গাজন উৎসব

চৈতন্য ফকির

কথাপৃষ্টা 
------------
ছোটবেলা থেকেই গাজনের নেশায় বুদ ছিলাম।এখনো পাশাপাশি গাজন উৎসব মেলা কিংবা চড়কমেলা হচ্ছে শুনলে এক বার দেখতে যাওয়ার সাধ কমেনি।

দেশে দেশে নানাভাবে 
-----------------------------
গাজন ভারতের ত্রিপুরা পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে পালিত একটি হিন্দু লোকউৎসব। এই উৎসব শিব, নীল, মনসা ও ধর্মঠাকুরের পূজাকেন্দ্রিক উৎসব। ত্রিপুরা গাজনকে চড়কপুজো বা চড়ক মেলা পশ্চিমবঙ্গের
মালদহে গাজনের নাম গম্ভীরা, জলপাইগুড়িতে গমীরা। বাংলা পঞ্জিকায় চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে সন্ন্যাসী বা ভক্তদের মাধ্যমে শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়। চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক পূজার সঙ্গে এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। ধর্মের গাজন সাধারণত বৈশাখ, জৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে পালিত হয়। চৈত্রমাস ছাড়া বছরের অন্যসময় শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হলে তাকে হুজুগে গাজন বলা হয়। গাজন সাধারণত তিনদিন ধরে চলে। এই উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল মেলা।যদিও এখন বোশেখ মাসেও গাজন হয়।

গাজন
---------
কৃচ্ছসাধন হলো গাজনের মূল লক্ষ্য।সন্ন্যাসী বা ভক্তরা নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রনা দিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ইষ্ট দেবতাকে সন্তোষ প্রদানের চেষ্টা করেন। গাজন উপলক্ষ্যে তারা শোভাযাত্রা সহকারে দেবতার মন্দিরে যান। শিবের গাজনে দু'জন সন্ন্যাসী শিব ও গৌরী সেজে এবং অন্যান্যরা নন্দী, ভৃঙ্গী, ভূতপ্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতির সং সেজে নৃত্য করতে থাকেন। শিবের নানা লৌকিক ছড়া আবৃত্তি ও গান করা হয়। চৈত্রসংক্রান্তির গাজনে কালী নাচ একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। ধর্মের গাজনের বিশেষ অঙ্গ হল নরমুণ্ড বা গলিত শব নিয়ে নৃত্য বা মড়াখেলা (কালিকা পাতারি নাচ)। জৈষ্ঠমাসে মনসার গাজনে মহিলা সন্ন্যাসী বা ভক্তরা অংশ নেন, তারা চড়কের সন্ন্যাসীদের মতোই অনুষ্ঠান পালন করে।ত্রিপুরায় যদিও মহিলাসন্ন্যাসীদের চড়ক পুজো হয় কোথাও শুনতে পাওয়া যায়নি।

নামকরণ
-------------
আভিধানিক অর্থে বাংলা গাজন শব্দটি গর্জন শব্দ থেকে ব্যুৎপন্ন হয়েছে। এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসীরা ও ভক্তরা প্রচণ্ড গর্জন করেন বলে উৎসবের এইরূপ নামকরণ হয়।অপর মতে, গা শব্দের অর্থ গ্রাম এবং জন শব্দের অর্থ জনসাধারণ; গ্রামীণ জনসাধারণের উৎসব হওয়ায় এই উৎসবের এই রূপ নামকরণ হয়।আবার কারো কারো মতে নিম্নবর্গীয়দের ধর্মীয় আচারও গাজন।

লোকশ্রুতি 
--------------
জনশ্রুতি আছে অনুযায়ী, গাজন উৎসবের দিনে দেবী হরকালীর সঙ্গে শিবের বিবাহ হয়। বিবাহ উৎসবে সন্ন্যাসীরা বরযাত্রী হিসেবে অংশ নেন। অন্যদিকে, ধর্মঠাকুরের গাজন হল ধর্মঠাকুর ও দেবী কামিনী-কামাখ্যার (বাঁকুড়া জেলা), দেবী মুক্তির বিবাহ উৎসব।

ইতিহাস 
----------
১৮৪৯ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত চড়ক উৎসবের চিত্র
রাঢ়বঙ্গের শৈব-সংস্কৃতির একটি বিশেষ অঙ্গ হচ্ছে ‘গাজন’। গাজন অর্থে (গাঁ= গ্রাম, জন= জনগণ) গ্রামের জনগণের নিজস্ব উৎসব। নবদ্বীপ মহিমার লেখক কান্তিচন্দ্র রাঢ়ি ‘গাজন’-কে ধর্মগাজনের অপভ্রংশ বলেছেন।

গাজন বিষয়ে ভারতকোষকার জানিয়েছেন, "বাংলাদেশের লৌ্কিক উৎসব। ইহা নিম্নশ্রেণির লোকের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। ...বাংলাদেশে ইহা নানা পৌ্রাণিক ও লৌ্কিক দেবতার নামের সহিত যুক্ত হইয়াছে, যেমন শিবের গাজন, ধর্মের গাজন, নীলের গাজন, আদ্যের গাজন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই উৎসবের লক্ষ্য সূর্য এবং তাহার পত্নী বলিয়া কল্পিত পৃথিবী। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর বিবাহ দেওয়াই এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য। চৈত্র মাস হইতে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচণ্ড অগ্নিময় রূপ ধারণ করে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও সুবৃষ্টির আশায় কৃষিজীবী সমাজ এই অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করিয়াছিল। গ্রাম্য শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করিয়া এই উৎসবের অনুষ্ঠান হয়।"

যে শিবকে সারা বছর আগলে রাখেন ব্রাহ্মণেরা, গাজনের কদিন সেই শিব সমাজের নিম্ন কোটির মানুষের হাতে পূজা গ্রহণ করেন। এখানে কোনও ভেদাভেদ নেই, জাত নেই, কুল নেই, উচ্চবর্ণের অবজ্ঞা অবহেলা নেই। এ কদিন সবাই সমান মর্যাদায় সমাসীন। এখানেই শৈব সংস্কৃতির সঠিক উত্তরণ। গাজনের সময় শিব প্রকৃত অর্থে গণদেবতা।গণদেবতাই সময়ের নিকট সব সময় পুজিত।প্রকৃত পক্ষে লোকশ্রুতিই সকল দেবদেবীর জন্মের মূল কারণ।লোকজ বিশ্বাস থেকেই কালের নিয়মে গাজনেরও ভিত তৈরী হয়ে গ্রামীণ জনগণের বিনোদনের এক বিশাল জায়গা দখল করেছে চড়ক বা গাজনও।

ছড়া গানে গাজন 
------------------------
ছড়া গানেও প্রবেশ করেছে শিবের গাজন।

‘আমরা দুটি ভাই 
শিবের গাজন গাই।
ঠাকমা গেছেন গয়া কাশী 
ডুগডুগি বাজাই।।’

ঋণ স্বীকার

(১)নানান প্রবন্ধ পাঠের ঋণ স্বীকার।
(২)জনশ্রুতি

0 Comments