আমার দেখা বাংলা সাহিত্য ভুবনে বিশিষ্ট কবি, প্রকাশক ও সাহিত্য সংগঠক গোবিন্দ ধর

জহর দেবনাথ 

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অদৃশ্য নদী বয়ে চলে সীমান্ত পেরিয়ে যেখানে কাঁটাতার বিভাজন করতে পারে না হৃদয়ের সংযোগ৷ এই ভাষার নদীই তাঁর ঘর, তাঁর আশ্রয় তাঁর নাম গোবিন্দ ধর৷ তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সংগঠক, সম্পাদক এবং একজন নিবেদিতপ্রাণ সংস্কৃতি-কর্মী৷ তাঁর কর্মজীবন এবং জীবনদর্শন এক কথায় ‘স্রোতের সন্তুষ্টি’ যেখানে ভাষা, সংস্কৃতি ও মননের জলধারা অবিরাম প্রবাহমান৷
জন্ম, ভৌগোলিক আবেগ ও আত্মিক সেতুবন্ধন  
ত্রিপুরার উত্তরপ্রান্তে অবিভক্ত উত্তর ত্রিপুরা জেলার রাতাছড়া গ্রামে, ১৯৭১ সালের ৩০ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন গোবিন্দ ধর৷ তাঁর শৈশব কেটেছে বাংলার সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলে যেখানে কাঁটাতার থাকলেও মন-প্রাণের মধ্যে ছিল না কোনো বিভাজন৷ বাংলাদেশের মৌলভীবাজার, বিশেষত কুলাউড়া ও কমলগঞ্জ এই অঞ্চলগুলোর সাথে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক নিবিড়৷ তিনি বারবার উল্লেখ করেন যে, তাঁর কবিতার অনেক আত্মা জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে এবং তাঁর সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা গড়ে উঠেছে এক যৌথ বাংলার অভিজ্ঞতায়৷

সাহিত্যিক যাত্রা ও সৃষ্টির বহুমাত্রিকতা

গোবিন্দ ধর নিজেকে কখনো শুধুই ‘কবি’ বলে সীমাবদ্ধ রাখেননি৷ কবিতা, প্রবন্ধ, ও আলোচনা সবকিছুতেই তিনি অবাধ ও আত্মবিশ্বাসীভাবে বিচরণ করেছেন৷ তিনি লিখেছেন ভাষা, সমাজ, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রান্তিকতার নানা দিক নিয়ে এবং তাঁর লেখায় ফুটে ওঠে এক গভীর মমতা ও বোধের দীপ্তি৷ তাঁর রচনার মধ্যে ত্রিপুরার সামাজিক বাস্তবতা যেমন উঠে আসে, তেমনি বাংলা ভাষার সর্বজনীন অভিজ্ঞতাও প্রকাশ পায়৷
তাঁর ভাষা স্বচ্ছ, সংবেদনশীল এবং চেতনাময় যা পাঠককে কখনো আবেগে আলোড়িত করে তোলে, কখনো বা গভীর ভাবনার দিকে ঠেলে দেয়৷ একাধিক ছোট কাব্যগ্রন্থ ও প্রবন্ধ সংকলন তাঁর সাহিত্যিক ভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছে, যা সাহিত্যের মূলস্রোতে প্রান্তের স্বরকে তুলে আনে৷

স্রোত’: একটি সাহিত্য আন্দোলনের নাম 

গোবিন্দ ধরের অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক সৃষ্টি হলো ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা ‘স্রোত’৷ এটি শুধু একটি পত্রিকা নয়, এক বিপ্লবী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নাম, যা ত্রিপুরার শহর থেকে গ্রাম, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, এমনকি সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে আলো ছড়িয়েছে৷ ‘স্রোত’ হয়ে উঠেছে বৃহত্তর বাংলা ভুবনের একটি আদর্শিক মঞ্চ, যেখানে নবীন-প্রবীণ মিলিত হয়ে বাংলা সাহিত্যের অন্তর্গত মূল্যবোধ, সমাজচিন্তা ও সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন৷
গোবিন্দ ধর নিয়মিত ‘স্রোত’-এর বিশেষ সংখ্যা সম্পাদনা করেন যেমন বাংলাদেশ-ত্রিপুরা সম্পর্কভিত্তিক বিশেষ সংখ্যা, প্রান্তিক সাহিত্য সংখ্যা, কবি সংখ্যা, কখনো বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের নিয়ে বিশেষ সংখ্যা ইত্যাদি, যা সাহিত্য চর্চাকে বহুবর্ণ রূপ দেয়৷

স্রোত প্রকাশনা  দুই বাংলার সাহিত্য সংযোগের এক নিরবধি ধারা

যেখানে ভাষা মিলেমিশে তৈরি করে সম্পর্কের সেতু, যেখানে সীমান্ত হার মানে মনের টানে সেইখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ত্রিপুরার কুমারঘাট (হালাইমুড়া ) থেকে পরিচালিত ‘স্রোত প্রকাশনা’, যার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ কবি, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক গোবিন্দ ধর৷ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার বৃহৎ ভুবনে ‘স্রোত প্রকাশনা’ শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এক আদর্শ, এক আন্দোলন, এক আশ্রয়স্থল যা সাহিত্যের প্রান্তিক কণ্ঠগুলোকে মূল স্রোতে নিয়ে এসেছে৷

প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ও দৃষ্টিভঙ্গি

ত্রিপুরার সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র কুমারঘাট-এ বসেই গোবিন্দ ধর লক্ষ্য করেছিলেন ছোট শহর, মফস্বল কিংবা সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বহু প্রতিভাবান লেখক কেবল প্রকাশনার অভাবে সাহিত্য জগতে নিজের জায়গা করে নিতে পারছেন না৷ সেই অভিজ্ঞতা থেকেই জন্ম নেয় এক দৃঢ় সংকল্প ‘স্রোত প্রকাশনা’৷
প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই গোবিন্দ ধর এই প্রকাশনা সংস্থাকে তৈরি করেন এমন একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে, যেখানে ত্রিপুরা, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, এমনকি বাংলাদেশের অগণিত সাহিত্যিক তাঁদের কাব্যগ্রন্থ, প্রবন্ধ, উপন্যাস, গবেষণা ও সাহিত্যচিন্তা নিয়ে আত্মপ্রকাশের সুযোগ পান৷

 দুই বাংলার সংযোগে ‘স্রোত’

‘স্রোত প্রকাশনা’-এর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো এর সীমান্ত ভাঙা মনন৷ বাংলাদেশের কুলাউড়া, সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা এবং পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, মালদহ, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি অঞ্চলের বহু লেখক তাঁদের বই এই সংস্থার হাত ধরে প্রকাশ করেছেন৷
এই সংস্থার সৌজন্যে বাংলা ভাষার একান্ত মফস্বলী চর্চার সঙ্গে শহুরে মননের সংলাপ গড়ে উঠেছে, যা বাংলা সাহিত্যের বৈচিত্র্য ও গভীরতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে৷

 বই নির্মাণের কারিগরি ও নন্দনতত্ত্ব 

স্রোত প্রকাশনা শুধুমাত্র বই প্রকাশ করে না, বই নির্মাণের প্রতিটি ধাপে গোবিন্দ ধর নিজে যুক্ত থাকেন লেখা নির্বাচন, সম্পাদনা, প্রচ্ছদ ডিজাইন, মুদ্রণ এবং প্রকাশোত্তর প্রচার ও পাঠক সংযোগ সবকিছুতেই থাকে এক আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্ব৷ বইয়ের নান্দনিকতা, মুদ্রণমান ও প্রচ্ছদের গুণগত উৎকর্ষ আজকাল অনেক বড় প্রকাশনার সঙ্গে তুলনীয়৷

স্বীকৃতি ও সাহিত্যসভায় উপস্থিতি

স্রোত প্রকাশনার বইগুলির জন্য বিভিন্ন সাহিত্য মেলা ও আন্তর্জাতিক উৎসবে আমন্ত্রণ পেয়েছেন গোবিন্দ ধর৷ বাংলাদেশ-ত্রিপুরা যৌথ বইমেলা, কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা, আগরতলা বইমেলা, কুলাউড়া সাহিত্য সম্মেলন সব জায়গাতেই তিনি নিয়ে গেছেন ‘স্রোতের বই’ এবং পাঠকের কাছ থেকে পেয়েছেন উষ্ণ স্বীকৃতি৷

 নবীনদের জন্য আশ্রয়স্থল 

নতুন কবি, গল্পকার কিংবা গবেষক যাঁদের এখনও বড় প্রকাশনা সংস্থার দরজায় কড়া নাড়ার সাহস আসেনি, তাঁদের জন্য স্রোত প্রকাশনা হয়ে উঠেছে আত্মপ্রকাশের অন্যতম মাধ্যম৷ অনেক নবীন লেখক তাঁদের সাহিত্য জীবনের প্রথম বই প্রকাশ করেছেন এই সংস্থার হাত ধরে৷ কেউ কেউ আজ প্রতিষ্ঠিত নাম তাঁদের সাহিত্যের পথ চলা শুরু হয়েছিল ‘স্রোত’ থেকেই৷

সংস্কৃতির সেতুবন্ধনে অগ্রপথিক

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মিলনস্থলে দাঁড়িয়ে গোবিন্দ ধর এক অসামান্য সেতুবন্ধনের কাজ করে চলেছেন৷ তিনি ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করে বাংলাদেশ-ত্রিপুরা সাহিত্য সংযোগকে শক্তিশালী করে তুলেছেন৷ তিনি নিজে উপস্থিত থেকেছেন বাংলাদেশের কুলাউড়া, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, ফেনী, চট্টগ্রামসহ বহু শহরে আয়োজিত সাহিত্যসভায়, যেখানে তাঁকে আন্তরিকভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে৷
সংবর্ধনা ও আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক স্বীকৃতি 
২০২৩ সালের মার্চে বাংলাদেশের কুলাউড়া ও কমলগঞ্জে ‘স্রোত সাহিত্য পরিষদ’-এর উদ্যোগে বিশেষ সংবর্ধনা প্রদান করা হয় গোবিন্দ ধরকে৷ সেখানে তাঁকে সাহিত্যিক সংযোগ, প্রকাশনা ও সম্পাদনার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখার জন্য ক্রেস্ট ও সাহিত্যপত্র উপহার দেওয়া হয়৷
তাঁর অংশগ্রহণে অক্টোবর---নভেম্বর ২০২৩-এ অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ-ত্রিপুরা বই উৎসব’ (যা দুই বাংলার সাহিত্যের মিলনমেলায় পরিণত হয়) বিশেষ গুরুত্ব পায়৷ ত্রিপুরা তথা ভারত থেকে আগত প্রতিনিধিদের মধ্যে গোবিন্দ ধর ছিলেন অগ্রগণ্য, এবং উৎসবে তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ও সাহিত্যপ্রেম প্রশংসিত হয় সর্বস্তরে৷

নিরবধি পথ চলা ও সংগ্রামী সাহিত্য চেতনা

তাঁর জীবনযাত্রা যেমন সরল, তেমনি সংগ্রামী৷ শহরের কেন্দ্র থেকে দূরে থেকেও সাহিত্যের আলো তিনি পৌঁছে দিয়েছেন গ্রামীণ প্রান্তরে৷ কাঁটাতার, সামাজিক প্রতিকূলতা বা সীমাবদ্ধ অর্থনীতি কখনো তাঁকে থামাতে পারেনি৷ বরং এসব বাধাই তাঁর সাহিত্যের ভিত শক্ত করেছে৷ একাধিক সাহিত্য প্রতিযোগিতা, কর্মশালা ও সাহিত্যপাঠের আয়োজনের মধ্য দিয়ে তিনি নবীনদের সুযোগ করে দিয়েছেন নিজেদের প্রকাশের৷

উপসংহার

এক ভাষা যোদ্ধার জন্মোৎসব
৫৫তম বছর পূর্ণ করলেন এই ভাষা সৈনিক৷ জন্মদিন শুধু তাঁর ব্যক্তি জীবনের গৌরব নয়, বরং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর নিরলস শ্রম ও উৎসর্গের উদযাপন৷ তাঁর জীবন আমাদের শেখায় কীভাবে নির্বিচারে, বিনয় ও মননের ছায়ায় পথচলা যায় ভাষার জন্য, সংস্কৃতির জন্য৷
গোবিন্দ ধর এমন একজন মানুষ যাঁকে ‘সংগঠক’ বললেও কম বলা হয়৷ তিনি বাংলা ভাষার প্রবাহমান ধারার এক আধুনিক মুখ, যাঁর সাহিত্য ও প্রকাশনা উত্তর প্রজন্মের জন্য রেখে যাবে একটি বিশুদ্ধ ও প্রেরণাময় দিশা৷

0 Comments