আনোয়াছড়া:আনোয়ারা একটি মেয়ে গোবিন্দ ধর
আনোয়াছড়া:আনোয়ারা একটি মেয়ে
গোবিন্দ ধর
গঙ্গানগরের পশ্চিম থেকে ছোট ছোট টিলা পাহাড় থেকে বৃষ্টির জল নেমে বিস্তৃর্ণ অঞ্চলের ক্ষেত মাড়িয়ে মনু নদীতে মিশে গেছে আনোয়াছড়া। আনোয়াছড়া মূলত জমির উপর দিয়ে প্রবাহিত বৃষ্টিপাতের জলধারা।দীর্ঘ সময় জল নামার তরঙ্গে একটি সুরু রেখায় থইথই প্রবাহকেই আসলে কালের স্রোতে লোকমুখে প্রচলিত হয় আনোয়াছড়া।
জনশ্রুতি অনুসারে বর্ষায় জলের প্রবল জমির উপর দিয়ে প্রবাহিত খরস্রোতা হয়ে ওঠে। রাতাছড়া গ্রামের লোকজন মূলত কৃষিজীবী। জমিন তাদের নিকট সম্পদ।জলের প্রবাহ নামতে নামতে একটি টিলায় এসে বাঁধা পায়।সেখানে রাতাছড়ার কৃষিজীবী মানুষের শ্রমের মাধ্যমে আনোয়াছড়াকে গতি দেওয়া হয়।
এই জলধারা আনোয়াছড়া নাম করণের রহস্য উদঘাটন করতে গ্রামের বয়স্কদের সাথে আলাপ আলোচনা করে জানতে পারি এক সময় মুসলিমরা আরো রক্ষণশীল ছিলেন।তাদের কারো পরিবারের একটি মেয়ে একজন হিন্দু সম্প্রদায়ের কাউকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু মুসলিম পরিবার ও গ্রামের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা এই ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। মেয়েটির নাম আনোয়ারা বেগম।সে ছিলো অপরূপ সুন্দরী। টান টান হরিণাক্ষী।মিশুকে ছিলো মেয়েটি।অনেক আগে সমাজ ব্যবস্থায় এখনের মতো ততো মেলামেশা সম্পর্ক ছিলো।তখনকার সময় এই ভালোবাসা মেনে নেওয়ার মতো সমাজের রক্ষণশীলতাকে ডিঙিয়ে আনোয়ারা নামের মেয়েটির ভালোবাসাও স্বীকৃতি পায়নি।অথচ আনোয়ারা নাছোড়বান্দা। সমাজ যখন এই ভালোবাসার কোন স্বীকৃতি দিতে নারাজ তখন মেয়েটির কাছে আত্মহত্যাই একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায়।
এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় মেয়ে রাতাছড়া ডিঙিয়ে প্রবাহিত জলের তোড়ে নিজেকে সমর্পণ করে বসে।সেই থেকে এই অঞ্চলের এই সুরু প্রবাহকে লোকজনের নিকট আনোয়াছড়া নামেই পরিচিতি পায়।
এই আনোয়ারা নামের মেয়েটি নিয়ে আমার এক গুচ্ছ ভাবনা অনেকটা কবিতার মতো করে আমি আনোয়ারা নামের মেয়েটি নামে একটি কাব্য সংকলন প্রকাশ করেছি।এখানে সেগুলো তুলে দিলাম।
মেয়েটি বিষাদ বালিকা, তার ওষ্ঠে যে তিল তাতেই লেখা আছে মৃত্যুবাণ।
এক.
আমি যে গ্রামে বড় হয়েছি নাম তার রাতাছড়া। আমাদের বাড়ির চারিদিকেই সামনা। বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে সূর্য যে দিকে উঠে সেদিকে মুখ করে দাঁড়ালে বাম হাতে পড়ে করমছড়া কৈলাসহর রোড। এই রোডের ডানদিকে আমাদের ছোটবেলার ছবিগ্রাম রাতাছড়া।
দুই.
গ্রামের একটি ছড়া আছে। তাহার নাম রাতাছড়া। আমার পাঠশালা স্কুলের পাশ ঘেসে ছড়াটি চিকচিক বালুস্রোত বয়ে মনুর সাথে সঙ্গমে আসে।
তিন.
রাতাছড়ার ককবরক নাম রাতাছড়া। রাতা মানে ককবরকে পুরুষ মোরগ। রাজমালায় রাঝধর ছড়া কালক্রমে রাজধরছড়া- ক্রমে ক্রমে রাতাছড়া।
চার
রাজমালায় বলা আছে রাজধরের অভিষেক হয় মনুনদী নিকট রাতাছড়ায়। তারপর আফিম সেবনে আত্মনিবেদন করেন তাঁর পিতা।তারপর থেকে রাজধর ছড়াই আজকের রাতাছড়া।
পাঁচ.
আমার বাড়ির বাঁদিক বরাবর একটি ছোট হাওর এক কিমি অব্দি যাওয়ার পর টিলা হয়ে আছে। এই হাওর ধরে চোখ মুদে হাঁটলেও যাওয়া যায় গঙ্গানগর।
ছয়.
হাওর থেকে অজগরের মতো নামছে একটি নালকাটা ছড়া তার নাম আনোয়াছড়া।
সাত,
আনুয়াছড়া নিয়ে জনশ্রুতি একটি প্রেমকাহিনী। একটি মেয়ের আত্মহত্যার গল্প একটি মেয়ের স্বপ্ন, বিকেলের আগেই কি রকম হেজেমজে গেলো একটি মেয়ের বুকের চারাগাছ অকালে মরে যাওয়া গল্প।
আট
বিকেল আসার আগেই তার মুখ থেকে সূর্য থেমে গেলো। রোদ ঝলমল মুখ থেকে ফেনিয়ে বেরিয়ে এলো পূরণ না হওয়া একটি ছোটগল্প যার নাম আনোয়াছড়া।
নায়
আনোয়ারা কেকাম একজন সংখ্যালঘু মেয়ে। প্রেমের সখ্যতা তার ছিলো ছড়াজলের সাথে।
দশ
আনোয়ারা বেগম ছড়াজলে পা ডুবিয়ে প্রিয়সখার বুকে মাথা রেখে একটু ঘুমাতে চেয়েছিলো। চারজন নিরক্ষর তর স্বপ্ন কেড়েনিলো জলের স্রোতের মতো মিশে গেলো জলে মেয়েটি। মেয়েটি জলে গুলে গেলো। অকালে মরে যাওয়া গল্প।
এগারো
ছোট ছোট টিলার জল লাফিয়ে লাফিয়ে সাগরের ঢেউ মতো। জলের স্রোত সব কেড়ে নেয়। মানুষের পুকুর ডুবুডুবু। হাওর জলে জলাকার জলকাতর মানুষেরা জলবন্দি জল নামছে জল নামছে জলের তোড়ে সব ভাসিয়ে নিলো। মেয়েটি আনোয়ারা নামের মেয়েটিও। দুই টিলার ফাঁক বরাবর নামছে দালান বাড়িঘর সব ভাসিয়ে জল নামছে।
বারো,
একজন সংখ্যালঘু মেয়ের নাম আনোয়ারা একজন মেয়ে মানুষের নাম আনোয়ারা একজন প্রেমিকার নাম আনুযায়ী একজন মানুষের নাম আনোয়ারা। একটি অপূর্ণতার নাম আনোয়ারা। একটি সবুজ ফুলের নাম আনোয়ারা। একটি ছড়াজলের নদীর নাম আনোয়ারা একটি জীবনের নামে আনোয়ারা আনোয়ারা আসলে একটি প্রতিবাদও।
তেরো,
কপট ভালোবাসার কাছে জীবন দিয়েছে আনোয়ারা বেগম?
নাকি সমাজ করেছে নিষিদ্ধ এই প্রেম লোকমুখে গালগল্প ফিসফাস তার প্রেম বুকে নিয়ে কলকল শিৎকারে জল যায় মনুর নিকট।
চৌদ্দ
নিজেকে লুকাতে দিয়ে মেয়েটি তার মেম কোমায় লুকালো। আনোয়ারা তো একটি মেয়ে শুধু নয় একটি সময় একটি সকাল। তার সূর্য তো দেতে না কখনো। সমাজ বদলের সলতে সে রোপন করেছিলো।
পনেরো,
ধীরে ধীরে মেয়েটি অভিমানে মিশে যায় ঘোলাজলে। দূরে বসে কেউ একজন পাঁজরের হাঁড়ের ভেতর কনকনে শীত টের পায়। মেয়েটির কোন রোগ ছিলো না। মেয়েটির ভালোবাসা ছিলো নিখাদ কেউ একজন কেড়ে নিলো মেয়েটির সকল পাখি।
ষোলো.
মেয়েটি পাখি ছিলো
মেয়েটি স্বপ্ন বুনতো আকাশের মতো
নানান রঙ্গের।
সব রঙ জলে মিশে জলাকার
মেয়েটি জলের মত
কলকল বয়ে যায় নদীর কাছে।
নদীও নারীর মতো
আনোয়ারা একটি ছোটনদী
ভিরতির প্রবাহিত।
সতেরো.
আনোয়ারা একটি নদী ও মেয়ে। তার শিৎকার শুনি মাঝরাতে। তিরতির তার কল্লোল বজ্র নির্ঘোষ।
আঠারো.
সব পথ নদীতে এসেই মিশে যায়। নদীই সাক্ষী থাকে প্রকৃত প্রেমের। আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টিজল বয়ে নিয়ে সাক্ষী রইলো আনোয়ারার লোকশ্রুতি।
২৩:০৩:২০২৪
0 Comments