নৃপেন্দ্রলাল দাশের কবিতায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধচিত্র  চাবাগানের সুভাষ  শ্রীহট্টীয়ঘ্রাণ আর স্বতন্ত্র স্বর

গোবিন্দ ধর

আমার সাথে পরিচয়

-----------------------------

কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশের সাথে আমার দুবার দেখা হয়েছে।দুবারই ত্রিপুরার কৈলাসহর।প্রথমবার "উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় সাহিত্য সম্মেলন :২০০৩"সালে।দ্বিয়ীয়বারও সম্ভবত ২০০৮ সালে মৈত্রীয় উৎসব,কৈলাসহরে।তাঁর কবিতার সাথে তখনই সখ্য হয়।

তারপর গত বছর, সৃষ্টিলোক"আয়োজিত, "ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী উৎসব:২০১৭"সালে কবি ও গীতিকার শামসুল আলম সেলিম,সিলেট থেকে উৎসবে অংশ নেন।তখন তিনি ভালোবেশে দুটো বই পাঠিয়েছিলেন।একটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকর বিষয়ক।অন্যটি রাধারমণ দত্তের গানের দেহতত্ত্ব মনস্তত্ত্ব বিষয়ক গবেষণা ধর্মী বই।

এবার সিলেটের কৃতীপুরুষ অপূর্ব শর্মা সম্পাদিত "কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশ" শিরোনামে একটি সম্মাননা গ্রন্থ প্রকাশ হবে।তাতে কবিতা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ করে দিলেন এই অধমকে।কিন্তু আমি সেরকম যোগ্য নয় তবুও বন্ধু অপূর্ব শর্মার আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারিনি।তাই এই অক্ষম চেষ্টাচরিত্র।

কবি পরিচয়

-----------------

কবি ও গবেষক অধ্যাপক নৃপেন্দ্রলাল দাশ ১৯৪৯ সালের ৬ নভেম্বর শ্রীমঙ্গল উপজেলার ২নং ভূনবীর ইউনিয়নের গন্ধর্বপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ দাশ এবং মায়ের নাম লাবণ্য দাশ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সসহ এম এ পাস করা নৃপেন্দ্রলাল দাশের এ পর্যন্ত ৮৮টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মূলত কবি হলেও সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায়ই রয়েছে তাঁর অবাধ বিচরণ। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ রম্যাণি-রুচিরা ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে অনীহার অন্ধকারে আমি (১৯৭২); বৈশালীর প্রতি সনেটগুচ্ছ (১৯৮২); দাঁড়াও দুঃখ (১৯৮৩); একফর্মা ইচ্ছাপত্র (১৯৯৮); রব্বানী, আমার নিজস্ব তর্জা (২০০৬); এই নশ্বরতা চাই (২০০৬); Ode to Robbani (২০০৬), ফেসবুকে আমার রুবাইগুলি (২০১২), কবিতা সমগ্র-১ (২০১৩)  বীরাঙ্গনা কথা (২০১৭)।

গবেষণা এবং প্রবন্ধ সাহিত্যেও তিনি সিদ্ধহস্ত। তাঁর উল্লেখযোগ্য গবেষণা ও প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, শ্রীভূমি সিলেটে রবীন্দ্রনাথ, সিলেটে নজরুল, বোবা বেহাগ, হাসনরাজা শব্দ নৈশব্দ, ভেঙে যাই তাবৎ ঘরানা, দেখা অদেখা, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, গদ্যসমগ্র-১ ইত্যাদি।

তিনটি নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস লিখেছেন তিনি। সেগুলো হচ্ছে, গার্গি, হাসনরাজা : রঙের বারই, হেমন্তবালার রবীন্দ্রনাথ। তাঁর একমাত্র ভ্রমণ কাহিনী বরাকবঙ্গে প্রব্রজ্যা বিপুল প্রশংসিত হয় পাঠক মহলে।

উল্লেখ্য, শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজে ১৯৭৫ সালে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা এই শিক্ষক নানা সরকারি কলেজে অধ্যাপনা শেষে ঝিনাইদহের কেশবচন্দ্র কলেজ থেকে ২০০৬ সালে প্রফেসর হিসেবে অবসরে যান। সব্যসাচী এই লেখক লেখালেখির স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কার। নৃপেন্দ্রলাল দাশের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে এ পর্যন্ত ৩টি সম্মাননা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে লন্ডনভিত্তিক টিভি চ্যানেল ‘আয়নাঘর’ নামে একটি তথ্য চিত্র নির্মাণ করেছে।

তাঁর কাব্য সংকলন

-------------------------

কবিতা আমার নিকট মেডিপিস।সমস্ত আনন্দে,বিষাদে,সৌন্দর্যে, শৌয্যে এবং প্রাণ খোলে হৃদয় নিংড়ানো যন্ত্রণার দশদিগন্ত উন্মোচনের খোলা মাঠ।

আমাদের আলোচ্য কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশের    সংকলনেও আমরা পেয়ে যাই এই সকল সংবেদ।

তাঁর উচ্চারণে শ্রীহট্টীয় মাটির ঘ্রাণ উঠে আসে।তিনি যেন কবিতায় দক্ষ সৈনিক।আর কলম হাতে একজন শিল্পী। কবিতায় তিনি সাবলীল আবার ঋজু।সহজসুন্দর তাঁর ভাষাশৈলী।

শ্রীহট্টীয় সরলতার পাশাপাশি তিনি জানেন এই সময়ের ভাষাবুনন।সময়ই উঠে আসে তাঁর উচ্চারণে।

তাঁকে নিয়ে কয়েকটি উচ্চারণ

----------------------------------------

আমি মুক্তিযোদ্ধা নই, 

কামরুলের শাপলার কারিগর নই, 

জাতীয় পতাকার লালবৃত্তে

রক্ত আমি ঢালিনি কখনো। 

হয়তো যাইনি যুদ্ধে আমি,

এস-এল-আর দেখিনি কখনো, 

কেবল আমার রক্তে ফুটে থাকে নির্বিরোধী

একগুচ্ছ রক্তিম রুবাই -

-----------------------------------------------------

ইতিহাস-ঐতিহ্য আর দেশমাতৃকা

কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশের কবিতার

অবয়ব জুড়ে।

কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশ

শব্দবোধ ও অভিনবত্বে

স্বতন্ত্র শব্দশাসক ও শব্দবিলাসি।

অন্তমিলহীন শব্দমালা নির্মাণে

নিজস্বতায়-নান্দনিকতায় গীতিনির্ভর।

শব্দ ও বাক্যের -

বুনন, বিন্যাস ও সমন্বয়ে সৃষ্ট

তাঁর সব সাহিত্যেকর্মই

শাশ্বত সুধারসে সাবলিল।

শক্তিশালী কবি ও ব্যতিক্রমী গদ্যশিল্পী

কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশ -

তাঁর মেধার মৌলিকতা বিষ্ময়কর।

" তুমি চলে গেছো আজ তিনটে তিরিশে -

  চায়ের পেয়ালা জুড়ে

  ঠোঁটের স্পষ্ট দাগ লেগে আছে  "

---------------------------------------------------

" বৈশালীর প্রতি সনেটগুচ্ছ " -

কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশ রচিত

ধ্রুপদরীতির গীতি কবিতা। 

যা সনেট / চতুর্দশপদী কবিতা 

হিসাবে বহুল পরিচিত।

সনেটের বৈশিষ্ট, গতিশীল শব্দ চয়ন,

স্বতন্ত্র শব্দবিন্যাসে রচিত

" বৈশালীর প্রতি সনেটগুচ্ছ " -

কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশের 

এক অনন্য - অনবদ্য সৃষ্টি ।

কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশের রয়েছে

একটি চিরায়ত  ক্লাসিকেল মনোভঙ্গি। 

তিনি যখন কবিতা লেখেন - 

তখন কবিতার কনসেপ্টকে 

সহজ-সৌন্দর্য মীমাংসার কাছে নিয়ে যান

সহজাত বিষয় বর্ণনে।
 

কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশ -

সমকালীনতাকে অস্বীকার করেন না।

ছন্দ আর আলংকারিক দৃষ্টিকে

প্রসারিত করেন সৃষ্ট শব্দমালায়।

কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশের

লেখায়-উপমায় প্রকৃতি লগ্নতা লক্ষনীয়।

শ্রীমঙ্গলের অসাধারন নিসর্গ নিয়ে তাঁর

বিন্যস্ত বর্ণমালা...

চা-পাতার আঁচলে ছড়ানো একটি আবাসস্হল, 

অনেক প্রাণের মমতা জড়ানো আমার শ্রীমঙ্গল।

সেই গ্রাম এখন শত্রুর দখলে -

আমার প্রিয়তম নিরাপদ আশ্রয়

আমার নিজের ঘর

এখন সবচেয়ে ভীতিজনক।

আমার জন্মভূমির বাতাস এখন বারুদে ভরা

আমার জন্মগ্রামের আকাশ

এখন জলপাই রঙের।

আমার গ্রামের মাটিতে এখন ঘৃণ্য বাঙ্কার

আমার গ্রামের মেয়েরা এখন

মৃত স্বামীর শিয়রে বসে থাকা বেহুলা।

------------------------------------------------------

কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশের কবিতায়

মহান মুক্তিযুদ্ধের বিবিধ চিত্র চিহ্নিত হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে তাঁর -  

একাত্তরের কাব্য, রক্তে আমার রুবাই, দুঃখের মাঝখানে আগুন,একফর্মা ইচ্ছাপত্র " -

প্রভৃতি কবিতাগুলো উল্লেখযোগ্য।

কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশের মতে -

সিলেটের কবিতা চায়ের লিকারের মতই লিরিক্যাল-প্রাণধর্মী। তিনি সিলেটের কবিদের কবিতা এক একর ফসলি প্রান্তরে রেখে যেতে চান , একজন নিস্ফলা মাঠের কৃষক হিসাবে। 

" সিলেটের কাব্যচর্চা

  উৎস থেকে নিরন্তর " - বইটি স্বল্প পরিসরে এ অঞ্চলের কাব্যচর্চার চিহ্নায়ন বা রেখায়ন।

পরিষদের পক্ষ থেকে বইটির প্রকাশক

@Gubinda Roy Sumon কে সতত সাধুবাদ।

তাঁর একটি কবিতা

----------------------------

মুকিত লস্করের জন্য

--------------------------

সাধুবাবার থলীর একটি বটের ডাল

নেমে এসে ছুঁয়েছে বুড়বুড়ির পানি -

যেখানে মিশেছে মুকিতের লাল রক্ত,

কালো ক্রোধ, সবুজ দ্রোহ,সোনালি স্বপ্ন

মুকিত লস্করের ডান হাত ছুঁয়েছে কেবল

কাকিয়াছড়ার তাবৎ আকাশ

আর অচেনা অর্কিডের মত এক ভালবাসা

যাকে আমি বলি

জন্মভূমি।

আজও দেখি ছয় ডিসেম্বরে বড়বেশি

দীর্ঘ ছায়া খেলে জাগছড়ার অপরুপ

চা-পাতার মাঝখানে,কফির বল্লরীতে,

বাইক্কা বিলের অতিথি পাখিরা বলে -

এই বিলের নাম হোক " মুকিত লস্কর "

স্বাধীনতা শব্দটি যে তারই নির্মাণ।

-------------------------------------------------

কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশ রচিত 

" মুকিত লস্করের জন্য " কবিতাটি

" মানচিত্র " স্মারকে ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়।

শেষকথা

-----------

কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশ সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তাঁর সৃজনী সাক্ষর রেখেছেন। 

তাঁর জীবন ও কর্ম বিষয়ক বই লিখেছেন রব্বানী চৌধুরী, ড. তপন বাগচী, গোবিন্দ রায় সুমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.সৌমিত্র শেখর, অধ্যাপক সুব্রতকুমার দাশ এবং আরো অনেকে ।

কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশ স্বতন্ত্র শব্দায়ন ও বাক্য বিন্যাসে পরিবেশন করেন সাহিত্যের শাশ্বত সুধারস ।

২৪:১০:২০১৮

রাত:১১:১০মি

কুমারঘাট।

0 Comments