গোবিন্দ ধরের নদী নদীর গোবিন্দ :হারাধন বৈরাগী
গোবিন্দ ধরের নদী নদীর গোবিন্দ :হারাধন বৈরাগী
৩.কবি ও নদী
কবির জীবনের দিকে গভীরভাবে থাকালে একটি বিষয় নজড়ে আসে।কবির জীবনে ত্রিপুরার তিনটি নদী সুগভীর রেখাপাত করেছে।শৈশবে জুরী বয়:সন্দি ও যৌবনে মনু,মাঝ বয়সে নদী দেও। এইভাবে হয়তো নদীর সাথে কবির সহবাসকে ভাগ করা যাবে না।তবুও বলবো এই তিনটি নদী অর্থাৎ ত্রিবেনী সঙ্গমের সাথে কবির আজীবন সখ্যতা ও কবির মননজমিন তৈরীতে অসামান্য ভূমিকা পালন করে চলেছে।অসামান্য ভূমিকা পালন করে চলেছে নদী মনুর সাথে জড়িয়ে থাকা দুটি ছড়া, রাতাছড়া ও আনুয়ারা ছড়া।এগুলি যেন কবির কাছে শুধু নদী কিংবা ছড়া নয়। এরা কবির কাছে মানব মানবী, কবিতাপুরুষ ও কবিতানারী হয়ে উঠেছে। আর যখেরধনের মতো আজীবন বুকের মাঝে সফেন ফল্গুধারা রচনা করে চলেছে-কবির শ্বাসপ্রস্বাসের মতো এরা কবির বুকের লাভডাব। ।যারা ছাড়া কবি মৃত্যুতুল্য,আনুয়ারা বেগম যেন।এ যেন কবির স্বর্গ-নরক।কবির বেহেস্ত-জাহান্নম!
কবির নিজের কথায় ফিরে তাকাই-
"আমার ছোটবেলার নদী জুরি
বয়ঃসন্ধির নদী মনু
ভাটিবয়সের নদী দেও।
আমার স্কুলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো
যে ছোটনদী তার নাম রাতাছড়া।
মহিষ চরাতে গিয়ে পেয়েছি
ডিগবাজীতে তিড়িংবিড়িং
একটি ছোট খাল যার নাম আনোয়ারা।
এরকম নদী ছড়া আর খাল মিলেই
প্রতি রাতে জলোচ্ছ্বাস উঠে বিছানায়।
ছোটবেলায় বন্যা এলে উঠোনে মাছ আসতো।
ভাটি বয়সেও বন্যা শিয়রে আসে
লাফালাফি করে বুকের ভেতর শিং মাছ।"(নদীমাতৃক)
এখানে কবির তিনটি নদী সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়।কবির শৈশবের নদী জুরী। এটি উত্তর ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য নদী। এটি ত্রিপুরা রাজ্যের চির-বাসন্তী জম্পুইপাহাড়ের উত্তরপূর্ব অংশের ক্রমনিম্ন পাহাড় অঞ্চল থেকে উৎপত্তি লাভ করে উত্তর ত্রিপুরাজেলার ধর্মনগর বিভাগের মধ্য দিয়ে সর্পিলাকার পথে উত্তরাভিমুখে অগ্রস্বর হয়ে, ধর্মনগর শহরছুঁয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ধর্মনগর থেকে শুরু করে বেশ কিছুদূর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সীমারেখা বরাবর উত্তর দিকে প্রবাহিত হওয়ার পর কুলাউড়া উপজেলার মধ্য দিয়ে আরো উত্তরে গিয়ে আকালুকি হাওড়ের মধ্য দিয়ে পশ্চিম দিকে ঘুরে ফেঞ্চুগঞ্জের নিকট কুশিয়ারা নদীতে পতিত হয়েছে।নদীটির দৈর্ঘ্য ৭৩কিমি।এই নদীটি কবির ছোটবেলায় কবির সাথে জারিজুরী করতো। কবি - দিদির সাথে এই নদীতে নেমে জলখেলি করতেন। এইনদীর স্মৃতি কবির বুকে আজন্ম শ্বাস ছাড়ে।একদিন এই নদীতেই দিদির সাথে নেমে জলখেলি করতে গিয়ে জলের তোড়ে ভেসে যান। খবর পেয়ে পিতা দৌড়ে এসে সে যাত্রায় তাঁদের রক্ষা করেন। এই নদীর সাথেই কবির শৈশবের প্রথম মানঅভিমানের শুরু।
কবি যখন সেই ছোটবেলায় পিতার কাঞ্চনবাড়ি বদলীর সুবাদে স্বপরিবারে তাঁদের মূলবাড়ি রাতাছড়ায় ফিরে যান তখন আরেক নদী মনুর সাথে কবির বয়:সন্দি ও যৌবনের জলখেলি মান অভিমান ও লুকোচুরি খেলা শুরু হয়।
এখানেই কেটেছে কবির গহনবেলা।এখানেই তাঁর আবাল্য হৃদয়বন্ধু মহিষচড়ানোর সাথী রহমতভাইয়ের কাউকে কিছু না বলে তাঁদের বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া।এখানেই কবির বেড়ে ওঠার সাথে সাথে মনুর,তাঁদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসা। এখানেই কবির মনুর চর থেকে কাঠসংগ্রহ, মনুর জলে লাইখেলা-মহিষের লেজ ধরে এপার ওপার করা।মনুর বাঁক নেওয়া ঝিলে তাঁর পিতার সাথে মাছ ধরা। এখানেই কবির হৃদয়বন্ধু মতিন, বদরুলের বসতভিটে মনুর ভাঙ্গনে চলে যাওয়া-মনুর জলে বন্যার সময় লাকড়ি ও লাউকুমড়ো ধরা।এই নদী তীরেই তাঁর পিতা, মাতা ও কাকার চিন্তায় আগুন জ্বালানো।এই নদীর চরেই বন্যাশেষে ধানচাড়ার লাফিয়ে বেড়ে ওঠা,বাঁক নেওয়া নদীর ঝিলে পরিযায়ী পাখির আসা যাওয়া।এখানেই তাঁর পাঠশালায় পাঠ নেওয়া।।এখানেই তাঁর প্রথম প্রেমনিবেদন-তাঁর প্রথম কবিতা।এখানেই তাঁর প্রথম পারিশ্রমিকের টাকায়, উনুনে মায়ের আগুন জ্বালা।এখানেই কবির কবিতার প্রথম রসুইঘর।
এখানেই এই নদীর উপছড়া রাতাছড়া ও পার্শ্ববর্তী আরেক ছড়া আনুয়ারার সাথে কবির আত্মিক মেলবন্ধন ঘটে। রাতাছড়া ও আনুয়ারা ছড়ার দু:খ কবিকে রুধিরাক্ত করতে থাকে জুম্মবীর স্যুচ্চেংতাগলের মতো। এই রুধিরাক্ত ফোঁটা ফোঁটা ক্ষরণবিন্দু গুলি কবি মনে জমতে থাকে।কবি ধীরে ধীরে কবিতা লিখতে শুরু করেন।এখানে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই বড়ো হতে থাকেন কবি।সাহিত্য সংস্কৃতির মালা গলায় পড়তে থাকেন একে একে।
এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না যে মনু ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের উল্যেখযোগ্যনদী। ত্রিপুরার দীর্ঘতম নদী।এর আগে মনুর শরীর নিয়ে কিছু বলতে হয়। মনুনদী পার্বত্য ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম যেখানে আন্তর্জাতিক সীমারেখা রচনা করেছে, তারই পূর্বকোণের লংতরাই পাহাড়শাখার উঁচুভূমি হতে দুটি উপনদীরূপে উৎপত্তি হওয়ার পর উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে ত্রিপুরার চাওমনুতে একত্রে মিলিত হয়েছে। এই মিলিত স্রোতধারা উত্তরাভিমুখে সর্পিলাকার গতিপথে মার্কাছড়া দূর্গাছড়া ছৈলেংটা ময়নামা মনু মাছলি নালকাটা কাঞ্চনবাড়ি কুমারঘাটে দেওনদীর সাথে সঙ্গম রচনা করে, ফটিকরায়-সায়দারপাড়-শান্তিপুর- জলাই -কাউলিকুড়া- কৈলাশহর হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া দিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে প্রায় ২৫ কিমি প্রবাহিত হওয়ার পর ধলাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে ধলাই নামেই প্রথমে পশ্চিমে এবং পরে উত্তরে প্রবাহিত হওয়ার পর মনুমুখ-এর কাছে মনু নদী হিসেবে কুশিয়ারা নদীতে পড়েছে।দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬৭ কিলোমিটার। এই নদীধারা পথে মানুষ অমানুষের সুখ-দুখ-ভালবাসার অমৃতধারা রচনা করে চলেছে।
পিতার অকালমৃত্যু, পিতার শূন্যস্থান পূরণে কবির পারিবারিক দায়িত্ব গ্রহন ও চাকুরীতে প্রবেশ। ধীরে ধীরে কবির ক্ষরণবিন্দু ধরে বেদনাও দায়বদ্ধতা বাড়তে থাকে। আবাল্যবাউণ্ডুলে কবি আর রাতাছড়া থিতু হতে পারেননি। দাদা ছোটভাইকে জমিজমা দান করে চলে আসেন দেওমনুসঙ্গমে হালাইমুড়ায়।এখানে এসে দেওনদীর সাথে কবির আত্মিকসম্পর্ক গড়ে ওঠে।কবির জীবনে অপর একটি উল্যেখযোগ্যনদী দেও। এই দেওনদীর উৎপত্তি উত্তর ত্রিপুরা জেলার চির-বাসন্তী-জম্পুই পাহাড়ের সর্বদক্ষিন এলাকা যেখানে জম্পুই ও শাখান প্রায় ছুঁই ছুঁই করছে। দেওনদীর দৈর্ঘ্য উৎস থেকে মোহনা অবধি প্রায় ৯৮ কিমি।দেও নদ ত্রিপুরার সর্বোচ্চপাহাড় জম্পুই থেকে উৎপন্ন হয়ে পাহাড় টিলা ডিঙ্গিয়ে দেওভ্যালি নামক এক বিস্তীর্ন উপত্যকার মধ্যদিয়ে কালাপানি আনন্দসাগর ,আনন্দবাজার ,গছিরামপাড়া ,বুড়িঘাট ,আদিবাসী ,দশদা, বড়হলদি ,সাতনালা ,কাঞ্চনপুর ,লালজুরি ,মাছমারা, পেচারতল, -----ইত্যাদি জনপদকে ছুয়ে অবশেষে কুমারঘাটের হালাইমুড়ায় মনুনদীতে নিস্পন্ন হয়েছে।
এখানেই কবির আসল কবিতার রসুইঘর। শুরু হয় দেওমনুর সঙ্গম ধরে সফেন সঙ্গমমন্থন। একে একে তৃসন্ধ্যা নদী তাকে ডাকতে থাকে। নদীর ডাক শুনতে পান তিনি। রেঙ উঠে তাঁর শিরায় শিরায়।একে একে লিখতে থাকেন আনুয়ারা ছড়া, দেওসমগ্র মনুসমগ্র নদী কাব্যগুলি।আরো ডাক আসছে বিড়িপাতাছড়া,, লঙ্গাই তিতাস কর্ণফুলি, মেঘনা, গোমতী, তিস্তা,অজয়, কোপাই, ব্রহ্মপুত্র, ধলাই, গোমতী, দামোদর, সুর্ণরেখা - - - অসংখ্য নদীকেন্দ্রীক মহুয়াকাব্যের।আর একে একে তার শরীর থেকে উড়তে শুরু করেছে মহুয়ানদীর ঘ্রাণ।নদী তার প্রাণভোমরা, নদী তার গান। নদী তাঁর জীবনবেদ-জীবনের দ্যুতক হয়ে ওঠেছে। নদীই জীবন- নদীই জীবনের অমরপ্রকাশ। তাঁর উপরে নাই।এই অনুষঙ্গেই কবির নদী কবিতাসমগ্রগুলি,তাঁর আত্মা ও জীবননামার আত্মা হয়ে ওঠেছে।নুতন কিছু নয় পুরোনো নয় এ যেন চিরন্তন মানবজীবনবেদ।অন্যভূমি অনেষণের শেষ ও অনন্তনাগ।
এখানে একটি কথা না বললে এ লেখা অপূর্ণ থেকে যাবে।দেও মনু জুরী লঙ্গাই রাতাছড়া আনুয়ারাছড়া সাধারন নদী ও ছড়া নয়।মনু-কথিত যে অতীতে এইনদীর তীরেই ঘনজঙ্গলের গভীরে কোথাও মানুষেরসমাজপতি মনু তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেন।কুমারঘাটের কাছে কাছাড়িছড়ায় প্রাপ্ত শঙ্ক কাঠগড়া ও অন্যান্য পাথরের প্রত্নসামগ্রী থেকে এই অঞ্চলে অতীতে সাধুসন্তদের আগমন ইঙ্গিত করে। কৈলাশহরের অতীত নাম ছিলো অনুমতি হয় ছাম্বুলনগর। এই নগর অতীতে ঊনকোটি পাহাড়ে নিকট্ ছিলো এবং মনুনদী এই তীর্থের কাছ দিয়ে বইতো। অতীতে মহামুনিকপিল এই তীর্থের তপস্যা করেছিলেন বলে রাজমালায় বলা আছে। মনুর তীরে অবস্থিত ঊনকোটিতে ত্রিপুরাব্দ প্রবর্তনকারী রাজা যুঝারফার পঞ্চদশপুরুষ পূর্ববর্তী কুমার নামে খ্যাত শিবভক্ত ত্রিপুরেশ এইতীর্থে শিব উপাসনা করেছিলেন। তাছাড়া ত্রিপুরার রাজ্য ইতিহাস থেকে জানা যায় যে আগরতলা থেকে হাতির পিঠে চড়ে পাবিয়াছড়া হয়ে ঊনকোটি পরিভ্রাজনের সময় 'রাজা কুমার' এই দেওমনু সঙ্গমপারে কোথাও কিছুদিন বিশ্রাম করেছিলেন।আর তিনি তখন নদীর পারে কুমারসভা করতেন। বর্তমান হালাইমুড়া থেকে দেওনদীর পূর্বপারে যেখানে বাঁশঝাড় পরিলক্ষিত হয়, যেখানে পাবিয়াছড়া নদীতে সঙ্গমরচনা করেছে সেখানেই প্রথম দেওয়ের তীরে বসতি স্থাপিত হয়। এখানে অতীতে কুমোরদের তৈরী মাটির তৈজসপত্র ও শাঁকসবজি বোঝাই নৌকো এসে নদীর ঘাটে ভিড়তো।এই থেকে কুকিরা এই স্থান কে বলতো কুমারাঘাট - কালক্রমে লোকমুখে কুমারঘাট নাম ধারন করে।
রাতাছড়া সাধারণ কোন ছড়া নয়। এ রাতাছড়া সাধারণ কোন স্থান নয়। এ হলো ত্রিপুরার রাজন্যবিজরিত রাজধর ছড়া।কথিত যে ১৫৭৭-১৫৮৬ ত্রিপুরার মহারাজা যশোধর মানিক্য আরাকানের মগরাজা মাংফালাঙের (যার মুসলিম উপাধি ছিল সিকান্দার শাহ) আক্রমনে বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষার জন্য রাঙামাটি বা উদয়পুর ছেড়ে বর্তমান কুমারঘাটের কাঞ্চনবাড়ি সন্নিহিত রাতাছড়ার অরন্যে সাময়িক রাজ্যপাঠ স্থাপন করেছিলেন।এই রাতাছড়ায় হতাশাগ্রস্ত রাজা অমরমানিক্য নিজপুত্র রাজধরের হাতে অনিশ্চিত ভবিষ্যতরাজ্যপাঠ সমর্পন করেন।এখানেই রাজধরের অভিষেক হয় রাতাছড়ায় নৌকোভেলায়। এই থেকে এই ছড়াকে বলা হতো রাজধর ছড়া।এই থেকে বহুচর্চিত রাজধরছড়া যা লোকমুখে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে রাতাছড়া নামে পরিচিত।পুত্রের হাতে রাজ্যহস্তান্তর করে হয়তো পুত্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যতহতাশায় আফিম সেবনে রাজা অমর মানিক্য একদিন রাতাছড়ার মনুর সঙ্গমে আত্মহত্যা করেন।মনুনদীর তীরেই রাজার অন্তেষ্টিক্রিয়া হয়।কালের করাল গ্রাসে আজ আর রাজবাড়ি নেই কিন্তু পাওয়া যায় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন - ত্রিপদী থালা ভগ্নইটের স্তুপ ও মৃতশিল্প। এই ঘটনা কবিমনে গভীর রেখাপাত করে। কবির ছবিগ্রাম কবিকে রুধিরাক্ত করে । আর এই ছবিগ্রামের সন্নিকটে একটি হাওরের মাঝবরাবর অজগরের মতো মনুনদীর দিকে সর্পিলাকার বয়ে চলা একটি ছড়ার নাম আনোয়ারাছড়া। এই ছড়াটিকে নিয়ে একটি হৃদয়বিদারক উপাখ্যান লোকমুখে প্রচারিত যার উপাত্ত নিয়েই কবির মর্মন্তুদ প্রতিবাদী স্বরকাব্যগ্রন্থ - আনোয়ারা একটি মেয়ের নাম।উপাত্তটি এরকম - আনোয়ারা বেগম নাম্নী জনৈক সংখ্যালঘু মুসলিম মেয়ে এখানে কোন হিন্দু যুবকের প্রেমে পড়েছিলো।নির্দয়সমাজ তা মেনে নেয়নি। একদিন তিনজন নিরক্ষর যুবককে লেলিয়ে দিয়ে আনুয়ারাকে ধর্ষন করানো হয়।তার সব লাল নীল হয়ে যায়। আর আনুয়ারা দমবন্ধ হতাশায় এই ছড়াজলে আত্মহনন করে।এই হলো আনুয়ারামিথ।
মহাকালের ভালোবাসার আরেক হৃদয়সঙ্গম দেওমনু সঙ্গম।এ সাধারণ সঙ্গম নয়- এই সঙ্গম পথেই একদিন মহাকালের মানব মিলনকঙ্কন শোনা গিয়েছিলো।
। এই সংগমধরেই আজ থেকে প্রায় শোয়া তিনশত বছর আগে বিভিন্ন সময়ে(১৭০৯- ১৫) ত্রিপুরার রাজার সাথে সৌহার্দ্য কামনা করে আসামের মহারাজ সর্গদেব রুদ্রসিংহের রাজদূতদ্বয় রত্নকদলি ও অর্জুনদাশ বৈরাগী ত্রিপুরার রাঙামাটি এসেছিলেন। উদ্দেশ্য মৈত্রী গড়ে তুলা।
তাদের গতিপথ ছিলো এই রকম--উজান আসামের নামজঙ্গের নিকটবর্তী ভাটিয়াপার হতে তারা যাত্রা করে নামগাঙে আসেন।নামগঙ থেকে নৌকোয় চড়ে ৭দিনে রহা। রহায় তিনদিন থেকে ৫দিনে ডেমেরা। সেখান থেকে ১১দিনে কপিলীনদীর অববাহিকা ধরে জেমরা।জেমরা থেকে দিয়ুংনদীর অববাহিকা ধরে খাসপুর। সেখানে ১৯দিন থেকে ছয়দণ্ড পথ চলার পর উদারবন্দ। সেখান থেকে নৌকোয় মুখরানদী পেরিয়ে বরাকে নেমে উজান বেয়ে ৪দিনে লক্ষীপুর।সেখানে দুইদিন থেকে ৫দিনে কাছাড় ত্রিপুরা সীমা রূপিনীনদীমুখ বা রুপিনীপাড়া।সেখানে ১১দিন থেকে ৩দিনে ত্রিপুরারাজ্যের অন্তর্গত রাঙরুঙ । রাঙরুঙে ১২দিন থেকে তারপর তৈজলপাড়া।এখান থেকে ৪দিনে ছারঠাঙনদী পেরিয়ে কুমজঙ্গপাড়া।এই পাড়ার নিকটবর্তী স্থানে ৮দিন কাটিয়ে ৬দিনে
ছাইরাংচুক।এখানে ১২দিন থাকার পর লঙ্গাইনদী পেরিয়ে জম্পুই অতিক্রম করে দেওনদীতে(উত্তর ত্রিপুরার লালজুরী ও কাঞ্চনপুরের মধ্যবর্তী কোন স্থান)নেমে বাঁশের ভেলায় চড়ে নেমে এলেন কুমারঘাট মনুসংগম। সেখানে একরাত কাটিয়ে মনুনদী ধরে উজীয়ে লংতড়াইকে বায়ে রেখে কের্পাই এসে পৌঁছলেন ।সেখান ১৩দিন কাটিয়ে আঠারোমুড়াকে বায়ে রেখে বড়মুড়া হয়ে দুদিনে এলেন ছোটমরিচরাই বড়মরিছরাই পাড়ায়।সেখানে ৪দিন কাটিয়ে ৪দিনে খাকরাই পৌঁছলেন। সেখান থেকে রাজধানী ৪দণ্ডের পথ।সেখান থেকে রত্নমানিক্যের লোক এসে তাঁদের নিয়ে রাখলেন গোমতী নদীর পারে ।
এই দুই রাজদূতদ্বয় উদয়পুর থেকে ১৭১০ খৃ:(জুলাই অগাস্ট ) আষাঢ় মাসে কোন এক সময়ে উদয়পুর থেকে আটদিনের পথ অতিক্রম করে বর্তমান কুমারঘাট মহকুমার কোন এক স্থান দিয়েই কৈলাশহর পৌঁছান।
এখানে উল্লেখ্য যে ছাইরাংচুক বা বর্তমান সাইরেং থেকে তাঁদের যাত্রাপথ কিছুটা কুহেলিকাপূর্ণ।তবে একটা পরিস্কার দিশা পাওয়া যায় গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড:মহম্মদ তাহের অশেষ পরিশ্রম করে কটকিদের গমনপথের একটি মানচিত্র এঁকেছেন। এই মানচিত্র থেকে পরিলক্ষিত হয় তাদের যাত্রাপথে দেওনদীতে যেখানে তাঁরা বাঁশের ভেলায় চড়েন তার নিশানা।
এই নদী সঙ্গম আরেকটি কারনে উল্যেখযোগ্য ।১৮৬১ একদল কুকি ত্রিপুররাজ্যের প্রাচীন রাজধানী উদয়পুর আক্রমন করে। সেখানে ২৫জন সেপাই সমন্বিত একটি সেনানিবাসের সেপাইরা গোলাবারুদ অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পলায়ন করে। কুকিরা তা সংগ্রহ করে উদয়পুর নিকটবর্তী দুখানাগ্রাম একটি বাজার
আক্রমন ও ভষ্মীভূত করে কতকমানুষকে হত্যা করে পার্বত্যচট্টগ্রাম অভিমুখে যাত্রা করে। তারপর চাকমারানী কালিন্দির চেংগী হতে সাতআটজন পুরুষ ও একজন বদাচোগী নাম্নী যুবতীকে অপহরণ করে।তারপর তারা ডুম্বুর ধরে উজীয়ে শর্মানদীর তীরস্থ জঙ্গল পথে লংতরাই পাহাড়ের দক্ষিন পূর্বদিকের পাহাড়শ্রেনী অতিক্রম করে মনুনদীতে নামে।সেখান থেকে মনুনদী ধরে তারা বর্তমান কুমারঘাটের সন্নিকটে দেওমনুসঙ্গমস্থলে উপস্থিত হয়। তারপর সঙ্গম এর পূর্বতীরে একটি প্রাচীন শিমুলগাছতলে পাথিয়ান পূজা সমাপন করে পুরুষগুলিকে বলিপ্রদান করে। আর চাকমাগাবুরী বদাচোগীকে (বদা বা ডিমের মতো চোখ যার) সাইলো কুকি সর্দার সাংবুঙ্গা বিয়ে করে।মাসছয়এক সেই গাবুরী কুকিসর্দারের ঘর করে। সর্দারের জনাকয়েক স্ত্রী ছিল। বদাচোগী ঠিক মতো খেতো না শুধু কান্নাকাটি করতো। তাকে নিয়ে সর্দার ব্যস্ত থাকলে অন্যরানীদের ঈর্ষা ও মায়া হয়। তারা একদিন দেখে মনুনদী ধরে একটি বাঁশের ছরঙ্গা ভেসে যাচ্ছে। তারা গোপনে বদাচোগীকে বেঁধে তাতে ভাসিয়ে দেয়। মনুনদী ধরে যেতে যেতে সমসেরপুর রেলস্টেশনের পাশে কতিপয়লোক একজন মহিলাকে ভেসে যেতে দেখে তাকে তীরে তুলে পরিচর্যা করে। সে নিজের পরিচয় ব্যক্ত করলে সেখান থেকে তাকে ট্রেনে তুলে চাটগাঁ পাঠায়। পরে সে তার পরিবারের সাথে মিলিত হয়।
পরবর্তীসময় ১৮৯০ এর দশকের কোন এক সময় চেঙ্গির চারপাচজন কাঠচৌরাইকারী চাকমা তাদের নেতা জাগুলেগ্গা ও ফাগুলেগ্গা নামে দু'ভাইয়ের নেতৃত্বে একজন ইংরেজ ফরেস্টারকে হত্যা করে।এতে তাদের ধরার জন্য বৃটিশ পুলিশ উঠেপড়ে লাগলে,তারা পালিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের কুমারঘাটের বর্তমান ঠান্ডাঘরের জায়গায় সপরিবারে এসে বসতিস্থাপন করে এবং দেওপার-সন্নিকটস্থ জয়পর্বতের পাদদেশে জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। এখানে অধিকফলন ফলন পরিলক্ষিত করে তারা পুনরায় চাটগাঁয়ে ফিরে গিয়ে আরও স্বজাতীয় আনয়ন করে। এই দলে ছিলো পূর্বে কুকিসর্দার দ্বারা অপহৃত গাবুরী তৎকালে বিবাহিত মহিলা বদাচোগী। সে দেওমনুসংগমে এসে কুকিসর্দার দ্বারা পূজা ও স্বজাতীয় সঙ্গীদের বলিপ্রদত্ত স্থান সেই শিমূলগাছটিকে দেখে চিনতে পারে। সে তখন ভয়ে গাছটিকে দেখলেই মূর্চা যেতো।ফলে সে তার স্বামীকে এই স্থান ত্যাগ করতে বারবার পিড়াপিড়ি করে। অবশেষে এই জায়গা পরিত্যাগ করে তারা মাছমারার বর্তমান লেদ্রাইদেওয়ানস্কুলসংলগ্নস্থানে এসে প্রথম বসতি স্থাপন করে।এখানে উল্লেখ্য যে ইতিপূর্বে ডুম্বুরে ৪০০পরিবার চাকমা বাস করতো। সেখান থেকেও উন্নতফলনের লোভে চাকমারা জয়পর্বতের পাদদেশে আসে। এখান থেকে ধীরে ধীরে তারা শেরমুনটিলা বেয়ে শান্তিপুর মাছমারা দেওয়ানবাড়ি দুইমুইগ্গাআদাম, ভুঁইয়াছড়া শিবনগর মিত্তিঙ্গাছড়া ইত্যাদি পত্তনি গড়ে নদীর তীরবরাবর উজিয়ে বর্তমান কাঞ্চনছড়া আসে ও ১৯১৫এর ভেতরে কাঞ্চনপুর লালজুড়ি ও উজানমাছমারায় ছড়িয়ে পড়ে।তবে তাদের আগে চাটগাঁয়ের বরকল থেকে বোর্দোগজাবংশীয় ওলাতালুকদার কর্নফুলি বা বরগাং ধরে উজীয়ে সাজেক হয়ে কাঞ্চনপুর দেওনদী পারে প্রথম পত্তনী গড়ে,যার নাম ওলাতালুকদারপাড়া(বর্তমান কাঞ্চনপুর মটরস্ট্যান্ড অঞ্চল)।
দেওমনুজুরী নিয়ে এখানে অনেক মিথ প্রচলিত
আছে। পুরাকালে এখানে নাকি কালাপাহাড় বা কালাবাঘা নামে এক রাজা ছিল। রাজার এক উপাস্যদেবতার নাম ছিল দেও।তিনি প্রতিদিন এই নদের জল দিয়ে তার আরাধ্যদেবতা দেওয়ের পূজো দিতেন। এই থেকে এই থেকে নদের নাম হয় নাকি -দেওনদী।আবার চাকমারা বলে কাঞ্চনপুর দেওপারে চাকমারা যখন প্রথম পত্তনি গড়ে তুলে তখন এই নদীতে শীতকালে বন্যশূকর নেমে গর্ত করে পাঁকাল গড়ে তুলতে। এই দেখে তারা এই নদীর নাম দিয়েছিলো দেরগাং। দের মানে শূকরের পাঁকাল।
যতদূর জানা যায়, পুরাকালে লঙ্গাই, জুরী ,দেও ,মনুনদীর উপত্যকাঅঞ্চল ত্রিপুরার রাজাদের অধিকারে ছিলো না।এই অঞ্চল বিশেষত দেওভ্যালি অঞ্চল ছিল হালাম বা কুকিদের মুক্তাঞ্চল।আসামের রাজদূতদ্বয় এইনদীর নাম দিয়েছিলেন- দেওপানি।
দেওমনুজুরী লঙ্গাই ও দেওমনু সঙ্গম নিয়ে একটি প্রাচীন হালাম উপকথা আছে।এই উপকথা থেকে বুঝা যায় দেওভ্যালি অঞ্চল সূদুর অতীতে হালাম জনজাতির মুক্তাঞ্চল ছিল। লোককথাটি এরকম।পুরাকালে লঙ্গাই দেও ,মনু ও জুরী একই গ্রামের যুবক যুবতি ছিল।তাদের পৈতৃকগ্রাম ছিলো পার্বত্য চাঁটগাঁয়ের সন্নিকস্থ বর্তমান জম্পুই ও শাখানপাহাড়ের সংযোজক স্থলে।লঙ্গাই দেও জুরী ছিল ছেলে, মনু ছিল মেয়ে।লঙ্গাই ও দেওয়ের পিতা ছিলেন খুবই গরীব ,আর মনুর পিতা ছিলেন খুবই ধনী।তিনি ছিলেন আবার গায়ের গালিম বা চৌধুরী।তিনি অসম্ভব তন্ত্রমন্ত্র জানতেন।
একই গ্রামের ছেলে মেয়ে ও সমবয়সী হওয়ায় মনু ,দেও, লঙ্গাই, জুরী ও ধলাই একসাথে খেলাধূলা করতে করতে বড়ো হতে থাকে।ক্রমে তারা যৌবনে পদার্পন করলে লঙ্গাই ও দেওয়ের সাথে মনুর গভীর প্রেম ও ভালবাসা গড়ে ওঠে।কিন্তু দুজনের সাথেই মনুর গভীর প্রেমের সম্পর্ক হওয়ার সে কাকে বিয়ে করবে এই নিয়ে দেও ও লঙ্গাই’র মাঝে একসময় চরম বিবাদ বাদে।এই বিবাদের কথা কানাঘুষো হতে হতে মনুর বাবার কানে পৌছলে তিনি খুব রাগান্বিত হন।দেও ও লঙ্গাই খুবই গরীব বলে তিনি তাদের কারোর সাথেই মনুকে বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না,বরং তিনি প্রতিবেশী গ্রামের ধনীবাবার ছেলে ধলাই বা দেলুয়াইয়ের সাথে মনুর বিয়ে ঠিক করলেন। লঙ্গাই ও দেও এই বিয়ে মেনে নিতে পারছিল না।এদিকে মনু ,তার দুজন ভালবাসার মানুষের মাঝে কাকে বিয়ে করবে তাও ঠিক করে উঠতে পারছিলো না।যাইহোক পরে তারা গোপনে পারস্পরিক শলাপরামর্শ করে একটি সমঝোতায় পৌছায়।এই সমঝোতায় জুরী মধ্যস্ততা করে। স্থির হয়,তারা একটি শর্ত পালনের মাধ্যমে এর মিমাংসা করবে।শর্তটি ছিল এই রকম, ধলাইর সাথে বিয়ের দিনের আগের শেষরাতে ,প্রথম মোরগবাঙের সাথে সাথে ,তিনজন আলাদা আলাদা ভাবে ঘর থেকে পালিয়ে উত্তরাভিমুখে যাত্রা করবে।আর যার সাথে প্রভাত হওয়ার আগে প্রথম মনুর সাক্ষাত হবে তাকেই সে মাল্যদান করবে।উভয়ই অবশেষে এই শর্তটি মেনে নেয়।
এই মোতাবেক নির্ধারিত রাতে প্রথম মোরগবাঙের সাথে সাথেই মনু সকলের আগেই উত্তরাভিমুখে যাত্রা করে।এদিকে দেও কোনও রকমে একটি ধূতি আলগোছে কোমড়ে জড়িয়ে তারাহুরো করে যাত্রা করে।লঙ্গাই ছিল বামনবংশীয়,তার ঘুম ভাঙে অনেক দেরিতে।দেরি হওয়ায় সে একটি খাড়াঙে তার কড়লাধূতি ও মক্সকুথাই (কোট) ও অন্যান্য তৈজসপত্রাদি নিয়ে সেটি বহনের জন্য বন্ধু জুরীকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা করে। নিজে একটি সাধারণ বস্ত্র পড়ে দ্রুত উত্তরদিকে চলতে থাকে।তারা উত্তরদিকে চলছে তো চলছে। এদিকে ভোর হবার আগেই মনুর সাথে বর্তমান কুমারঘাটে দেওয়ের সাথে দেখা হয়ে যায়।তাই মনুও শর্তানসারে দেওয়ের গলায় মালা পড়িয়ে দেয়।বিয়ে যখন হচ্ছিল তখন সেখানে ঝোপের আড়ালে ঘুমিয়ে ছিল একটি তিতিরপাখি।সে ঘুম থেকে জেগে উঠে।সে চোখ রগরাতে রগরাতে দেখতে পেল,মনু প্রবল উচ্ছাসে দেওয়ের গলায় বুনোফুলের মালা খুমতাং কী সুন্দর পড়িয়ে দিয়েছে।তাই সে তাদের অজান্তেই এই বিয়ের সাক্ষী হয়ে গেল।
এদিকে লঙ্গাইও জুরীকে সাথে নিয়ে দ্রুত ছুটে চলেছে উত্তর দিকে।ছুটতে ছুটতে ক্লান্তিতে তার পা জড়িয়ে আসছে।এদিকে ভোর হয়ে আসছে,কিন্তু মনুর দেখা নেই।ক্লান্তি আর হতাশায় সহসা সে উপরের দিকে তাকাতেই দেখে ভোরের রাঙা আলো সাঁতরে একটি তিতির পাখি পূর্বমুখি উড়ে যাচ্ছে।সে তিতিরকে হাত নেড়ে ডাকে।তিতিরও এই সাতসকালে হন্তদন্ত হয়ে উত্তরাভিমুখে ছুটে চলা লঙ্গাই জুরীকে দেখে থমকে দাঁড়ায় একটি ব্রুইফাঙের নীচের ডালে।তিতির লঙ্গাইকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করে ,কোথায় এত উদভ্রান্তের মতো ছুটে যাওয়া হচ্ছে হে?তখন সে তিতিরকে বলে,-তুমি কী মনুকে পথে দেখতে পেয়েছো,আমি মনুকে বিয়ে করতে ছুটে চলেছি।তখন তিতির বলে,-মনুর সাথে খানিক্ষন আগে দেওয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।আমি তা সচক্ষে দেখে এসেছি।এই কথা শুনামাত্র লঙ্গাই’র মন খারাপ হয়ে যায়, সে তখন মনের দুঃখে কিছুক্ষণ ব্রুইফাঙের নীচে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। চোখ বেয়ে জল নামে গলগলিয়ে। খানিকক্ষণ জুরীর সাথে শলাপরামর্শ করে এখন করণীয় কর্তব্য কী। অবশেষে লঙ্গাই বাড়ি ফিরে যেতে অনীহা প্রকাশ করে।আর স্থির করে সারাজীবন কুমার্য পালন করবে। এদিকে জুরীও লঙ্গাইকে ছেড়ে বাড়ি ফিরতে অনীহা প্রকাশ করে। বন্ধুবান্ধবীহীন গায়ে ফিরে গেলে তারও মন বসবে তার কোন কাজে। আর মনুর বাবা এসব জানতে পারলে চরম শাস্তি এসে পড়বে তারও ঘাড়ে। জুরী এসবকথা লঙ্গাইর কাছে ব্যক্ত করে লঙ্গাইকে অনুরোধ করে দুজনে মিলে দেওমনু কে খুঁজে বের করবে।তারপর একসাথে বাকী জীবনটা গুজরাণ করবে।কিন্তু লঙ্গাই অসম্ভব মনের দুঃখে জুরীর পরামর্শ গ্রহনে গররাজি হয়। সে জুরীকে বিদায় জানিয়ে মাথা ঘুড়িয়ে আরও উত্তর দিকে চলে যায়।জুরী তখন বন্ধুর উপর রাগ করে জারিজুরী করতে করতে কিছুটা সোজা উত্তরে গিয়ে,তারপর দক্ষিণে দেওমনু কে খুঁজতে খুঁজতে কিছুটা এগিয়ে যায়।তারপর ফের উত্তর দিকে যেতে থাকে।
এদিকে ভোরবেলা মনুর বাড়িতে হূলস্থুল কাণ্ড শুরু হয়েছে।সারাবাড়ি খুঁজেও মনুকে যখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না,তখন দেও লঙ্গাই জুরীর খবর পড়লো।দেখা গেল দেও লঙ্গাই জুরী কেউই বাড়িতে নেই।তারা বেপাত্তা।ব্যাপারটি আর কারোরই বুঝতে অসুবিধা হল না।ইতিমধ্যে ধলাইও বরযাত্রীসহ উপস্থিত মনুর বাড়ি।মনুর বাবা এমন পরিস্থিতিতে হবু জামাতাকে দেখে রাঙা হয়ে উঠলেন লজ্জায়।তিনি একটি ঘরে ঢুকে দরজায় খিল এঁটে একমনে মন্ত্র জপতে লাগলেন মনুকে ফিরিয়ে আনার জন্য।কিন্তু তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হলেন। এদিকে ধলাইও বরযাত্রীসহ অপমানে রাঙা হয়ে মনুর বাবার আদ্যশ্রাদ্ধ করতে করতে বাড়ি ফিরে গেলো।
আরও আছে।এই সঙ্গমের অনতিদূরেই একটি স্থান ধূমাছড়া। বিংশ-শতকের পাঁচের দশকে একটি ঝড়ঝঞ্ঝার রাতে পশ্চিমপাকিস্তান থেকে প্রায় পঞ্চান্নজন যাত্রী নিয়ে আসা একটি স্বর্ণবোঝাই ড্রাকুলা বিমান ধূমাছড়ার উৎসমুখে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়। সকলেই মারা যায়।এই বিমানদূর্ঘটনায়মৃতদেরদলে পাকিস্তানী এক নববিবাহিত তরুন সেনা অফিসার ছিলেন।সবাইকে ওই স্থানেই গনকবর দেওয়া হয়েছিলো। ঘটনা থেকে বছরের ভেতরে সেই সেনাঅফিসারের তরুনী স্ত্রী মৃতস্বামীকে তাঁর ভালোবাসার স্রদ্ধাঞ্জলী দিতে আগরতলা আসে। সেখান থেকে কৈলাশহর। কৈলাশহর থেকে নদীপথে কুমারঘাট মনুসঙ্গম। সেখান থেকে হাতির পিঠে করে ধূমাছড়ার বাজার হয়ে উৎসমুখের কবরস্থানে।হাতির পিঠে করে যেতে যেতে তরুণীর দু'চোখবেয়ে জলের গড়ান বইছিলো।আর কবরে গিয়ে সারাদিন কান্নাজলে ভালোবাসার অঞ্জুলী দিয়েছিল। এরপর থেকে যতদিন বেঁচেছিল,প্রতিবছরই একবার করে সেখানে আসতো ভালবাসার সেই কবিতা নারী।এই দেওমনু সঙ্গম তাই মহাকালের অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে।
এখানে একটা কথা না বললেই নয়। কেন কবির বাড়ি জীবনানন্দ লেন। আমার ধোঁয়াসা লাগে। জীবনানন্দ কী এখানে এসেছিলেন। নাকি জীবনানন্দ কে নিয়ে এখানে সংস্কৃতায়ন। কিন্তু এখানকার নাম তো হালাইমুড়া। জনৈক হালই'র বাড়ি স্মৃতি থেকে হালাইমুড়া। জেনেছি কবি হালাইনাম উঠানোর জন্য অনেক লড়াই করেছেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। আমি মনে করি হালাইনামের মাঝেই তো জীবনানন্দ জেগে আছেন। তবে আলাদা করে জীবনানন্দ লেন কেন?কবি যেখানে আছেন এ এক প্রান্তীয় নদীসংগম।এই নদী সঙ্গম এর নাম হালাইমুড়া হতে আপত্তি কিসে। কিংবা এই ঘটনাবলী থেকে অন্যনামও ভেবে দেখা যেতে পারে।
বর্তমানে এই নদী সংগমেই কবি গোবিন্দের বাড়ি। তাই মহাকাল তাকে রোধিরাক্ত করে। এই রোধিরাক্ত হৃদয়ে তিনি বহতা অন্ত:সলীলা সংগমের মতো এপার-ওপার কাব্যমালাকে সংগমিত করে ছুটে চলেছেন সাগরসংগমের দিকে। সে এক অন্যভূবন যে ভুবন অপরা অধরা।কবির জীবনবেদ-মানুষের জীবনবেদ।নদীর দুই রূপ। এক সংগ্রাহী-আরেক মাতৃরুপিনী ,অন্নপূর্ণা।আমার ধারণা,এই জীবন বেদের উপর দাঁড়িয়েই কবির নদীভাবনা।যা নদীর চিরন্তনীরূপের দিকেই আমাদের অঙ্গুলী নির্দেশ করে। এই নিরিখেই কবি গোবিন্দ ধরের আনোয়ারা নামের মেয়েটি, দেওসমগ্র ও মনুসমগ্র কাব্যত্রয়ীকে আমি দেখছি।
0 Comments