গোবিন্দ ধরের নদী নদীর গোবিন্দ || হারাধন বৈরাগী ৪.দেওমনুসঙ্গমের সাহিত্য চর্চার সেকাল ও একাল
গোবিন্দ ধরের নদী নদীর গোবিন্দ || হারাধন বৈরাগী
৪.দেওমনুসঙ্গমের সাহিত্য চর্চার সেকাল ও একাল
বিংশ-শতকের সাতের দশক থেকে পরিযায়ী কবিরা বিভিন্ন সময়ে কর্মসূত্রে কাঞ্চনপুরে এসেছেন। এসেছেন কথাসাহিত্যিক শ্যামাচরন ত্রিপুরা( হাথাইবুড়াসা) , গল্পকার ননী কর,কবি সেলিম মুস্তাফা, গল্পকার দেবব্রত দেব, কবি সত্যেন্দ্র দেবনাথ,চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং, গল্পকার বলাই দে,মনিকা বড়ুয়া, প্রাবন্ধিক শ্যামলকৃষ্ণ বনিক,কবি বিশ্বজিৎ দেব, কবি চিত্রামল্লিকা চাকমা,কবি শেখর ভট্টাচার্য প্রমুখ।
এই সময় কবিতাপূরুষ সত্যেন্দ্র দেবনাথ কাঞ্চনপুরে ছিলেন। সংসার বিবাগী এই মানুষটি কোথাও বেশীদিন তিতু হতে পারেননি। মূলবাড়ি ছিলো বাংলাদেশের সমসেরনগরে। পারিবারিক কোনো কারনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন এখানে, সেই যৌবনে। বাড়ি ছিল ছিলো বাংলা দেশের সমসের নগরে। একভাই ছিলেন আমেরিকার টেক্সাস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক । বাড়ি ঘরে আর ফিরে যাননি।হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। কাঞ্চনপুর এসে প্রথম পূর্তদপ্তরের অফিসের কাছে বাড়ি করে ফার্মেসি খুলে ডাক্তারি করতে থাকেন। তাকে লোকে জয়বাংলা ডাক্তার বলে ডাকতো। সেখানে কয়েক বছর থেকে কাঞ্চনপুরের বৌদ্ধমন্দির রোডে চলে আসেন। ১৯৮০এর নভেম্বরে আরেক কবিতাপূরুষ সেলিমমুস্তাফা ধর্মনগর থেকে কাঞ্চনপুর এসে গ্রামীন ব্যাংকে প্রথম চাকুরীতে যোগদান করেন।তিনি কাঞ্চনপুর থানার পুকুরের উল্টো দিকে সতীশ চাকমার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। ।১৯৮৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত এখানে ছিলেন।ইতিমধ্যে আগরতলা থেকে এখানে এসে গ্রামীন ব্যাংকে চাকুরিতে যোগদান করেন আরেক প্রতিভাবান যুবক দেবব্রত দেব। এখানে এসে কবি সেলিম মুস্তাফার সাথে একই ঘরে ভাড়াটে উঠেন। ফলে তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।আর সেলিম মুস্তাফার মাধ্যমে আরেক সত্যেন্দ্র দেবনাথের সাথে তার পরিচয় হয়।
মহাকাল বুঝি তাই চেয়েছিল। এখানেই সত্যেন্দ্র আর সেলিমের সাহিত্যচিদাত্মায় অসম্ভব জারিত হোন দেবব্রত । লিখতে লাগলেন কবিতা ও গল্প।আসলে সত্যেন্দ্র দেবনাথ ও সেলিমমুস্তাফার সাথে দেবব্রত দেবের দেখা হওয়াটা ছিল সময়ের অপেক্ষা। এর অন্তরালে সূচিত হয়ে যায় ত্রিপুরার গল্পের এক অন্যভূবনের রচয়িতার সময়ের বালিজলে শাণিত হওয়ার পালা। ।সেলিমের সাথে দেবব্রতের দেখা না হলে আজ ত্রিপুরার গল্পভূবনের ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো।
আর এই ত্রয়ীই সূচনা করলেন কাঞ্চনপুরের এক নুতন অধ্যায়। তারা এখানে প্রথম অক্ষর খোদাইয়ের কাজে হাত লাগালেন। তখন সত্যেন্দ্র দেবনাথের ফার্মেসীর পেছনে একটি কক্ষে প্রতিদিন তাদের সাহিত্যে আড্ডা বসতো। দেশ পত্রিকার কবিতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে সারা দেয়ালে আঁঠা দিয়ে লাগিয়ে সত্যেন্দ্র দেবনাথ তার ফার্মেসির পেছনের রুমটা সাজিয়েছিলেন আড্ডার জন্য ।এই আড্ডায় ধীরে ধীরে যোগ দিতে থাকে এই অঞ্চলের কিছুসংখ্যক স্থানীয় যুবক।দাশু দেবনাথ, চন্দ্রলাল নাথ(চন্দ্র নাথ ছদ্মনামে লিখতেন) বিশ্বজিৎ সাহা, সুজিত সিংহবড়ুয়া(সাক্যসিংহ বড়ুয়া ছদ্মনামে লিখতেন) অতুল নাথ, সীতেশ চৌধুরী, অজিত সাহা, বাবুলবিকাশ বড়ুয়া, কর্ণমনি রিয়াং, কৌশিক ভট্টাচার্য, বিমলেন্দু দেব, গোপেন্দ্র নাথ, জনেশ আয়ন চাকমা সুকুমার চাকমা, মিনা চাকমা প্রমুখ।এই সাহিত্যচক্রের প্রভাবে দেওভ্যালির কাঞ্চনপুর, দশদা ও তৎসংলগ্ন মাছমারা পেঁচারতল নিয়েএকটা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে।
তাদের লেখা ও ত্রিপুরার অন্যান্য অঞ্চলের কবি ও গল্পকারদের লেখা নিয়ে কাঞ্চনপুর থেকে বেরোতে থাকে একে একে ওই সময়ের শক্তিশালী কয়েকটি লিটলম্যাগ-মন্বন্তর, এই বনভূমি, ছায়াপথ।ওই সংখ্যাগুলিতে কবি অরুন বণিক, নকুল রায়, কিশোররঞ্জন দে, সবিনয় দাশ, রীতা ঘোষ প্রমুখ কবি ও গল্পকারদের লেখাও ছাপা হয়ে ছিল। ।সত্যেন্দ্র দেবনাথের সম্পাদনায় এই বনভূমি ও দেবব্রত দেব ও সত্যেন্দ্র দেবনাথের যৌথ সম্পাদনায় মন্বন্তরের বের হয়েছিল কয়েকটি সংখ্যা।এই কাগজগুলি কাঞ্চনপুরে এই প্রথম সাহিত্য সংস্কৃতির মননজমিন কর্ষণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে থাকে। এই আড্ডাখানা ছাত্রযুবাদের মনে অসম্ভব আলোড়ন সৃষ্টি করে।তখন সেলিম মুস্তাফাকে আমরা অতিকবিতা পূরুষ ভাবতাম। সেলিম নাম শুনলেই তাঁর প্রতি আমাদের অসম্ভব awe জাগত।শিক্ষিত যুবকদের মুখে মুখে ফিরতো তার নাম।
সত্যেন্দ্র দেবনাথের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সত্যেন্দ্রদা বার দুয়েক আমাদের বাড়িতেও গিয়েছিলেন।তিনি একবার একটা খাট আমার গ্রামের এক মিস্ত্রির হাতে তৈরী করে এনে ছিলেন। সত্যেন্দ্রদার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল বিশ্বজিৎ সাহার মাধ্যমে। বিশ্বজিতের সাথে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। বিশেষতঃ আমার বাবার সাথে তার বাবা কার্তিক সাহার ঘনিষ্ঠতা ছিল।আর এই থেকেই কাঞ্চনপুর আসলেই বিশ্বজিতের বাড়িতে আসতাম।কবিতা লিখে সত্যেন্দ্রদাকে দেখতাম। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরতে হত বলে তাদের সান্ধ্যআড্ডায় যোগ দিতে পারতাম না। তাই তখন সেলিম মুস্তাফা কিংবা দেবব্রত দেবের সাথে আমার আর দেখা হয়নি।মনে আছে আমার এক বন্ধু ছিল বিমল চাকমা।সে সেলিম মুস্তাফাকে চিনতো।তবে তারও ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না কবির সাথে ।সত্যেন্দ্রদার সাথে পরিচয়ের আগে সেই আমাকে একদিন বলে, কাঞ্চনপুরে একজন বড়মাপের কবি এসেছেন নাম সেলিম মুস্তাফা।বিমল খুবই সাহিত্যপ্রেমী ছিল।ইচ্ছে করলেই লিখতে পারতো। কিন্তু রাজনীতির চোরাস্রোতে হারিয়ে গেল।
এই ত্রয়ী ছোটোদের জন্য তিনটি দেওয়াল পত্রিকাও করেছিলেন। । একটা খুব সুন্দর হওয়াতে কাঞ্চনপুর স্কুল (মর্নিং সেকশন) দেওয়ালে টাঙানোর জন্য নিয়ে যায় । অজিত সাহার ভাইয়ের চায়ের দোকানে ১৫ দিন পর পর আরও দুটো দেয়াল পত্রিকা টাঙানো হত । এমন একটার নাম ছিল দেও ।এটি একবার টানানো হয় কাঞ্চনপুর থানার দক্ষিণ পশ্চিম কোণে পোস্ট অফিসের বারান্দায়।।আর এই 'দেও'য়েই আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছিল। কবিতাটির দুটি লাইন এরকম-'আমি চলেছি কোন মরাপ্রান্তর দিয়ে /জীবনের স্বপ্নগুলো ডুবে যায় অতল গহ্বরে।' সেদিন কি উন্মাদনা আজ ভাষায় প্রকাশ করার নয়।
একবার দেবব্রত দেব সেলিম মুস্তাফা শিবেন্দ্র দাশগুপ্ত মাছমারায় গৌতম চাকমার বাড়িতে গিয়ে সারারাত কাজ করে একটা দেয়াল পত্রিকা লেখেন ।এটার নাম ছিল 'মনোবীজ' । সেটা সমীরণ বড়ুয়ার 'নীলাচল' নামে চায়ের দোকানে টানানো হয়েছিলো। "এই বনভূমি" হাতে লিখে দিতেন শিবেন্দ্র দাশগুপ্ত ।তিনি কাঞ্চনপুর গ্রামীন ব্যাংকের আরেক কর্মচারী। কমলপুর ছিলো তার বাড়ি ।
ব্লক থেকে সাইক্লোতে ছেপে এনে দিতো সত্যেন্দ্র শুক্লবৈদ্য নামে ব্যাঙ্কের একজন পিওন । সমরেশ দেব তখন কাঞ্চনপুর ব্লকের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তিনি ব্লকের সাইক্লোমেশিনে ছাপার সুবিধা দিতেন।বেশ কিছু সংখ্যা বেরিয়েছিল । তবে ছাপা হয়ে বেরোয় একমাত্র ''মন্বন্তর' । ফার্মেসীর বরদাকান্ত শর্মা( শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন ) তাঁদের সংবর্ধনা দেন এই কাগজের জন্য । সেটাই ছিল কাঞ্চনপুর থেকে প্রকাশিত প্রথম কোনো মুদ্রিত কাগজ । এখানে বলা দরকার-কাঞ্চনপুরে ১৯৮১তে প্রথম প্রকাশিত সাহিত্যপত্র হলো-এইবনভূমি।দ্বিতীয় মন্বন্তর। তৃতীয় ছায়াপথ। ।এই থেকে উৎসাহিত হয়ে আরেকটি লিটলম্যাগ 'সমিধ'কাঞ্চনপুরের স্থানীয় দুইযুবক কৌশিক ভট্টাচার্য ও বিমলেন্দু দেব যগ্মভাবে সম্পাদনা করতেন।এই কাগজের সাথে স্থানীয় আরেক যুবক জড়িত ছিল নাম দেবাশীষ নাথ।এটির কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশের পর আর বের হয়নি।
কাঞ্চনপুর কবিতা উপত্যকা ।সেলিম মুস্তাফার দুটি কাব্যগ্রন্থ - ছোরার বদলে একদিন, ইতি জঙ্গল কাহিনী, বিশ্বজিৎ দেবের নিরিবিলি সেন্ট আইটেম, ডাঃ শ্যামলকৃষ্ণ বণিকের আনন্দ বাজারের ডায়েরি ও কথাকার শ্যামল বৈদ্যের - নাইথিং একটি ব্রু মেয়ের নাম এখানকার মাটি ও মানুষকে নিয়েই লেখা।
সাহিত্যের প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা থেকে সেলিম সত্যেন্দ্র দেবব্রত এই ত্রয়ী, কাঞ্চনপুরে মননজমিন কর্ষনের যে সূচনা করেছিলেন তা তাদের অগ্রবর্তী কিংবা তাদের পরবর্তী দু'জন ছাড়া আর কেউ করেননি।তারা সকলেই পরিযায়ী - পরিযায়ীই থেকে গেছেন।
১৯৮৩তে সেলিম চলে গেলেন পানিসাগর দেবব্রত ফিরে গেলেন আগরতলায়। সত্যেন্দ্র আরও কিছুদিন রইলেন। তারপর সত্যেন্দ্রও চলে গেলেন কৈলাশহরে। গ্রামীণ ব্যাংকে এলেন আরেক কবি চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং । তিনি ও সুব্রত সাহা নামে একজন, সত্যেন্দ্র দেবনাথের ছায়াপথ সম্পাদনা করেছিলেন। চন্দ্রকান্তদার সাথে বিশ্বজিৎই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। মাঝেমধ্যে আসতাম তার কাছে।ছায়াপথে লিখতাম।ছায়া পথে ছাপা আমার প্রথম কবিতা 'জলজ'।কবিতাটি এরকম-পাহাড়ের ভেতর আরেক পাহাড়/গন্ধহরিণের পিছু পিছু অসংখ্য ব্যাধ--/।এতে লিখতেন মনিকা বড়ুয়া, সমরেন্দ্র রায়সরকার, অপরাজিতা ঘোষাল, বিশ্বজিৎ সাহা প্রমুখ।বিশ্বজিৎ ছাড়া বাকী তিনজন ছিলেন বহিরাগত। অবশেষে তারাও চলে গেলেন। নির্বাপিত হল এখানে সাহিত্যের আগুন। এই আগুন দাউদাউ জ্বালাবার জন্য কেউ আর রইল না।
আমার বাড়ি ছিল কাঞ্চনপুর থেকে ১২কিমি উত্তরে উজানমাছমারার দূর্গাপুর গ্রামে। আমি ছায়াপথের সম্পাদকের সাথে আড্ডা দিতে বিশ্বজিৎ সাহার ডাকে পায়ে হেঁটে কাঞ্চনপুর আসতাম।তখন এখানে গাড়িরও যথেষ্ট অভাব ছিল।ছায়াপথ ছাপা হত বিশ্বজিতের দাদা সুজিত সাহার ছাপাখানায়।বিশ্বজিৎ ও আমি মাঝেমধ্যে ছাপার হরফগুলি সেটিং করতাম। প্রুফ দেখতাম।হরফে ছেপে ম্যাগাজিন বের করা সহজ কাজ ছিল না। যখন কাজ চলত, আমি উন্মুখ হয়ে থাকতাম কবে ম্যাগ বের হবে।নির্ধারিত দিনে উজানমাছমারা থেকে এসে বিশ্বজিতের সাথে দেখা করতাম।দেখতাম ছাপার কাজ তখনও শেষ হয়নি।এত পথ হেঁটে এসে কাঞ্চনপুর থেকে মনখারাপ করে আবার হেঁটে বাড়ি ফিরে যেতাম।এরকম অনেকবার হতো। কিন্তু যখন ম্যাগ বের হতো সকল দূঃখ ভূলে যেতাম।
নব্বইয়ের দশকে বিশ্বজিৎ সাহার সম্পাদনায় কাঞ্চনপুর থেকে' দেওভ্যালী সংবাদ' ও দশদা থেকে 'দেও' নামে আমার সম্পাদনায় আরও দুটি লিটলম্যাগ প্রকাশিত হয়।দেওভ্যালী সংবাদের সাথে শুরুতে স্থানীয় তিন যুবক দেবাশীষ নাথ, অনুপম নাথ ও রূপক নাথ জড়িত ছিল।আমি তখন দশদাতে চাকরি করতাম।
শূন্য দশকে আলোর ফুলকির মতো দেও এর আরও দুটি সংখ্যা খুব কাঁচা লেখা নিয়েই বের হয়েছিল।
আমি তখন দশদা থেকে কাঞ্চনপুর চলে আসি। তাই কাঞ্চনপুর থেকে দেও এর আরো দুটি সংখ্যা বের করি।এই সংখ্যা দুটির একটির আমন্ত্রিত সম্পাদক ছিলেন উজানমাছমারার আরেক যুবক দেবাশীষ নাথ। তাকে কম্পিউটার দেবাশীষ বলে লোকে চিনতো। কারণ সেই প্রথম কম্পিউটার শিখে এসে কাঞ্চনপুর বাজারে প্রথম সত্য নাথের হোটেলের একটি কক্ষে সিল্কস্ক্রিনে ছাপাখানা খুলে।এই ছাপাখানা থেকেই ওই দুটি সংখ্যা বের হয়।আমি ও স্থানীয় লেখকরা ছাপার পর নিজেরাই বাঁধাইয়ের কাজ করেছি।এই কাগজ গুলিতে তখন লিখেছেন,চন্দ্র লাল নাথ, দেবাশীষ নাথ,রূপক নাথ, অনুপমা নাথ, রোজি নাথ, লাকি চন্দ, দেবাশীষ নাথ,লক্ষণ নাথ,কৃপাময় নাথ, সীতেশ চৌধুরী, বাবুল বিকাশ বড়ুয়া, সজারু (সজারু আমার ছদ্মনাম) প্রমুখ।
২০০৮এর সেপ্টেম্বর এ 'এই বনভূমি'র রজত সংখ্যা বের হয়। সম্পাদনা করি আমি নিজে।এই সংখ্যার উপদেষ্টা মণ্ডলীতে ছিলেন সীতেশ চৌধুরী, বিশ্বজিৎ সাহা ও বিশ্বজিৎ দেব।এটি বিশ্বজিৎ সাহার ছাপাখানা (পূরাতন সরকারী মার্কেট) থেকে বের হয়েছিল। এতে লিখেছিলেন বিশ্বজিৎ দেব, সেলিম মুস্তাফা, সন্তোষ রায়, গোবিন্দ ধর, পদ্মশ্রী মজুমদার, লক্ষন নাথ, সজারু, দেবাশীষ নাথ, কৃপাময় নাথ, নীলিমা দেবনাথ, অরুণ চাকমা, চিত্রামল্লিকা চাকমা, শৈলেন্দ্র শর্মা, অনুপমা নাথ, সীতেশ চৌধুরী বিশ্বজিৎ সাহা, সুজিত চন্দ্র দাস, লালমোহন নাথ, দেবব্রত দেব, কিশোর রঞ্জন দে। এখান থেকেই ২০১১তে- দেওভ্যালি সংবাদের দুটি সংখ্যা বের হয়। এতেও স্থানীয়রাই লেখেন। দীপক নাথ, মৃত্যুঞ্জয় শর্মা, মনিলাল নাথ, বঙ্কিম দেবনাথ প্রমুখ।
২০১৪,২২অক্টোবর দেওমুখ নামে আরেকটি সাহিত্যপত্র প্রকাশিত হয়।এটি কাঞ্চনপুরের একটি ক্লাব নেতাজী ক্রীড়াসংঘের মুখপত্র।আমিও এর সম্পাদক হিসাবে ছিলাম।এর দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২০১৫, ২ ৩ জানুয়ারি। এই সংখ্যাগুলিতে লিখেছিলেন নিরঞ্জন চাকমা, মালবিকা চাকমা, চিত্রামল্লিকা চাকমা, বঙ্কিম দেবনাথ, মনিলাল নাথ, অতুল চন্দ্র নাথ, সুজিত চক্রবর্তী দেবাশীষ রায়, সধাকর নাথ, বিশ্বজিৎ সাহা, মৃত্যুঞ্জয় শর্মাপ্রমুখ।ত্রিপুরা রাজ্য মাতৃভাষা মিশনের মুখপত্র কাঞ্চনশ্রীর প্রথম সংখ্যা ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ এ প্রকাশিত হয়।এটির সম্পাদক ছিলেন অমলকান্তি চন্দ।১৮ফেব্রুয়ারী, ২০১৪ বড়হলদি রাধামাধবপুর হাইস্কুলের হীরকজয়ন্তীপালন উপলক্ষে একটি স্মরণীকা প্রকাশিত হয়। আমি এটিরও সম্পাদক মণ্ডলীতে ছিলাম।
বর্তমানে ত্রিপুরার অন্যতম ছড়াপূরুষ অমলকান্তি চন্দ আছেন আমাদের মাঝে।তিনি ছোটদের কাগজ 'রসমালাই' র সম্পাদক ।এর প্রথম প্রকাশ ২০০৯ এ। ১-১-২০০৯, তিনি কদমতলা (ধর্মনগর) থেকে কর্ম সূত্রে বদলি হয়ে কাঞ্চনপুরে আসেন।কবি ও ছড়াকার অমলকান্তি এখানে এসেই আত্মীয় অমিতাভ সিংহ বড়ুয়ার সাথে মিলে 'রসমালাই' নামে একটি শিশু কাগজ বের করার পরিকল্পনা করেন।আর কিছুদিনের মধ্যেই কাঞ্চনপুরের কৃষিবিভাগের অফিসে দুজনে মিলে এক রাতে ডিটিপি আর প্রুপ দেখা শেষ করেন। পরদিনই দেবাশীষ নাথের ছাপাখানা থেকে এটি ছেপে বের করা হয়। রসমালাইয়ের নামাকরণ করেছিলেন ত্রিপুরার বিখ্যাত ছড়াকার বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী।১২জানুয়ারী ২০২০ প্রকাশিত রসমালাইর নামলিপি করেছেন কবি মিলনকান্তি দও।
রসমালাই এখন শিশু সাহিত্যের কাগজ হিসেবে এপার অপার বাংলায় উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা অর্জন করে চলেছে।কাঞ্চনপুররের মাটি ও মানুষকে নিয়ে লেখা তার বইগুলি হল: ১)আয়না উড়ি -ছড়ার বই।
২)প্রত্ন মুহূর্ত
৩)ভালোবাসার পাথরকুচি -কবিতার বই
৪)চচ্চড়ি -যৌথ ছড়ার বই
৫)ছন্দছড়ায় বিজ্ঞান -বিজ্ঞানের ছড়ার বই। এই বইটি অদ্বৈত পুরস্কার প্রাপ্ত।
অমলকান্তির মূল বাড়ি কমলপুর হলেও জন্ম কাঞ্চনপুরের দশদায়।তার বাবা তখন দশদাতে চাকরি করতেন ।তার মামার বাড়ি দশদায় ও শ্বশুরবাড়ি কাঞ্চনপুরে। ।দেওভ্যালকেই নিজের মাতৃভূমি ভাবেন। ভালোবাসেন।কাঞ্চনপুর সাংস্কৃতিক বিকাশে আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
কাঞ্চনপুর থেকে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হচ্ছে লিটলম্যাগ বনতট। সেপ্টেম্বর ২০১৬ থেকে এর যাত্রা শুরু হয়েছে।নামকরণ করেছেন কবি সেলিম মুস্তাফা।মূলত এটি কবিতার কাগজ হলেও অনুগল্প, প্রবন্ধও ছাপা হয়।
আমাদের মাঝে মধ্যমনি হয়ে আছেন আরেকজন-কথাকার দিব্যেন্দু নাথ।স্থানীয় যুবক। বাড়ি শান্তিপুরে।দোপাতা নামে তার একটি লিটলম্যাগ আছে। ২০১৮ অক্টোবর থেকে এর যাত্রা শুরু হয়েছে। কলেবর ধীরে ধীরে বাড়ছে।ইতিমধ্যে সে কাঞ্চনপুরের জল হাওয়া মাটি ও মানুষ নিয়ে আইলাইনার নামে একটি উপন্যাস লিখেছে। আরো লেখা চলছে।
আমাদের একটি সাহিত্য আড্ডা আছে। এর নাম - দো-বন-রস।এর শুরু হয়েছে ২০১৭এর গোড়ার দিকে।এখানে আছেন কবি রুজি নাথ, কবি চিত্রামল্লিকা চাকমা,মালবিকা চাকমা, সুলেখক নিরঞ্জন চাকমা কবি পঙ্কজ দেবনাথ অনুপমা নাথ,কবি শ্যামল রিয়াং,ছড়াকার গোপেশ সূত্রধর প্রমুখ।
এতদিন বইমেলা ও মাতৃভাষা মিশনের প্রোগ্রাম ও নেতাজী মেলা উপলক্ষে কবিতা পাঠ হয়েছে।সামর্থ্য মতো কবিদের আমন্ত্রণ করা হয়েছে। কখনো জম্পুইর টানে, আমাদের টানে দূর দূর থেকে উড়ে এসেছেন স্বনামধন্য কবি ও কথাকারগন।কবি সন্তোষ রায়,মিলনকান্তি দত্ত, কথাকার শ্যামল বৈদ্য,কবি ও কলামিস্ট তমালশেখর দে, কবি অভিজিৎ চক্রবর্তী বাপ্পা চক্রবর্তী, উমা মজুমদার অপাংশু দেবনাথ,গোবিন্দ ধর, পদ্মশ্রী মজুমদার গৈরিকা ধর, গোপালচন্দ্র দাস, অভীককুমার দে, সঞ্জীব দে, অনুরাগ ভৌমিক, বিপুলকান্তি চক্রবর্তী, রাজেস চন্দ্র দেবনাথ, পার্থ ঘোষ, সুমিতা পালধর,উত্তরবঙ্গের ইসলামপুর থেকেসুশান্ত নন্দী,কলকাতা থেকে কবি হাসমত জালাল,দিল্লি থেকে নাট্যকার ত্বরিৎ মিত্র,ছত্রিশঘর থেকে কথাকার আরতি চন্দ প্রমুখ কাঞ্চনপুরকে ভালোবেসে এখানে বেড়াতে এসেছেন।জম্পুই ঘুরে গেছেন।
সম্প্রতি স্রোত সাহিত্য সংস্কৃতি পরিবার কাঞ্চনপুর শাখা গঠিত হয়েছে ৯/৫/২০১৯ইং
প্রধান উপদেষ্টা :নিরঞ্জন চাকমা
যুগ্ম উপদেষ্টা -হারাধন বৈরাগী
মুখ্য সম্পাদক -অমলকান্তি চন্দ
সভাপতি -রোজী নাথ
সাহিত্য সম্পাদক -অনুপমা নাথ
মুখপত্র সম্পাদক -দিব্যেন্দু নাথ
সংগীত সম্পাদক -অর্পনা বড়ুয়া
নৃত্য সম্পাদক -কৃষ্ণা নাথ
প্রচার সম্পাদক -অভিজিৎ সিংহ বড়ুয়া
কোষাধ্যক্ষ -অমিতাভ সিংহ বড়ুয়া
সদস্য /সদস্যা
গোপেশ সুএধর, পঙ্কজ দেবনাথ, মালবিকা চাকমা, রাজ নাথ, শ্যামল রিয়াং, বিজয়া চাকমা, শিলু চন্দ, সুব্রত দেবনাথ, জয়ব্রত নাথ
১৯শে মে ২০১৯ ' রেইঙ' নামে চাকমা ভাষা ও সাহিত্যের একটি লিটলম্যাগের আন্তর্জাতিক সংখ্যা কাঞ্চনপুর পাবলিক লাইব্রেরীতে প্রকাশিত হয়।অনুষ্ঠানে মোড়ক উন্মোচন করেন কাঞ্চনপুর দ্বাদশমান বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কবি ভারতভূষণ চাকমা , উপস্থিত ছিলেন আগরতলা বীরচন্দ্র স্টেট লাইব্রেরীর সিনিয়র লাইব্রেরীয়ান শ্রী মনোরঞ্জন দেববর্মা,কবি মালবিকা চাকমা, রেইঙ এর সাধারণ সম্পাদক কবি অরুণ চাকমা।
গত ১২ জানুয়ারি ২০২০ অনুষ্ঠিত হয়েছে অনুভাবনায় কাঞ্চনপুর সাহিত্য উৎসব ।কাঞ্চনপুরের তিনটি লিটলম্যাগাজিন দোপাতা, বনতট ও রসমালাইর যৌথ উদ্যোগে।কবিতা উপত্যকা কাঞ্চনপুরে এই নান্দনিক সাহিত্য উৎসবটি সম্পন্ন হয়েছে আনন্দঘন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।
ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের খ্যাতনামা কবি, কথাকার ও ছড়াকারদের নিয়ে এদিন চাঁদের হাট বসে কাঞ্চনপুরের রেভিনিউ ডাকবাংলোর কনফারেন্স হলে।সকাল ১১টা থেকে অনুষ্ঠান শুরু হয়,আর শেষ হয় বিকাল ৪টায়।এই উৎসবে যোগদান করেন এ রাজ্যের কবি ও প্রাবন্ধিক বিমল চক্রবর্তী,গল্পকার দেবব্রত দেব, কবি সেলিম মুস্তাফা, কবি সন্তোষ রায়, কবি সমর চক্রবর্তী,কবি ও লোকগবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধন, কবি অপাংশু দেবনাথ, কবি গোবিন্দ ধর, কবি পদ্মশ্রী মজুমদার, কথাকার জহর দেবনাথ, কবি জ্যোতির্ময় রায়, শ্যামল বৈদ্য প্রমুখ। ।বাংলাদেশ থেকে কবি জাকির আহম্মদ, পশ্চিমবঙ্গ থেকে কবি সুশান্ত নন্দী ও সন্দীপ সাউ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এই উৎসব উপলক্ষ্যে আটজন কবি ও সাহিত্যিককে দোপাতা, বনতট ও রসমালাই সম্মাননা প্রদান করা হয়। এরা হলেন অশোকানন্দ রায়বর্ধন, অপাংশু দেবনাথ, জ্যোতির্ময় রায়, জহর দেবনাথ, পদ্মশ্রী মজুমদার, সুশান্ত নন্দী, জাকির আহম্মদ, শ্যামল বৈদ্য।অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কবি নিশিথ রঞ্জন পাল, কবি সাঁচিরাম মানিক, কবি তমাল শেখর দে, কবি পার্থ ঘোষ, বাপ্পা চক্রবর্তী , কবি অভিজিৎ চক্রবর্তী , কবি অভীক কুমার দে ও তরুণ কথাশিল্পী জয় দেবনাথ , কবি বিজন বোস , তরুণকবি দেবাশীস চৌধুরী, নীলিমা দাশগুপ্ত, রাজীব মজুমদার, সাচিরাম মানিক, পাপিয়া ভৌমিক, মাম্পি চন্দ, রোজি নাথ, রণিতা নাথ, চন্দন পাল, গোপাল চন্দ্র দাস, গৈরিকা ধর প্রমুখ।এই অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন অশোকানন্দ রায়বর্ধন। সঞ্চালক কবি অভীককুমার দে।উদ্বোধক মণ্ডলীতে ছিলেন এপার অপারের খ্যাতনামা কবি সাহিত্যিকগন। ওই দিন সন্ধ্যারাতে স্রোত পরিবার কাঞ্চনপুর শাখার একটি মনজ্ঞ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এর মুখপত্র - খারাঙ প্রকাশিত হয়।
কাঞ্চনপুর সাহিত্য উৎসবে সম্মাননা গ্রহণের পর এই মনজ্ঞ অনুষ্ঠানের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে কবি অপাংশু দেবনাথ বলেন, - জানি সে যোগ্যতা আমার নেই তবু কেউ যখন ভালোবেসে হাতে তুলে দেয় এমন আলোাছটা। ঋণ বেড়ে যায় ভালোবাসার মানুষদের প্রতি।সাহিত্যের প্রতি। সাহিত্য কখনোই বিলাস নয়। আত্মবিলাপও নয় । সাহিত্যের একজন অতি সাধারণ ছাত্র হিসেবে এতোটুকু বুঝি, যে কবিতা আপনাকে অনেক কিছু দেয় সে আপনার থেকে কেড়েও নেয় অনেক কিছুই। কবিতা এক অপূর্ব প্রেমিকা। তার সাথে যার প্রেম হয়, তাকে ভাবা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। সে কোনভাবেই তার পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারে না। সে চায় তার প্রেমিক মানুষটি শুধু তাকে ঘিরে মনোনিবেশ করবে। তার ভাবনায় মগ্ন থাকবে অহোরাত।অথচ এ সময়ে আমরা অনেকেই দু'কলম লিখে নিজেকে কবি বলে ভাবতে থাকি।আমি শুধু ভাবি সমস্ত জীবন ধরে যদি একটি পংক্তি লিখতে পারতাম তাহলে জীবন হয়তো সার্থক হত। আমি সেই পংক্তির জন্য অফুরান সময় জেগে থাকতে রাজি।
সত্যেন্দ্র সেলিম দেবব্রত- এই ত্রয়ী কাঞ্চনপুরে প্রথম সাহিত্যের চারাগাছ রোপণ করে যে আন্দোলন তৈরী করেছিলেন,আজ অণুভাবনায় কাঞ্চনপুর সাহিত্য উৎসব তাদের আন্দোলনকে অন্যমাত্রা এনে দিল।১৯৮৪এর পর প্রায় তিনদশকেরও বেশী সময় ধরে ঘুমিয়ে থাকা উপত্যকাকে যেন ঘুম ভাঙ্গিয়ে নববলে বলিয়া করে তুলেছে। সাহিত্যের পালে নুতন হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ।এই প্রথম ত্রিপুরা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কবি ও কথাকারদের দোপাতা বনতট রসমালাই এক সূত্রে গ্রন্থিত করে কাঞ্চনপুর তথা কবিতা উপত্যকার সাহিত্য চর্চায় একটি নুতন পালক সংযোজন করেছে।আর পাহাড় থেকে সমতলের দিকে ছড়িয়ে পড়ছে ঘন্টাপাখির ঘন্টার শব্দ।
0 Comments