অনামির_খেরোখাতা:স্রোত

মানবর্দ্ধন পাল

নিরন্তর চলমানতা, অবিরত প্রবহমানতাএবং বিরামহীন বয়ে চলার নাম স্রোত। স্রোতের গতি আছে, চঞ্চলতা আছে, ধাবমানতা আছে। বিরতিহীনভাবে ধেয়ে চলাই স্রোতের ধর্ম। স্রোতের গতি, প্রবহমানতা,  এগিয়ে চলা-- সবই জীবনের লক্ষণ। স্রোত জীবনের গতির প্রতীক। তাই তো কবিও বলেছেন : "যে নদী হারায়ে স্রোত,  চলিতে না পারে/ সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে/। যে-জাতি জীবনহারা অচল-অসার/ পদে-পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।"

জীবনের মহত্ত্ব ও সার্থকতা নির্ণয়ে দার্শনিক কবি-লেখকরা অনেকে জীবনকে বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ জীবনের উপমা খুঁজে পেয়েছেন নদীর কাছে। নদীর নাব্যতা আছে, আছে বহমানতা এবং স্রোত। এর সঙ্গে মিলে যায় জীবনের ধর্ম। গতি ও সেবাদানের মধ্য দিয়ে জীবন নদীর সঙ্গে  তুল্য। "জীবননদী" -- এই জমজ শব্দটি তাই রূপকার্থে ব্যবহৃত হয়। 

সাহিত্যও জীবনেরই শৈল্পিক প্রকাশ। জীবনের আয়না হলো সাহিত্য-- যাতে সুপ্ত মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে মানুষের, সমাজের, সভ্যতার দেশের ও দশের। আধুনিক কালে সাময়িকপত্র বা লিটলম্যাগ সেই সাহিত্য-দর্পনের সূতিকাগার। সময়+ইক= সাময়িক। শব্দটির এই উৎস থেকেই বোঝা যায়, সাময়িকপত্র মূলত সময়কে ধারণ করে-- সমকালকে বুকে রেখে এগিয়ে যায়। সাময়িকপত্রের সৃজন-বেদনে থাকে নতুনত্বের অনুপ্রেরণা। নতুন ভাব, অনাস্বাদিত ভাষা, অদৃষ্টপূর্ব বিন্যাসের সূচনা-- কেবল বাংলাদেশে নয়-- পৃথিবীর সব দেশেই প্রথম লিটলম্যাগের মাধ্যমেই হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন, রবীন্দ্রনাথেরর ভারতী বা প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র কি মূলত লিটলম্যাগ ছিল না? কে অস্বীকার করবেন, ওই সব পত্রপত্রিকা থেকে বাংলা সাহিত্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়নি? এমন কোন  অকৃতজ্ঞ  বলবেন, সেখান থেকে কৃতী লেখকের জন্ম হয়নি? যারা বলবেন, হয় তারা উন্মাদ, না হয় জ্ঞানপাপী।

এ-কথাগুলো মনে এলো ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের 'স্রোত' শীর্ষক একটি সাহিত্য-সংগঠনের কথা মনে রেখে। সেই সংগঠনটি আবার ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা-কেন্দ্রিক নয়। স্রোত-এর জন্ম ও বেড়ে ওঠা একটি ছোট্ট শহরকে কেন্দ্র করে-- যা জেলা কিংবা মহকুমা সদরও নয়! একটি থানা সদর, যার নাম কুমারঘাট, সেই ছোট্ট শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে 'স্রোত'। এর নেতৃত্বে আছেন গোবিন্দ ধর নামে চল্লিশোর্ধ এক তেজি তরুণ। তাঁর সঙ্গে আছেন তাঁর বয়সের এদিক বা ওদিক কয়েক জন নিবেদিতপ্রাণ সাহিত্যকর্মী। 'স্রোত' নামে তাঁরা একটি লিটলম্যাগ করেন এবং এ-নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানও তাঁদের আছে। এই স্রোতের মাঝি হয়তো একজন কিন্তু সঙ্গে আছে আরও মাঝিমাল্লা, দাঁড়ি, লগিঠেলা ও গুণটানা মানুষ-- প্রকাশ্যে এবং অন্তরালে। সকলের প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে 'স্রোত'। 

প্রকৃত লিটলম্যাগ প্রথাবিরোধী, বিপরীত স্রোতের যাত্রী। নতুন সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে তারা। লিটলম্যাগ যারা করেন তাদের আশা, লক্ষ্য, গন্তব্য সুদূরপ্রসারী। কিন্তু তা, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, প্রায়শই তার অপমৃত্যু ঘটে। লিটলম্যাগ একটি সাহিত্য-আন্দোলনও বটে। তবে তার পূর্ণতা প্রাপ্তি প্রায়ই লক্ষভেদী হয় না। অধিকাংশ লিটলম্যাগের জন্ম-মৃত্যু ধূমকেতুর মত। সে যেন টিকে থাকার জন্য আসে না। ক্ষণজীবী ও ক্ষীণজীবিতাই এর কুললক্ষণ। ধূমকেতু কিংবা আতশবাজির মত রং ছড়িয়ে, চোখ ধাঁধিয়ে, অশ্বক্ষুরের আওয়াজ তুলে লিটলম্যাগের আগমন ঘটে। কিন্তু অল্প দিন, মানে দু'চার বছর যেতে না-যেতেই সিংহভাগ লিটলম্যাগের অপমৃত্যু ঘটে। যেমন অপরিমেয় উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে জন্ম নেয় প্রতিটি লিটল তা তারুণ্যের ধর্ম আর যৌবনের অমিত শক্তির সঙ্গেই তুলনীয়। বাঙালির জীবনে তারুণ্য ও যৌবন যেমন অপেক্ষাকৃত ক্ষণস্থায়ী তেম্নি লিটলম্যাগও ক্ষীণজীবী। 

তবে নতুন চিন্তা, অভিনব প্রকরণ ও নতুন মাত্রা যোজনায় লিটলম্যাগচর্চা একটি সাহিত্য-আন্দোলনও। এই আন্দোলন ঐকবদ্ধ ও সমবায়ী হলে সাহিত্যে সূচনা নতুন দিগন্তরেখা। ত্রিপুরা রাজ্যে এই ঐকবদ্ধ লিটলম্যাগ আন্দোলন আরম্ভ করেছে 'স্রোত' শীর্ষক সংগঠনটি-- যার কর্ণধার গোবিন্দ ধর এবং তাঁর বলিষ্ঠ সহযোগিবৃন্দ। তাঁরই নেতৃত্বে ২০১৮-এর সেপ্টেম্বরে কুমারঘাটে অনুষ্ঠিত হলো "ত্রিপুরা লিটলম্যাগ গিল্ড"-এর দিনব্যাপী সম্মেলন। প্রায় চল্লিশটি লিটলম্যাগ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন এর সম্পাদক এবং প্রতিনিধিরা। কেবল ত্রিপুরা থেকে নয়-- সুদূর শিলচর থেকেও এসেছিলেন দু'চারজন সম্পাদক। তবে সবই-যে আক্ষরিক অর্থে লিটলম্যাগ পদবাচ্য-- তা অবশ্য নয়! এর মধ্যে পাঠ-অযোগ্য আবর্জনাও ছিল-- যেমন বেনোজলে পলির সঙ্গে ভেসে আসে ভাগাড়ের জঞ্জাল। সেখানেও তেমনটি ছিল না-- একথা বলা যাবে না। এ-সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে আমিও গিয়েছিলাম। অর্জন করেছিলাম অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা। সেকথা না-হয় বারান্তরে লিখবো। তবে ত্রিপুরার রাজধানী থেকে শতাধিক কিলোমিটার দূরে একটি প্রত্যন্ত থানা সদরে এমন একটি সম্মেলন আয়োজনে যে সাংগঠনিক সবলতা দেখিয়েছেন গোবিন্দ ধর ও 'স্রোত'-এর কর্মিবৃন্দ তা সানন্দে শংসা এবং অভিনন্দনযোগ্য।

0 Comments