?/না হয় তাস পিটতাম। নয়তো/চাস্টলে বকাটে বেচারার মতো/
সারাক্ষণ কারোর পিণ্ডি চটকাতাম।"/(লিখি– না লিখে উপায় নেই)

"নিজের ফোঁসফাস দীর্ঘশ্বাস/ছোবলের পর ঘুরে দাঁড়াব/লিখি ভাঙচুরের পর—-দাহপ্রদাহ।"(লিখি,কেন লিখি)

চলার পথে যখন একা হয়ে যান।কবি তার অনুভব লেখেন,-"বৃষ্টি নেই।খা খা শিমুল বসন্তকাল।/
দুঃখজল গ্লাসে ঢেলে নিজেকেই করি/
পান।"(লিখি)।এ যেন ফের সেই আত্মমদিরায় ডুব দিয়ে পান করেন নিজের‌ই গড়ান।যেমন,

"রক্তাক্ত হৃদয়ের লাভডুব বেড়ে গেলে/কবিকে শান্ত রাখতে কবি‌ই গ্লাসে ঢেলে দেন/নিজের মদ।"(লিখি, একাকিত্ব)।

সুদীর্ঘ যাপনে কবিতাসরোবরের কবি ও কবিতা কাঁটার দংশনে কবি নীলকন্ঠ হয়ে উঠেছেন।কবি ও কবিতা মাঝেমধ্যে বোমেরাং হয়ে ওঠে।তাই তিনি বলতে পারেন,-নেশাগ্রস্থের মতো

নিজস্ব ভূখণ্ড আঁকি।/---------------------
"নিজস্ব পুরুষের নিকট যেভাবে বিপ্রতীপ বিশ্ব/এসে হাল ভেঙে পড়ে–সেভাবেই আঁকি/
সাদা পাতায় নিজস্ব ভূখণ্ড।/"(লিখি ভূখণ্ড)

"তুমি যত‌ই লুকিয়ে রাখ মুখ/মুখমন্ডল জুড়ে লেখা থাকে কুশল ও কৌশল।/এই পাঠ শিখে গেছি বিগত শতকেই।/ছলনা ও ছোবল থেকে ভালোবাসা চিনে নিতে/কোন পরিশ্রম দরকার নেই।"(পাঠ)

"আঁকতে চাই মানুষ।/চোখমুখ অবিকল বসাই।/তবুও অবিকল/মানুষ আকঁতে পারিনি।"(চিত্রকলা)

পরিশেষে কবির আর্তি পাঠকের হৃদয় নাড়িয়ে যায় কবির আলোক চুম্বনে।কবির ভালোবাসার চাঁদ ছুঁয়ে।যার কেন্দ্র মানুষ‌ই।আঘাতে আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হলেও মানুষের জন্য‌ই তার জয়গান।যখন তিনি বলেন,

"একটি জরুরি পতাকা আমি চেয়েছিলাম।যার গরিমায় আকাশ আলোকিত হবে।-----------
পতাকা শুধু ভালোবাসা ফেরি করে যাবে।"(জরুরি পতাকা)

পরিশেষে বলবো, ২৪ টি কবিতার নাগামরিচ দেড় ফর্মার কাব্যগ্রন্থটি দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ করেছেন কবি অরুণ কুমার দত্ত ।কবির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করি।কবি হয়ে উঠোন খাপখুলা তলোয়ার!

0 Comments