থালগাঙের পারে কুর্তি হাওরের অপরূপ এক বিকেল ||গোবিন্দ ধর
থালগাঙের পারে কুর্তি হাওরের অপরূপ এক বিকেল
গোবিন্দ ধর
কথাবিশ্ব
ত্রিপুরা এক ছোট রাজ্য।ত্রিপুরা আটটি জেলায় বিভক্ত। সব থেকে উত্তরে উত্তর ত্রিপুরা জেলা।আর এই উত্তর ত্রিপুরায় জল জলাভূমি কেন্দ্রিক জীবনযাপন করে চলছেন বৃহত্তর জনগণ। তাদের জীবিকা বলতে মাছশিকাই সম্বল।এখানেই আছে কুর্তি হাওর। আর ছোট নদী থালগাঙ। একসময় এই নদীকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সাথে ত্রিপুরার ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিলো।থালগাঙের জলধারা দিয়ে কয়লা ঔষধ আসতো আমাদের ত্রিপুরায়।এখানের চা বাগান থেকে চা পাতা যেতো বহির্বিশ্বে।পরস্পর এই যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে বিস্তীর্ণ জলাভূমি কুর্তি হাওর আর থালগাঙই সেদিন ছিলো জনগণের নিকট আশীর্বাদ যা আজও আসাম ত্রিপুরার প্রান্তিক এই অঞ্চলের কাছে এখনো মাছই ভরসা।জলই জীবন।কিছুদিন আগেও কুর্তি হাওর জুড়ে ত্রিপুরা সরকার আয়োজন করতেন কুর্তি হাওর জল উৎসব।জল মানুষের নিকট আশীর্বাদ। জল জীবন।
কথামুখ :প্রাবন্ধিক মন্টু দাসের কলম
কুর্তির হাওর বা কুর্তি বিল মূলত: তিনটি হাওরের সমন্বিত রূপ। এই তিনটি হাওর হল ----- মেদলির হাওর, পুতনির হাওর ও কুর্তি হাওর। মেদলি ও পুতনির অবস্থান অসমে। অর্থাৎ অসমের করিমগঞ্জ জেলায়। আর কুর্তির অবস্থান ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর ত্রিপুরা জেলার ধর্মনগর মহকুমার উত্তর অংশে। অতএব এই বিলের অবস্থান দুই রাজ্যের মধ্যে হলেও জলাভূমির এক বৃহত্তর অংশ ত্রিপুরার ভূখণ্ডে। এই বিলের জলের উৎস হল অসম ত্রিপুরার ছোট বড় নয়টি ছড়া। এগুলো হল কালা গাঙ,ইছই মিয়ার নালা, কুর্তি গাঙ, কাবিল ছড়া, ফারজুল ছড়া, তিরিমটি ছড়া, মেদলি ছড়া, কুকিতল ছড়া ও পুতনি ছড়া। এই জল ধারা গুলি সারা বছর ধরে এই বিলকে প্লাবিত করে।
প্রকরিতির রুদ্র রোষে এখন জলভাগ কমে গেছে। ২০০৮ সাল পর্যন্ত এখানে নৌকা বাইচ হত। হাজার হাজার মানুষ এই দৃশ্য উপভোগ করত। এই বিলের উত্তর অংশ থেকে থাল গাঙ নামক একটি বড় জলধারা বেরিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে জুড়ি নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। জুড়ি বাংলাদেশের হাকালুকি হাওরের মধ্য দিয়ে কুশিয়ারাতে মিশেছে। সুরমা কুশিয়ারা ও মনু একত্রিত হয়ে মেঘনার সাথে মিশেছে। এই জল পথ ধরে তৎকালীন ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে আমাদের অঞ্চলে ও বরাক উপত্যকায় চা শিল্পের নানান ধরণের সামগ্রী আসত। আসত ঔষধ পত্র, নানান খাদ্য সামগ্রী। তখন রেলপথ ছিলনা।
বর্তমান কুর্তি বাজারের পাশে বিশাল জল বন্দর ছিল ------ যখন কদমতলার অস্তিত্ব ছিল না। পালতোলা নৌকায় টনটন মাল আসত। আর শত শত ঘোড়ায় মাল নিয়ে আসত ধর্মনগর সহ নানা অঞ্চলে। কুর্তিতে বিশাল বাজার বসত। এখানে ত্রিপুরার মহারাজার তহশিল কাছারি ছিল।
এই বিশাল বিলের চার পাশে এগারোটি গ্রাম রয়েছে।
এখানকার হাজার হাজার মানুষ এই বিলের উপর নির্ভর করে জীবন ধারণ করত। সে এক বিশাল ইতিহাস। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে নৌকা চলত। বিলে পদ্ম, শাপলা, সিঙ্গাইর সহ নানা কিছু ছিল। মাছ ছিল অফুরন্ত। জল কমলেও আজও উত্তর জেলা সদরের মোট মাছের চাহিদার এক বৃহত্তর অংশ এই বিল থেকে আসে । এখানকার মূর্তি থেকে তৈরি হয় শীতল পাটি । এখানে ছড়িয়ে আছে নানা উপকথা। এ নিয়ে আমার বিশাল লেখা রয়েছে।
এবছর জল একেবারে কম। তবুও শাপলা ফোটেছে। তবুও কথা বলে ইতিহাস।
সেদিন আমাদের সফর কুর্তির হাওর জুড়ে খোলারোদের ঝিলিক
আমি সঞ্জীব দে ও আমাদের গোটা পরিবার এ যাত্রায় ছিলাম।কত অজানারে জানলাম।সেদিন ভবানন্দের মাজার পরিদর্শন পরে আমি চলে যাই কদমতলা হয়ে থালগাঙের উদ্দেশ্যে।তারপর কুর্তির হাওর পরিদর্শন করলাম।অনেক ছবি তুলে বিকেলটা উপভোগ করলাম।দুদিক যেদিকে যায় দিকশূন্য মাঠ আর জল।আর ছিল মুক্তা বেতের ঝোপ।ছোটবেলা আমাদের বাড়ির আসেপাশে পুকুরে এঁদো ডুবায় এই ঝোপঝাড় অনেক দেখেছি।শুনতাম এই মুক্তাবেত ঝাড় থেকেই আমাদের ঘরে ঘরে বিছানার গরমকালের শীতলপাটির উপাখ্যান। সেদিন সারা হাওরজুড়ে মুক্তাবেতের ঝোপঝাড় দেখেছি।আর থালগাঙের ঝিরিঝিরি প্রভাহিত স্রোত বিকেলের সূর্য কিরণে বেশ অপরূপ লাগছিলো।
একটু সময় অন্যরকম আনন্দের জন্য পদ্মশ্রী মজুমদার সুমিতা পাল ধর গৌরব ধর গৈরিকা ধর আমি ও কবি প্রাবন্ধিক সঞ্জীব দে মন্টুদা আর নিভা চৌধুরী বৌদিসহ আমরা সাকুল্যে সাতজন চলে যাই হাওর ও থালগাঙ দেখবো বলে।
কদমতলায় নীলকন্ঠ আয়োজিত থালগাঙের পারে সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করে সম্পাদক নিবারণ নাথ এই স্পৃহা জাগিয়েছিলেন।সেদিনই বলেছিলাম একবার আসবো।কিন্তু নিবারণদাকে সাথে পাইনি।সঞ্জীব ছিলো।কারণ কিছুদিন হয় সঞ্জীব চুরাইবাড়ি স্কুলে বদলি হয়ে শিক্ষকতায় যুক্ত।
যদিও এই দেখা অসমাপ্ত। সেদিন সবাই একসাথে হয়ে থালগাঙের মোহনায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা না হলেও আকাশ আবছা মেঘাচ্ছন্ন থাকায় সহসা যেন বিকেল শেষ হয়ে গিয়েছিল।
তাও কম কিসের।কম নয় এ দেখাও দেখা। এ দেখাও জীবনের সঞ্চয়। প্রতিটি ভ্রমণের এক মাদকতা আছে।আছে আবিস্কারের মোহ।যদিও সে হয়তো জীবন যাপনের কাছে সামান্যই। তাও ঘর থেকে বাইরে যেতে মন চায়।চায় বারবার বেরিয়ে পড়ি।আর কার না ভালো লাগবে যে জায়গায় যাচ্ছি সে ভূগোলের সাথে পরিচিত আছে এমন কেউ সাথী হলে।প্রাবন্ধিক মন্টু দাস আমার নিকট এমনই একজন মনে হয়।আপাদমস্তক কবি হয়েও পুরানো ইতিহাস থেকে উপাদন সঞ্চয় করে পুনঃনির্মাণের মোহ তাঁর আজীবনের নেশা।তিনি আমাদের উত্তর ত্রিপুরায় জীবিত এক কিংবদন্তী ঐতিহাসিক কার। যার মুখে মুখে ঘুরে ইতিহাস।পুরানো নানা উপাদান মন্টুদার জীবনকে ঘিরে আছে। আমি জানি তিনি আসলে একজন সাংস্কৃতিক মানুষ। সেই কালাছড়া সাংস্কৃতিক উৎসব ও প্রদর্শনী যখন তিনি ১৯৯৫ সালে আয়োজন করতেন তখনই বুঝেছি মানুষটার মননে লালিত রাধারমণ, হাছন লালন আবার ইতিহাসের নানা ঘটনার ঘনঘটা।
থালগাঙ দেখতে গিয়েও টেরপাই মন্টুদার মননের যাপন চিত্র।সঙ্গী কবি ও প্রাবন্ধিক সঞ্জীবও একজন সাথী হিসেবে অসাধারণ অনুভূতিশীল মানুষ।যাকে যখন যেমন চেয়েছি এক ডাকে চলে আসতে পারে সুদূর দক্ষিণ ত্রিপুরা থেকে উত্তর ত্রিপুরার থালগাঙ।
২৫:০৭:২০২১
0 Comments