কবি প্রণব দেবনাথ ও আমার কবিতা পরিক্রমা 
গোবিন্দ ধর 
এক সময় সারা ত্রিপুরা ঘুরতাম কবিতা পাগল এই আমি।কবি রসরাজ নাথদা একদিন পরিচয় করিয়ে দিলেন প্রণব দেবনাথ মহোদয়ের সাথে।তখন রসরাজ নাথ প্রণব দেবনাথ  বিনয় দেবনাথসহ আরো একজন মিলে বীজাণু হাতে লেখা লিটল ম্যাগাজিন ফটোকপি করে বের করতেন পানিসাগর থেকে।অনেকগুলো সংখ্যা সাধারণ ডাকে রসরাজদা পাঠাতেন অধমকেও।আমার উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিন সংরক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রে অক্ষত ও সংরক্ষিত আছে সে সময়ের ডাকে পাঠানো বীজাণু সংখ্যাগুলো।আছে অনার্য কাগজটিও।
কবি সুধন্য ত্রিপুরার পানিসাগরের বাসায় যাওয়ার পথেই প্রণব দেবনাথদার নিজস্ব বাড়ি। বহুবার না বলেই ডু মারতাম।এ ছিল আমার কবিতারোগ।
ত্রিপুরার প্রায় অধিকাংশ কবির বাসায় আমি উপস্থিত হতাম।কবিকে জানার জন্য। উত্তর ত্রিপুরার খেরেংজুড়ির প্রবীরকুমার সিংহ,সুদেবী সিংহ,চুরাইবাড়ির রাহুল ভট্টাচার্য, রতন চন্দ থেকে ধর্মনগরের সেলিম মুস্তফা, পীযূষ রাউত, মন্টু দাস,বিধানচন্দ্র দে,কদমতলার নিবারণ নাথ,নকুলচন্দ্র দেবনাথ, ধর্মনগরের সুজিত দেব,হৃষীকেশ নাথ,রত্নময় দে, তমাল শেখর দে থেকে দখিনদোয়ার নয়াপাড়ায় সম্তোষ রায়ের বাড়ি গিয়েছি।কবিদের কাছে থেকে অনুভব করার চেষ্টা করেছি।রত্না বৌদি,নিভাবৌদী তমালগিন্নী নবনীতা থেকে পীযূষদার গৃহিনী সান্তনাবৌদির হাতের জলখাবার থেকে সুস্বাদু রান্না চা বহুদিন খেয়েছি। এমনকি নিভাবৌদীর বাসায় বহুরাত আমার কেটেছে। কদমতলায়ও নিবারণদার বাসায় বহুদিন রাত কাটিয়েছি।নকুল চন্দ্র দেবনাথের সিলেটি কবিতার আকর্ষণে বহু সময় ব্যয় করেছি।ধামাইল গানের সুরের নেশায় বহুরাত কাটিয়েছি কদমতলায়।
অনেক কবির আমন্ত্রণ থাকার পরেও আমার সময়ের অভাবে বাড়ি যাওয়া হয়নি।সে তো আছেই।আবার অনেকে কখনোই আমন্ত্রণ জানাননি তবুও যেচে গিয়ে হাজির হয়েছি কবিতার নেশায়।
কবি প্রণব দেবনাথের বাসায়ও বহুবার গিয়েছি।অনেকদিন দীর্ঘ আড্ডা সেরে আবার গাড়ি ধরে তখন রাতাছড়ায় ফিরে এসেছি।গাড়িও কি আর ততো চলতো আসাম আগরতলা সড়কে?নিশ্চয়ই ততো স্থানীয় যাতায়াতের সুবিধা ছিলো না।তবুও কবিতার টানে ট্রাকের উপর চড়েই পানিসাগর ধর্মনগর চলে যেতাম।
সেলিমদার ধর্মনগরের কাঠের দ্বিতল ভাড়া বাড়িতেও ছিল বহুবার যাতায়াত। এমনকি পানিসাগর গ্রামীণ ব্যাংকেও হানা দিয়েছি কবিতার জন্য। রসরাজদার বাসাও বহুবার।তারপর মিলনকান্তি দত্তের বাসায় কতবার কত কাজে কত আড্ডায় কত সময় যে ব্যয় করেছি তার লেখাজোঁকা নেই। বারবার ছুটে যাই নিজেকে সমৃদ্ধ করতে।সন্ত কবি মিলনকান্তি দত্ত মহাশয়ের থানা রোড পানিসাগর বাড়ি।তিনি কবিতার জন্য সংসার বিবাগী ।কোনোদিন বিরক্তি প্রকাশ করেননি মিলনকান্তি দত্ত মহোদয়।
সেই কবিতার নেশায়ই আমি ঘুরঘুর করতাম।কবিতা আমার মগজ খেয়েছে। কবিতার কাছে পৌঁছাতে কবির নিকট যেতাম।কবিকে বুঝতাম তাঁর জীবন থেকে। যাপন থেকে।তাঁর যাপিত জীবনের পরতে পরতে কবিতার পংক্তি খুঁজতাম। কতটুকু কবিকে পেয়েছি কবিতাকে ছুঁতে পেরেছি জানি না।কবিদের আড্ডা থেকে উঠে আসতো কবিতার নির্যাস।কবিকে চেনার মোক্ষম আড্ডাগুলো থেকে শিখতাম।
কোনো এক সময় সেই বীজাণু প্রকাশের দিনগুলোতে আমি হাজির হয়েছিলাম কবি প্রণব দেবনাথের বাড়িতে কবিতার নেশায়।দীর্ঘ আড্ডা চলছিলো।সম্ভবত কবি প্রণব দেবনাথ একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন।আমি স্রোতস্বিনী সম্পাদনায় যুক্ত। তারপর স্রোত যখন প্রকাশ হতে চলছিলো সে সময়ের কথা বলছি।আড্ডা চলতে চলতে এক সময় কবি প্রণব দেবনাথ বললেন তিনি কোনো বৃত্তের কবি নয়।তাঁর কবিতার কোনো শিরোনাম মোক্ষ নয়।তিনি বললেন তাঁর কবিতা শিরোনাম হীন হলেও চলে।আমি কিছুটা এগিয়ে বললাম কবিতার শিরোনাম হয়তো মোক্ষ নয়।কিন্তু একটি কবিতা পাঠে পাঠককে একটি দিশা তো দেয়।সুতরাং শিরোনামও প্রয়োজন।তারপর তুমুল ঝগড়া। এক সময় বেরিয়ে আসি।আমি বলে দিই দেখুন আমি যে লিটল ম্যাগাজিনটা করি তার নাম স্রোত। আমি হয়তো সেই ব্যানারকেও বাদ দিতে পারি।কিন্তু আবহমান বাংলা ভূখণ্ডের কবিতা পাঠক বা সাহিত্য পাঠককে নির্দেশ করাও তো প্রয়োজন লিটল ম্যাগাজিনেরও তাই একটি নাম দিলাম।আমি সম্পাদনা করি স্রোত। হয়তো আমার কোনো ব্যানাররেই প্রয়োজন নেই। আপনি বলছেন আপনার কবিতার শিরোনাম দরকার নেই। কবিতার শিরোনাম মোক্ষ না হলেও চলে।কিন্তু কবিতা পাঠকের নিকট কবির ভাষাকে দীক্ষিত করে তুলতে শিরোনামও একটি বিষয়।পাশাপাশি কবি তাঁর কবিতাকে সকল কবি থেকে আলাদা করাটা আসল কাজ।জরুরী কাজ হলো কবি তাঁর কবিতাকে সকল কবির থেকে সতন্ত্র বলয়ে চিহ্নিত করা।এ কাজে যে সকল কবি সফল তিনিই প্রকৃতপক্ষে সফল।আপনি কবিতার শিরোনাম দিলেন কি না দিলেন এটা মোক্ষ নয়।কবি প্রণব দেবনাথ সেদিন রেগেও গেছিলেন। আমি সেই থেকে কবি প্রণব দেবনাথের বাসায় আর কখনও যাইনি।তাঁর বাড়ি পেরিয়ে বহুবার কবি সুধন্য ত্রিপুরার বাসায় পৌঁছে গেছি।কবি প্রণব দেবনাথ কেমন আছেন খবর রাখিনি।যদিও তাঁর কবিতা আমি নিয়মিত অনার্যে পড়তাম।তাঁর মুখোমুখি হলে কথা বলতাম।কখনোই আমাদের সেই আড্ডার তর্কাতর্কি ব্যক্তিগত জীবনে এসে লাগেনি।
এখন যদিও কবিতা আর কবিকে এক করে নানান রসালো ঝালমুড়ি ফেরি হয়।আমাদের কবিতায় হাতেখড়ি তর্কাতর্কি অধিকার আদায়ের নানান চিলচিৎকার চেঁচামেচি বইমেলায় কবিতা পাঠের সুযোগ করে দিতে কবি দিলীপ দাস মহাশয়ের সাথে কবি কল্যাণ গুপ্ত মহাশয়ের সাথে কত বাকবিতণ্ডা করেছি।কিন্তু কোনোদিন ব্যক্তি দিলীপ দাস,ব্যক্তি কল্যাণ গুপ্তের সাথে আমাদের কবিতা যাপনের দিনগুলো অসুন্দর হয়ে ওঠেনি।
এখন সে সব সোনালী দিন নেই। ব্যক্তি ও কবিকে এক পাতে তুলে নানান মজাদার টকঝাল বাজারে রটে।কবিকে হেয় করা হয়।আমাদের সময় তেমন ছিলো না।আমরা প্রবীন থেকে নবীন সকলের কবিতা গোগ্রাসে গিলতাম। পড়তাম।একটি বই বের হলে কিনতাম।কিনতে না পারলে যেকোনভাবে সংগ্রহ করে পড়তাম।এখন কবির সংখ্যা আঙুলের কড়া বেয়ে অসংখ্যজন।কে কার খবর রাখে সামাজিক মাধ্যমে একটি আইডি আছে মানেই তিনিও কবি।সে কবিতার ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতা জানার দরকারই বা কি।
কবি প্রণব দেবনাথ এখন অসুস্থ। দুই মাস যাবৎ শয্যাশায়ী।কিছুই খেতে পারছেন না এমন সংবাদ ।কিছুদিন আগে গৌহাটি থেকে চিকিৎসা করে বাড়ি ফিরে এসেছেন। গত বিজয়া দশমীর বিকাল বেলা  কবি রসরাজদার সাথে দুই চারটি কথাবার্তাও বহু কষ্টে হয়েছে শুনলাম।এর একদিন পর ধর্মনগর থেকে কবি সুজিত দেব, কবি রত্নময় দে ,কবি জয়ন্ত রায় সহ আবার তাঁকে দেখতে গেছেন।রসরাজদার ফেইসবুকে লিখলেন সেদিন কোন কথা বলার মত অবস্থা ছিল না কবির।প্রণব দেবনাথ ' অনার্য ' কাগজের বেশ কয়েকটি সংখ্যার সম্পাদনা করেছেন। কবি মন্টু দাসও দেখে গেছেন তিনি ফোন করে জানালেন অবস্থা আরো খারাপ। তাঁর আরোগ্য কামনা করছি।কবি আরো দীর্ঘদিন আমাদের মাঝে কবিতা লিখুন প্রত্যাশা রইলো।

২৮:১০:২০২২
সময়:৯:৩০মি
ডেমছড়া।

0 Comments