মনুখণ্ড সিরিজ || গোবিন্দ ধর
মনুখণ্ড সিরিজ
গোবিন্দ ধর
আলোচনা
হারাধন বৈরাগী
কথাপৃষ্টার ঘ্রাণ
মিলনকান্তি দত্ত
--------------------------------
মনুসমগ্র
-------------------------------------
উৎ|স|র্গ :১
সেলিনা হোসেন
রবীন্দ্র গুহ
অমিতাভ দেবচৌধুরী
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
অপাংশু দেবনাথ
এই পাঁচজন নদীমানুষ-কে
--------------------------------------
উ|ৎস|র্গ:২
যাপিত প্রেম,অপ্রেমের যোনিচক্রস্মৃতি !
-------------------------------------
উৎ|স|র্গ:৩
যে নদীর রূপ ঝরে জলের রেখায়
আমি তাকে ভালোবেসে
রূপকথা ডাকি।
---------------------------------------
উৎ|স|র্গ:৪
জলে জলে লেখা হয়
জলীয় কথা,জলে জলে
গুলে যায় জলজ-গণিত।
------------------------------------
কথাপৃষ্টা :১
মনুনদী ও কবি গোবিন্দ ধরকে আলাদা করে দেখা যায় না। কবির জীবন থেকে মনুনদী কে আলাদা করে দেখলে কমলা আর সুন্দিবনহীন জম্পুই পাহাড়ি মনে হবে।গোবিন্দ ও মনুনদী যেন একই মঞ্চের নায়ক নায়িকা। তাই মনুহীন গোবিন্দকে কল্পনা করা বাতুলতামাত্র।
বাংলা সাহিত্যের সন্তকবি মিলনকান্তি দত্ত গোবিন্দ ধরের মনুখণ্ড আলোকপাত করেছেন।তাঁর আলোচনায় মনুখণ্ডের আত্মার আলোছায়া বা ধরাঅধরা ধরা পড়েছে।
----------------------------------
কথাপৃষ্টা ঘ্রাণ :২
মিলনকান্তি দত্ত
কবির নদীচর্যা
নদীপদ। পদাবলিকার একজন জলজমানুষ।
একান্তই একজন কবির নদীচর্যা। মনুখণ্ড।
এ নদী একটি ভূগোলের জলপঙক্তি যদিও,
এ নদী তির তির বয়ে যাওয়া এক বিসর্পিলা
নীরাবতী যদিও,তবু বলতে দ্বিধা নেই_মূলত
এ কবির মনোনদী,কবির আত্মপরিজনলিপিই শুধুমাত্র নয়, বরং
কবির আত্মার গহীন গাঙ,প্রতিটি জলডুবের
ভেতরে যার সাশ্রু অক্ষরমালা অনেক অনেক
যাপিত প্রেম,অপ্রেমের যোনিচক্রস্মৃতি !
-------------------------------------
আলোচনা:
এই উৎসর্গ থেকেই কবি মনুখণ্ড কাব্যের অন্তরজল পাঠককে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন।এখানে মনুকে নারী হিসেবে দেখা হয়েছে। "রূপকথা ডাকি" -এই শব্দের ঝংকার থেকে আমাদের মনুনাম্নী কোন মোহময়ী নারীর অসম্ভব রূপলাবন্যের দিকেই পাঠকের দৃষ্টি চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যায়।
-----------------------
কথাভূমি
একটি নদী মনুনদী
একটি নদী দেও।
একটি নদী মনুনদী
একটি নদী দেও।
মনুর সাথে ছোটবেলা
উথাল পাতাল সেও।
মনুর সাথে ছোটবেলা
উথাল পাতাল সেও।
----------------------------------
এখানে কাব্যটির কথাভূমি আমাদের চুম্বকের মতো আকর্ষন করে।"উথালপাতাল"- পাঠককে এক প্রেমিক প্রেমিকার বয়:সন্দিবেলার মুকুলিত ভালোবাসার ধরাঅধরা কলবলের দিকেই নিয়ে যায়।এখানে দেও মনু যেন ধরাধামের মানবমানবী।এখানে "সেও"শব্দ থেকে মনু দেও ছাড়া আরেকজন প্রেমিকের উপস্থিতি পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না। আর এই আরেক প্রেমিক অবশ্যই কবি নিজে। তিনি এই নদী নিয়ে হালাম উপকথা লঙ্গাই যেন।যার মনুকে নিয়ে ঘরকরার সাধপূরন হয়নি। যার আযৌবন সাথী মনু পুতুল নিয়ে ঘরকন্যা থেকে ক্রমশ ষোড়শকলা রূপলাবন্যে প্রস্ফুটিত হওয়া অবধি। ভাটি বয়সে এসে রূপকথার মতো সেইসব দিন অবলোকন করেন তিনি। আজও যে তৃষ্ণা মেটে না। আর মিটবেও না কোনদিন। অতৃপ্তি নিয়েই ছেড়ে যাবেন তিনি ধরাধাম- জলজ মনুর সন্তান।
---------------------------------
এক.
মনুর জলে জলডুব ডুব
আর চরে মহিষ চরাতে চরাতে
কখন বয়স বুড়িয়ে গেলো
তিরতির জল জানলো না।
চিকচিক বালুতে বানানো ঘর
কতবার খেলাচ্ছলে ভেঙেছি গড়েছি
বিকেলের মরা রোদ জলে এসে
মিশে গেলো নদী কী আর জানে?
মনুর সাথে কবির হাঁটুর বয়সের সখ্যতা।বালুপ্রেম। জলপ্রেম।জলখেলি।বাল্যসখি মনু।এই বয়স সময় জানেনা। শুধু জানে গায়ে গায়ে থাকা।উদ্দামতা।মহিষ চড়ানোশ্রম শ্রম মনে হয়না।ঘরভাঙাগড়ার যে ধৈর্য তা বুঝে না। কখন সকাল গড়িয়ে বিকেল নেমে আসে বুঝা যায় না।সখা-সখির মেলবন্ধনে কখনও ক্লান্তি আসে না। আসলে ধৈর্য্য কিংবা ক্লান্তির সকল সংজ্ঞা তখন অজানা।মনু কিংবা কবি জানেন না কখন সেই জীবনখণ্ড হারিয়ে গেল।
দুই.
মনুর চিকন বালির মিহিদানায় এঁকেছি প্রিয়মুখ
দক্ষিণের বাতাস এসে ভেঙ্গেছে সে সকল দিন।
কনকনে শীতরোদে সিগ্ধ তো তুমিই করেছো
তির তির তির তির মনুজল এখনও প্রবাহিত।
আমি অনেক দূরে দেওবাহিত একখন্ড
খাস জমির স্বঘোষিত জমিদার।
কবির শৈশব পাঠকের চোখে লাফ দিয়ে ওঠে।নদীর চিকন বালিতে যা এঁকেছেন তা মনের গহীন খেয়ালে।একটা ভালোবাসার প্রতিযোগীতা কিংবা নিজেকে ভালবাসার মানুষের কাছে তুলে ধরার এষনা থেকে নিজের সেরাটি ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু অবশেষে দক্ষিনে বাতাস এসে সব লন্ডভন্ড করে।ছোট থেকেই বায়ে চলা বা সূর্যেমুখি কবির স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেয়। এই বাতাস কবির কাছে প্রথাগত কালের বাতাস। এ বাতাসের জন্যই কবি তাঁর স্বপ্নজীবন শোষনহীন দেশহীন সমাজ গঠন করতে গিয়ে নি:স্ব রিক্ত।যখনই শূন্যতায় ভোগছেন তখন মনুনাম্নী সখিই যেন তাঁকে দিয়েছে স্নিগ্ধশীতল বাতাস।খাসজমি, স্বঘোষিত জমিদার - কবির স্থিতিহীনতা ও ভূমিহীন শেকরহীনতার দ্যোতক হয়ে ওঠে।
তিন.
রোজ রাতে নদী আসে আমার শিয়রের নিকট।
মাথায় হাত রাখে আমার অসুখ নিয়ে চলে যায়।
নদীর নিকট চিরকাল ঋণপত্র লিখে ভাসাই
আমাকে ঋণাত্মক রেখে নদী আনবাড়ি যায়।
নদীর সরলতার কাছে কাশফুল হয়ে ফুটি
শরতের নিকট বন্ধক রাখি সমস্ত শীত।
আমিই আমার নিকট পরাজিত পারিজাত
কাশের ডগায় ভিজে কত শিশির টুপটাপ রাত।
কবির বয়সবাড়ার সাথে সাথে জীবনসংগ্রাম বেড়ে যায়। নদীকবি মানসনদীর কাছে সান্তনা চান। কিংবা রূপকার্থে তিনি বাল্যসখি মনুকে সেই দু:সময়ে অন্তরে অনুভব করেন আর সান্তনা লাভ করেন কিংবা হৃদি মনু এসে স্বপ্নচরে দেখা দেয়। তাঁর শিয়রে হাত বুলায় প্রেমিকার মতো।এই নদীই তার জীবনের ভাঙ্গাগড়ার সাথী সুখেদুখে তাঁর জলজ জীবন। তাই কবি ভাবেন তিনি নদীর কাছে চিরঋনী।তাঁকে সঙ্গীনী করে ঋনশোধের বাঞ্ছা থাকলেও জীবনে তা পূরণ হয় না। কারন নদীর সাথে তার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। নদী আনবাড়ি চলেগেছে।এই বিচ্ছেদ সমাজের কাছে দায়বদ্ধতা থেকে । কিন্তু অন্তরে এই নদী চিকচিক বালিস্রোতের মতোই এখনও বহতা।তাই কবির সখেদ উচ্চার - নদীর সরলতার কাছে তিনি মরসুমী কাশফুল এখন। কবির জীবনে এখন শীতগ্রীষ্ম নেই। এর জন্য কাউকে দোষারোপ করেন না।আর কাশফুলরূপী সংগ্রামশীল কবির মাথা ছাদহীন-ঘাতপ্রতিঘাত ঢিলের মতো পড়ছে। এ পাঠককে বাস্তব্যসত্যের মুখোমুখি করে।
পাঁচ.
এই মনুতেই সাঁতরে ভরা বর্ষায় পেরিয়েছি পাড়।
চরে মহিষ চরিয়ে আবার এসেছি ঘরে।
এই জল ঘোলাটে হলেও
আমার আরোগ্যে একটু উপশম তুমি।
জলজ কবি নদীজলের সন্তান।স্কুলবেলায় জীবনসংগ্রামে তাতাল কবি মনুনদী সাঁতরে মহিষ চড়াতেন।নদীজলে একাকার হয়ে এতকাল ধরে ঘোলাটে করলেও এই ঘোলাজলই এখনও কবির অসুখের উপশম। কবি কাজের ব্যস্ততায় যখন ক্লান্ত হয়ে উঠেন তখন এইনদীর সাথে জড়িয়ে থাকা বিগতদিনের স্বর্ণাভদিনলিপির নষ্টালজিয়াই তাঁকে আরোগ্য করে। কবি আয়ুধ লাভ করেন।
ছয়.
বাড়ির দক্ষিণে প্রবাহিত মনু।
তার পাড়ে অনেক স্মৃতি।
পটে আঁকা বাবার শ্মশান
বুকে জমানো মায়ের চিতার আগুন।
কাকার চিতা দাউ দাউ জ্বলছে।
এই সব মনুখন্ডে লিখে রাখি জমানো
আগুনপাখির উড়াল।
এই পংক্তি গুলি পাঠককে রুধিরাক্ত করে। সেই দক্ষিণ!দক্ষিনের ঘূর্নাবর্তে কবি সেই ছোটবেলা থেকেই দিশেহারা।এই দক্ষিন যেনো কবির সুস্থিতমানবসমাজ গঠনের একটি তুল্য কম্পাসবিন্দু। নদীপাড়ের স্বপ্ন কবির কাছে আজ শুধুই স্মৃতি সরূপ জেগে আছে।কবি পিতার স্বরলিপির ও কম্পাসবিন্দু ছিলো এই দক্ষিন।স্মৃতি আগুনপাখির মতো দাউদাউ উড়ছে বুকের ভেতর।বাবা-মায়ের চিতা,কাকার মতো স্বজনের চিতা। এইসব নিয়েই তাঁর জীবনবেদ কবির মনুখণ্ড।
সাত.
তোষের আগুন জ্বলে বুকের কার্নিশে।
নদী দেখলেই জ্বলে আবার মায়ের চিতা
বাবার শ্মশান।
কাকার চিতা।
ঠাকুরদার চিতা
ঠাকুমার শ্মশান।
আমাদের পূর্বপুরুষ এই মনুতেই তিরতির স্রোত।
ক্রমশ কল্লোল তুলে বহমান আমারই আত্মা।
কবি মনুর কাছ থেকে কার্যকারনে আড়ালে আসতে বাধ্য হয়েছেন। যখনই একটু ফুরসত পান আড়াল সরিয়ে নেন তখনই দক্ষিনের বাতাসে হারানো মা-বাবা-স্বজনের মুখ ও সংগ্রামী জীবন ভেসে ওঠে দাউদাউ আগুনের মতো। আর তাঁদের পারিবারিক তিরতির বেঁচে থাকা ভেসে ওঠে। কবি রুধিরাক্ত হোন।
আট.
মনুর প্রতিটি জলবিয়োগ আমার আত্মার রক্তজল।
মনুর পাড়ে কবিস্বজনদের ঋনাত্বক দিনলিপি,জীবনের যতো বিয়োগ কিংবা নদীভাঙন,নদীর সাথে বিদায়, কবির আয়ুধ ক্ষয় - যা বিয়োগাত্মক সবকিছুই কবিআত্মার ক্ষারপানি-রক্তজল।পাঠককে বিমর্ষ করে তুলে।
নয়.
মনুখন্ডে লিখি জলজমুখ
আমার সকল আত্মপরিজনলিপি।
তুমিও জলের মতো মিশে গেলে দোঁয়াশবালিকা।
কবি লেখেন তার মনুপারে ক্ষরিত যাপন লিপি-কবির জলজ জীবনমুখলিপি। তিনি লেখেন তাঁর স্বজনের দেশভাগের কারনে মনু পারে তিতু হওয়া ছিন্নমূল বিধিলিপি।আর তিনি আক্ষেপ করেন ছেলেবেলার দোঁয়াস বা স্বপ্নভাঙ্গা কবি-তুমিও জলের মতো মিশেগেলে দোঁয়াস বালিকা। এখানে জলজনদীও যেনো জলেই গুলে গেছে। পাঠককে বিমর্ষ করে তুলে।
দশ.
নাইতে গিয়ে এঁকেছি বালুকাবেলা
প্রতিটি জলডুবে মা এসে কানে কানে বলেন
দিকশূন্য পুরের সেই জলদেবতার গল্প।
আমি একটি কোঠারই কামনা করেছি।
জলদেবী আজও আমার আয়রন কোঠার ফিরিয়ে দেননি।
কবির মায়ের কথা মনে পড়ে তাঁর আযৌবন বেঁচে থাকার কঠিন লড়াইয়ে আয়ুধ হয়তো কবি পেতেন। মাতা হয়তো তাকে বলতেন শিক্ষার কথা। অথবা বরসা দিতেন একদিন তাঁর অনটন ঘুচবে।বলতেন সৎপথে থাকলে একদিন কাঠুরিয়ার মতো দেশভাগের বলি সম্পদ তিনি লাভ করবেন। কিন্তু জীবনসংগ্রামে টিকে থাকার জন্য সেই বজ্রকঠিন কুঠার আজও জলদেবী বা ভাগ্যদেবী তাঁকে ফিরিয়ে দেননি। তাঁর দিন ফিরেনি। আজও তিনি গড্ডালিকা প্রবাহেই ছুটছেন। কোথায় যাচ্ছেন জানেন না কিন্তু বিশ্বাস যাবেন একদিন সেই মানবসঙ্গমে।
এগারো.
জল ডুব ডুব খেলতে খেলতে
আমার পরিজনের শরীরের গন্ধ এসে আমাকে সজাগ করেন।
আমি জলে জলে গুলে যাই
দোয়াশমাটির মতো।
কবি গোবিন্দের নদী দুইমুখি শাঁখামুটি যেন।এ বাস্তব্য সত্যও।ভাঙ্গন ও গড়ন। মুদ্রার দুই পিঠ।তাই আজীবন জলজকবি যখনই জলডুবু ডুবু তখনই পরিজনের গেঁয়োগন্ধ ভেসে আসে। তখন তিনি গলগলিয়ে কাদার মতো গুলে যান জলে।ছোটবেলার ফলন্ত দোঁয়াসমাটির মতো-যে মাটিতে তিনি বেড়ে উঠেছেন।
বারো.
মনুনদীর কাছেই খনকার গাঁও
মৌলভীবাজার জেলার মিঞারপাড়া
আমার ঠাকুরদা দেবেন্দ্রনাথ
তাঁর বাবা রতিরামসহ বাস করতেন।
আমার বাবা তাঁর বাবার হাত ধরে
চাতলার বর্ডার ক্রস করে
বড় রায়টের সময় রাতাছড়া আসেন।
রাতাছড়া আর খনকারগাঁও দুটো গ্রামের
একটি নদী:মনুনদী।
মনু আমার বাবার নদী
মনু আমার ঠাকুরদার নদী
মনু আমার ঠাকুরদার বাবার নদী
মনু আমাদের বংশের বংশনদী।
অথচ মনুকে ছেড়ে আমি ছিন্নমূল
দেওনদীর সঙ্গম অববাহিকা হালাইমুড়ায় আছি
ঠিক যেখানে দেওনদী খেয়ে নিয়েছে মনু।
মনুর জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আমার শরীর।
আমার ছোটবেলার নদী মনু
আমার সাঁতার শেখার নদী মনু
আমার মহিষ চরানোর চর মনু
আমার জলডুব ডুব লাইখেলার নদী মনু
আমার প্রথম প্রতিশ্রুতির নদী মনু
আমার বাবার শরীর পুড়াছাই ভাসিয়ে নিলো যে নদী সে মনু
আমার মায়ের শরীর পুড়াছাই ভাসিয়ে নিলো যে নদী সে মনু
মনু আমার শরীরে লেপ্টে থাকা একটি জলোৎচ্ছাস।
মনুর জল বেয়ে পানসীনৌকো স্রোত ডিঙ্গিয়ে উজান যেতে আমি দেখেছি।
মনুর জল ভেঙ্গে পালতোলানৌকো উজান যেতে আমি দেখেছি।
মনুর স্রোত তিরতির মাড়িয়ে গুণ টানা নৌকো উজান যেতে আমি দেখেছি।
মনুর সাথে আমার জীবনের গল্প লেগে আছে।
মনুর সাথে আমার বাবার গল্প লেগে আছে।
মনুর সাথে আমার ঠাকুরদার গল্প লেগে আছে।
মনুর সাথে আমার পাঁচ পুরুষের গল্প জমে আছে।
ঠাকুরদা বলতেন তাঁরও পাঁচ পুরুষ মনুতেই স্নান করে সাঁতার শিখতেন।
মনু আমার সংস্কৃতি রাধারমণের ধামাইল।
মনু আমার জারি সারি লালন চারণ বাউল আর
শাহ আব্দুল করিমের মরমীয়া ভাটিয়ালি সুর।
মনু আমার কবিতা গান
আমাদের হা ভাতের সংসারে এক হাঁড়ি পিপাসার জল।
জমিনের এঁটেলমাটি শরীর থেকে মনুতেই মিশিয়ে
আমরা পাঁচবোন তিন ভাই সিগ্ধ হয়ে খেটেখুটে বড় হয়েছি।
মনুর বন্যায় কতবার আমাদের ভিটা ছাড়া হতে হয়েছে।
মনুর তীর ভেঙ্গে ভেঙ্গে আমাদের বাড়ি ছুঁইছুঁই
মনু আমাদের জীবনের অন্যরকম গল্পের নাম।
মনুর কাছেই জীবনের সবুজ মেখে পৃথিবী দেখি
মানুষকে বড় সবুজ দেখি আখপাতার মতো
অথচ মনুর সবুজ আখ পাতার ধারালো কিরিচ
সারাটা জীবন ধরে রক্তই ঝরিয়ে গেলো
মনুর জল সে কি আর জানে!
ছোটবেলা ঝিল থেকে জেতা কই লাইন দিয়ে
মনুতেই মিশে যেতো।
শিং মাগুর টেংরা একটু বৃষ্টি হলেই ঝিল ছেড়ে
নালায় নেমে সাঁতার কাটতো। সামনেই মনু।
মাছগুলো মনুতেই চলে যেতো।
আমার বুকের ভেতরেও শিং মাছ সেই থেকে সারাক্ষণ ঘা মেরে সাঁতরায়।
কবির এই কবিতাটি বলা যেতে পারে মনুসমগ্রের কবিতা সিরিজের আত্মা।কবি ও মনুকন্যার হৃদিজল।কবিব্যক্ত অব্যক্ত কবিওমনুর শরীর।একটি বাস্তুতান্ত্রিক কালিতুলির বিন্যাস। এখানে কবির পূর্বজ কবি ও উত্তরজ একই গাঙের মাঝি। একই জল বাতাস কাদামাটির পাঁকে চর্চিত।সকলের একই নাম গোবিন্দ।একই রক্তের গান। মনু তাঁদের বংশী-বংশদণ্ডি।মনু স্বপ্ন প্রত্যাশা নিরাশা।মনু ইহকাল পরকাল।মনু বাঁচাবাড়া-স্বপ্ন দু:স্বপ্ন।।মনু শ্বাস প্রশ্বাস ।মনু রাধারমন ও শাহজালাল।বাউল তারা।একটি জীবনধারা। বংশের একই নদী। তাই ছিন্নমূল হয়ে উজানে এসে মূলউৎপাটনে যন্ত্রণা কবিকে জলোচ্ছ্বাসের মতো বিদ্ধ করে।দেওলানদী দেও খেয়ে নিয়েছে মনুর বুক। কবির জীবন তছনছ করে দিয়েছে।এর অবসান চান কবি।মানবসঙ্গমের অস্ত্রে তিনি দেওলাজীবন উৎপাটিত করতে চান।
তেরো.
নদীই একমাত্র সঠিক বংশ পরিচয়।
আমরা হয় নদীর উজান ধরে এগিয়ে যাই।
না হয় নামতে থাকি ভাটির টানে।
নদী মানুষের বংশলতিকা।
নদীই মানুষকে ঘর ছাড়া করে
বাউল করে লালন করে
রাধারমণ করে।
নদী গান।নদী আমার বংশরেখা।
একটি সহজ সরল মানচিত্র।
কবির জীবনদর্শন নদীদর্শন একই শিপিঙের ডালে বাঁধা।তাই তাঁরনদীদর্শনের আলোকে মানুষের জীবনদর্শন মেলাতে চান। বাউলের মতো সহজ সরল মানচিত্র আঁকেন। লক্ষ্য সেই মানব কল্যান। নদী তাঁকে ভালোবাসে নদীই তাঁকে ত্যাগ করে। নিজেই নিজের সাথে আঁকিবুকি কাটেন।নিজেই উত্তরন অবতরনের পথ দেখেন। হোঁচট
খান কিছু পেছনে আসেন আবার এগিয়ে যান।দ্বান্দ্বিক সময়ে দ্বন্দ্বকেই বেঁচে নেন।
চৌদ্দ
আমার নদী ছিলো তিরতির স্রোতস্বিনী।
স্কুল কামাই করে ভর দুপুরে ঢেউ নিয়ে আসতো
আমার পাড় ভেঙে ভেঙে তার কি রূপ ঝরিয়ে
বিকেলে চলে যেতো মরাগাঙ হয়ে বিমর্ষ।
তার বিনুনির সাপ দেখি হিসহিস করে।
এখানে কবির মনুনদীর দিকেই পাঠকের নজড় পড়ে। কবি ছোটবেলায় মনুর রূপের টানে স্কুল কামাই করতেন হয় তো। বিকেল নেমে এলে বাড়ি ফিরতেন। রূপমুগ্ধ কবির রূপতৃষা মিঠতো না।নদীর রূপ হরিনীর মতো চকিত বিভঙ্গে ক্ষরণ ঘটাতো কবিহৃদয়ে। রূপতৃষা না মেটা কবি বিমর্ষচিত্তে ঘরে ফিরতেন।তখন তিনি যেন দেখতেন নদীর আরেক রূপ যে রূপ সংহারী হিসহিস করে ওঠা শঙ্কিনীর মতো।
পনেরো
খুচরো হতে হতে শূণ্য তোরঙ্গ।
ভেতরে শুধুই শূণ্যতা।
বৃক্ষের কাছে নতজানু জীবন বাঁচার বাতাস
না পেলে মৃত্যু কেবল ট্রামের মতো আসে।
এতবার করেছি সমর্পন এই শূণ্যতা নাও।
কলসের জল রেখে কে আর জল আনতে যাবে নদীর নাব্যতায়।
সকল প্রাপ্তিযোগ পেরিয়ে একদিন
সমস্তনদীই মিশে যায় সাগর সঙ্গমে।
বেদনার কোন পরিভাষা নাই
তুমি তাতে প্রলেপ না দিলে বাড়ে জলাতঙ্ক।
এখানে কবির ব্যক্তিগত হাহাকার প্রকাশের মুন্সিয়ানায় পাঠকের হাহাকারে উত্তীর্ণ হয়।ক্রমশ কবির বয়সবাড়ার সাথে সাথে কর্কটক্রান্তিসময়ের সৌরশলাকায় কবি বিদ্ধ হতে হতে পন্যে পরিণত হয়ে চলেছেন।মানবিক বোধের কাছে নতজানু হয়ে সংসারের ঘানি টানেন।অসচ্ছল পারিবারিক দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যেতে পারেনা। নতুবা ফুলের মতো সরল সংসার ধ্বংস হয়ে যাবে। এমন কর্কটসময়ে দিশেহারা কবির ভাড়ার শূন্যতায় ভরা।রূপমুগ্ধ কবি নদীরসৌন্দর্যমোহরহীন হারানো প্রেয়সীনদীর কাছে ব্যার্থ প্রেমিকের মতো শুধু আবদার রাখেন, মনু তাঁর সংগ্রামক্লান্ত শূন্যতা যেন গ্রহন করেন। পরক্ষনেই আক্ষেপ করে বলেন যার জীবন জলজ জলদু:খে কানায় কানায় পূর্ণ,আগবাড়িয়ে নদীর কাছে গিয়ে জল আনবে কেন?পরক্ষনেই তিনি উচ্চারণ করেন উপনিষদীয় উচ্চার- সকল প্রাপ্তিযোগ পেরিয়ে সবনদীই একদিন সাগরসঙ্গমে যায়। এখানে কবি ও নদীকে কাঁটাছেড়া যায় না।কবি ইঙ্গিত করেন জলজ যার জীবন, জীবন যার জলজবেদনার-তাতে যদি তাঁর বুকের লাভডাবপ্রেয়সী শান্তনা না দেয় - তবে জলাতঙ্ক যাবে না।জীবনের ঘূর্ণীবাত্যায় জল জীবনের দ্যুতক হলেও কবি আতংকিত হয়ে ওঠেন।
ষোল
স্রোত বইছে খুব উথাল পাতাল বেগে
বর্ষার মনু কী সাংঘাতিক তির তির।
মনু এত জল তার বুকে নিয়ে
চলছে তো চলছেই
তার সকল বেগ বৃষ্টির বাৎসায়ন।
আমিও তো এমন প্রেমিক চাই
নদী আর জল মিশে যেমন স্রোতস্বী।
একা আমি দরজায় ডোরবেল বাজিয়ে চলি।
বহুদিন বৃষ্টি নেই খাঁ খাঁ ভূমিক্ষেত।
একা, আমি আমার মতো বিষলালায়
নিজেই নিজের সাথে সমকাম
পুষে রাখি সমান মর্যাদায়।
তোমার গোপন নদী গোপন মানচিত্র আঁকে।
নদীই কবি ।কবিই নদী।বর্ষায় নদীর উথালপাতাল- জলক্লান্ত কবির উথালপাতালের সমার্থক।মনুর মতো গোবিন্দ নদীও বুকে ভরাজলোচ্ছাস নিয়ে ছুটে চলে বেগবতী কামিনীর মতো।মনুর মতো গোবিন্দ নদীর ভেতর বয়ে চলা উত্তালবেগ বাৎসায়নকামকলার যোনীপদ্মক্ষরণের মতো।নদীর মতো কবিনদীও এমন পাগলীঝুরা প্রেমাস্পদ চান।অনেকদিন ধরে বৃষ্টিহীন ভূমি। প্রেমহীন জীবন- একাএকা সমকামের মতো হৃদয় পুষে আছেন ।আসলে মানুষকে মানুষের মতো ভালবাসার কামনাই কবি ধরে রাখেন বুকে। কিন্তু কিছু মানুষ বিষলালা বুকে নিয়ে মানবিকতার বিরুদ্ধে গোপনে চক্রান্তের জাল রচনা করে। কবির প্রতিবাদ তারই বিরোদ্ধে।
সতেরো
বুকের ভেতর প্রিয় নদী মনু।
তুমি এসে সাঁতার কাটলে
নদীটি তির তির নেচে উঠে
বন্যা আসে জল থৈ থৈ।
সকলের ভেতরেই তার প্রিয় নদীটি
নৌকা ভাসিয়ে বুকের ছলাৎ ছলাৎ
মাঝিটির অপেক্ষায় বসে থাকে।
প্রিয় নদী মনু তার বুকের ভেতর
জলের ভেতর তোমার মতোই
খলবলানো একজন প্রবাহিত।
জলডুবের বেলা কখন চলে যায়
প্রিয়নদীটির বুকের ভেতর তিড়িং বিড়িং।
কবির বুক নদী মনুর মতো উত্তাল বেগবতী ভালবাসা সবকিছু ছাপিয়ে নিয়ে যেতে চায়।কিন্তু বহুদিন হলো মনোনদী বৃষ্টির অভাবে খাঁ খাঁ করছে। কেউ এসে সমকাম এর মতো তাঁর দরজায় কড়া নাড়ছে না। আসলে কবি মানুষকে অসম্ভব ভালোবাসেন কিংবা অমানবিকতার বিরোদ্ধে দ্রোহ ঘোষনা করেন। কবি মানুষের জন্য মানুষকে নিয়ে মানুষের মিলনের জয়গান গাইতে চান- যাদের জলজজীবন- ভালোবাসা স্রোতস্বী তাদের নিয়েই অমরাবতীর পথে হাঁটতে চান। কবি বিশ্বাস করেন-সকল মানুষের বুকের ভেতর একটি নদী মনু-যেন সর্বদা খলবল খলবল প্রবাহিত।আসলে মনু কবি থেকে আলাদা কেউ নয়। কবিই নদী- নদীই কবি।এ নদী তাঁর মনোনদী-ভূবননদী।কবি অসম্ভব মানবদরদী ।মানুষের জন্য তিনি জীবন দিতে চান।জলডুব- আসলে মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে ডুবুরী হয়ে ওঠেন তখন কোন দিকে সময় চলে যায় তিনি বুঝতে পারেন না।কতবড়ো মন হলে এমন কথা বলা যায়। অনুমেয়। তাই তাঁর নিখাদ উচ্চার- 'জলেডুবে কখন বেলা বয়ে যায়' ।
আঠারো
নীলরঙা শাড়িতে মনু
নদীর মতোই কবিতা।
জলে জলে গহীন তুমি সাত পুরুষের পিপাশা।
কবির নীল রং প্রিয় রং।একদিকে নীল যেমন বিষের প্রতীক তেমনি নীল আকাশের প্রতীক।আসলে কবি মানুষের হিতের জন্য নীলকন্ঠ হতে রাজী। মানুষের জন্য গলাজলে ডুবতে রাজী।কবিতা আসলে কবির কাছে আত্মক্ষরন - আত্মক্ষর।নিজেকে কাঁটাছেড়ার পর বেড়িয়ে আসা মজ্জাধাতু।ভান্তের ধাতু।মনু তো কবির জীবন নারী। কবির কাছে কবিতাই জীবন- জীবনই কবিতা।কবি ও কবিতা অভেদ আত্মা।এ যেন মানুষের ডেটা।কবি বলেন-জলে জলে গহীন তুমি সাতপূরুষের পিপাসা। ।
ঊনিশ
মনুনদী বুকে লেপ্টে আছে।
আর মনুর জলে যত আর্সেনিকই থাক তবু আমাদের পিপাশার পানি ছিলো।মনুর চিকন মিহিবালু গায়ে লেপ্টে বালুতে কত খেলাঘর গড়েছি।কিন্তু সব ঘর ভেঙ্গে যায়।ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায়।আবার ঘর বানাই।মনু এসে গিলে খায়।এই আমার নিয়তি।তবু আমি মনুর সন্তান।মনু পাড়ের লোক।চিরকাল লোক-ই রইলাম।মানুষ হলাম কই।
মনুর বুকে কবির বেড়ে ওঠা।মা যতই বকুনি দিক মা মা-ই। তাই কবি বলেন মনুর বুকে বিষ থাকলেও পিপাসা মেটানোর জলের অভাব হতো না।কবির কাছে মনু নারীর ষোলকলা রূপ নিয়েই আবির্ভূত।যেহেতু পাত্রের আকারই জলের আকার - জল চরিত্র। তাই কবির আকারও মনুনদী-মনু চরিত্র।নদীর মতোই তিনি ঘর বানান কিংবা স্বপ্ন ভাঙ্গে-ফের গড়েন।এ কবির নদীদর্শনসার।জীবনদর্শন সার।আসলে তিনি মানুষ আবার না মানুষও।অর্ধনারীশ্বর।নারীপুরুষ সমকাজ সমমান -এ কবির বিশ্বাস ।ভাঙাগড়া আসলে জীবনের নাম।কবি মধ্যগগন পেরিয়ে গেছেন, নিজেকে পিলসুজের মতো জ্বালিয়ে চলেছেন-মানুষের মতো ঘর করতে পারেননি।তাই কবির সখেদ উচ্চার - '--লোকই রইলাম। মানুষ হলাম কই'। আসলে কবি মানুষের জন্য মানুষের মতো মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাইছেন কিন্তু বিনিময়ে তিনি মানুষের কাছে মানুষের মর্যাদা পাচ্ছেন না।উল্টো তিনি হচ্ছেন তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার। তাতে কবির কিছু যায় আসে না। তিনি লক্ষ্যে অবিচল।
বিশ
আমার ছোটবেলার নদী জুরি
বয়ঃসন্ধির নদী মনু
ভাটি বয়সের নদী দেও।
আমার স্কুলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো যে ছোটনদী তার নাম রাতাছড়া।
মহিষ চরাতে গিয়ে পেয়েছি
ডিগবাজীতে তিড়িংবিড়িং
একটি ছোট খাল
যার নাম আনোয়ারা।
এরকম নদী ছড়া আর খাল মিলেই
প্রতি রাতে জলোচ্ছ্বাস উঠে বিছানায়।
ছোটবেলায় বন্যা এলে উঠোনে মাছ আসতো।
ভাটি বয়সেও বন্যা শিয়রে আসে
লাফালাফি করে বুকের ভেতর শিং মাছ।
মনের জলাশয়ে খলবল খলবল বেড়ে গেলে
দিনগুলো নদীমাতৃক হয়ে যায়।
এ কবির নদীজীবনের তীব্র ইঙ্গিত পাঠকের কাছে লাফ দিয়ে ওঠে।দিলখুলা কথারাগ।কবির নদীজীবনবেদ।তাঁর জীবন শৈশবে জুরীর জারি জুরী, বয়:সন্ধি ও যৌবনে মনুর খলবল, ভাটি বয়সে দেওনদীর ঘোর দিয়ে গড়া। কবির মজ্জায় নদী।নদীজীবনসার।রাতাছড়ার মতো পুরুষমোরগ আর আনুয়ারাছড়ার মতো নারীজীবনের সাক্ষী। তাই নদী নালা খাল বিল হাওড়া জীবন তাঁর। নদীর ধারাজীবন তাঁর। তাই কবির খাঁটি নদীমাতৃক জীবন। তিনি ও নদীর মাঝে কোন আড়াল নেই।আসলে এ আর কেউ নন - এ গোবিন্দ নদী---!
একুশ
তুমি নদীর মতো জল হয়ে নিচের দিকে গড়াও।
নক্সী কাঁথার নিচে চলে এসো জলের তুমি।
প্রেমিকা নদী হয়ে আসে হাত ধরে নিয়ে যায় ঘরে।
সকল ভালোবাসা তার কাছে জলের চিঠিতে লিখি।
নদীর জলের মতো তুমি কেমন সকাল হয়ে আসো।
বাসীরাত তখনো লেগে আছে নীল শাড়ির ভাঁজে।
এমন সকাল কতদিন আসেনি তুমি জল রঙা শাড়ি
আমি শাড়ির জমিন জুড়ে লেপ্টে থাকা চোরকাঁটা।
সময়ের কর্কট বলয়ে দাড়িয়ে কবি দেখেন কবির নদী জীবন থেকে নদী যেনো ভাটির দিকে নেমে যায়। একসময় যে নদী তাঁর একদা খেলার সাথী ছিলো, বাঁচাবাড়া জলখেলি বালুরাগ সমুদ্রসফেন উচ্ছাস ও সমকাম মুদ্রায় ছিলো কবির ছায়াসঙ্গী, আজ যেন সেই সানুরাগমুদ্রাগুলি অবয়বহীন।স্রোতের সাথে গুলে যাচ্ছে নদী।ভিড়ছে নকসিকাঁথার মাঠে কিংবা ফাঁকা প্রতিস্রুতি সামিয়ানায়।এমন কর্কট সন্ধিতে একমাত্র অভিন্ন হৃদয় বন্ধু কবির মানসনদী প্রেমিকার মতো হাঁত ধরে তাঁকে ঘরে নিয়ে যায়। তাঁকে দেয় দুদন্ড শান্তি।কবি দেখতে পান তাঁর সকাল আর আগের সকাল নেই।আগে প্রেয়সী নদীর হৃদয় যেমন মালিন্যহীন ছিলো এখন আর তা নেই। তাই কবি বাসি রাতের অনুসঙ্গ টেনে নিয়ে এসেছেন। কবির আক্ষেপ -'
এমন সকাল কতদিন আসেনি তুমি জল রঙা শাড়ি
আমি শাড়ির জমিন জুড়ে লেপ্টে থাকা চোরকাঁটা।'
বাইশ
জলনেই জলনেই এক সরোবরে একলা মাছ তুমি।
খলবল খলবল সারাক্ষণ নেচে বেড়াও
জলজ হাওরে।
তোমার পাখনায় লেগে থাকা বয়স ঊনিশ,হৃদয়ে একুশ।
জলের তোড়ে সাঁতার কেটে চলে আসো
ওপাড় থেকে এ পাড়ে-কাঁটাতার বিচ্ছিন্ন করে সাইবেরিয়ান পাখি।
ইদানিং আমি পাখি পুষি বাসা বানাই।
ডাকি এসো হৃদয়ের বাসায়।
জলের অতল থেকে সন্তরণরত মাছ তুমি
পাখনাকে ডানা করে উড়াল মুদ্রায় এসো
পাখনাডানারহাত ধরে হেঁটে যাই প্রজন্মচত্বর।
কবির কাছে জল- স্রোতজীবনের দ্যোতক।জীবন জল স্রোত একই শরীরে গৌরাঙ্গ।কবির এই কবিতায় 'তুমি' ও 'আমি' একই সূতোয় বাঁধা সাধকের ঈড়াপিঙ্গলা যেনো। 'তুমি 'কবির স্বপ্ননিগড়-আত্মস্বর।'আমি' স্রোত হীন বদ্ধজলার পাঁকে ফেসে যাওয়া কবির পার্থিব শরীর।কর্কটসময়বলয়ে কবি ঘুরপাক খাচ্ছেন বুকে চেপে রাখা একঝাঁক ঊনিশ আর একুশের উত্তাল খলবল- অব্যক্ত যন্ত্রণা ।আর এই অব্যক্ত অবিব্যক্তি প্রকাশের প্রবল উচ্ছাসে তিনি কাঁটাতার ছিন্ন করতে ভর করেন সাইবেরিয়ান উড়াল পাখির ডানা। আসলে এই উড়াল পাখি কবির মনোপাখি, কবির জীবনচৈতন্য।তাই কবি বলেন-'ইদানিং আমি পাখি পুষি বাসা বানাই।' এই পাখি কবির স্বপ্নমনপাখি, আর ঘর -চৈতন্যমানবের ঘর। যে ঘরের সন্ধানে আজীবন কবি শেঁকলছেড়ার তানপুরা বাজিয়ে চলেছেন শব্দকর কিংবা শব্দশ্রমিকের মতো।কবি আহ্বান রাখছেন মানুষের চৈতন্যের কাছে-জলজ মুদ্রা থেকে বেরিয়ে 'পাখনা কে ডানা করে উড়াল মুদ্রায় এসো'।কবি এখন বিশ্বাস করেন আরাধ্য লাভের জন্য এবার মুদ্রা পরিবর্তন করতে হবে।কেননা শত্রুরা এযাবত কবির মন্ত্রগুপ্তি ভেদ করে ফেলেছে।কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। নতুবা অভিষ্ট লাভ করা যাবে না। তাই কবি বলেন-' পাখনাডানার হাত ধরে হেঁটে যাই প্রজন্মচত্বর।
তেইশ
দেখতে দেখতে তুমি পর হয়ে গেলে?
জলকন্যা হয়ে গেলে?
আচ্ছা ,স্কুল পালানোর কথা মনে আছে?
মনে আছে হাত ধরে সময় পেরিয়ে যাওয়া সময়ের কথা।
আজকাল ফোন নেই,দেখা হয়না।
কেমন আছো?কোথায় থাকো?
কিচ্ছু জানি না।তোমার স্মৃতিগুলো অনেকটাই মনে নেই। অথচ বয়ঃসন্ধি
লিকলিকে বেড়ে ওঠা সব ছিলো মুখস্থ।
বুকের বৈশাখ কালবৈশাখ উতালপাতাল
জলবিকেল সব কেমন জল থৈ থৈ
আবছা আবছা ধূষর রঙ।
জলকন্যা ,এসো বরং জল থৈ থৈ
জলেই আমরা হারিয়ে যাই।
নগ্ননির্জনে আঁকি শান্তিনিকেতন তোমার বুকে।
যাকে হৃদিজলে ধারন করে কৈশোর থেকে যৌবনের চুম্বনবেলার পর অবধি একসাথে সূর্যের স্বপ্ন দেখতেন, আজ সে জীবন থেকে হারিয়ে গেছে।আজ যেন কবির সূর্যসাথী নেই।আজ সে পর হয়ে গেছে।আসলে সাম্যবাদে বিশ্বাসী কবি নিজের পারিবারিক ঠিকে থাকার লড়াই নিজের অস্তিত্বের লড়াইয়ের মাধ্যমে তথাকথিত স্রোতনদী উজিয়ে চলার পাঠ নিয়ে ছিলেন।পিতার অভাব অনটনের সংসারে শৈশব থেকেই সূর্যের দিকে মুখ করে এগিয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন।এ পাঠ মনুনদী তথা মননদী কিংবা গোবিন্দ নদী থেকেই পেয়ে ছিলেন। এই পাওয়া তার নিজের কাছে নিজেকেই কাঁটাছেড়া করে লাভ করেছিলেন।আজ সেই সূর্যের অমিত তেজ যেন কর্কট বলয়ে এসে মাঝে মাঝে অস্তিত্বসংকটে ভোগে। তখন মনে হয় তাঁর ভেতর সেই উচ্ছলময়ী যেন নেই।কর্কট দেও এসে তাঁর বুক খেয়ে নিয়েছে। আমার মনে হয় কবি বুঝি সাম্যবাদে উত্তরনের লড়াইসংগ্রামের সংকটে ভুগছেন। কিছুদিন আগেও যাঁর মার্গের উত্তাল তরঙ্গ ছিলো,আজ যেন সব স্তিমিত হয়ে এসেছে।জলজ কবির জলজনারী আজ আনবাড়ি গেছে।আজ কবির এতোকালের পায়ে পায়ে চলার স্মৃতি যেন ফিকে হয়ে গেছে। তাই কবি তুলির টানের মতো আলোছায়ার বিভঙ্গ টেনে বলেন-'জল বিকেল কেমন যেন জল থৈ থৈ/আবছা আবছা ধূসর রঙ।' কবি আবার বুঝেন তাঁর স্বপ্নের শোষনমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য সংগ্রাম কৌশল পাল্টাতে হবে।আর প্রথাগত স্রোত জল কিংবা কর্কট থৈ থৈ জলে মিশেই নুতন উদ্যমে সংগ্রাম কৌশল অবলম্বন করতে হবে।কবি ফের আত্মবিশ্বাসে টগবগ করে ফুটতো থাকেন। হৃদয়ের অন্তসলীলাকে আহ্বান করেন প্রবল উচ্ছাসে আর একা একাই তাঁর আরাধ্য শান্তিনিকেতনের নকশা আঁকেন। তাই তিনি বলেন--' নগ্ননির্জনে আঁকি শান্তিনিকেতন তোমার বুকে।'
চব্বিশ
চূড়ান্ত মূহুর্তে যে রূপ বৃষ্টি হয়ে ঝরে এসো তেমন নারী হয়ে।
যেন রূপ ঝরে পড়ে ইলিসজলে।
যেন কাম জাগে মনের বাউলঘরে।
যেন মন মনের টানে এক হয়ে যায়।
যেন মিশে যায়,জলে মাছ।
যেন চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়ে নাও নদীবক্ষে।
আরো কামরূপে এসো
আরো কামাক্ষাসাজে সাজো
আরো কামের দেবী হয়ে এসো।
আরো কাম চাই চোখের ইশারায় প্রিয়।
তুমি ভাঙা পাঁজরে দাও দাঁড়াবার জন্ম।
এবং তারপরই কবি বলেন তাঁর হৃদি নারী কংবা মনোজলনদী যেন প্রবল সফেন সামুদ্রিক উচ্ছাসে চরমবাৎস্যায়নউদ্দিপক নারীর মতো ঝড় হয়ে আসে-যে ঝড়ে বাঘেগরুতে জল খায় একঘাটে কিংবা - 'যেন কাম জাগে মনের বাউল ঘরে'--যেন মিশে যায় জলে মাছ' কিংবা ' /---ভেঙ্গে পড়ে নাও নদীবক্ষে/'---কামরূপে--' /'--কামাক্ষাসাজে--/' - - কামের দেবী হয়--'/এমন শক্তিময়ী হয়ে এলেই কেবল জীবনসংগ্রামে ভগ্নপাঁজর কবি নতুন করে পাবেন দাঁড়ানোর শক্তি।তাই কবি বলেন -' ভাঙা পাঁজরে দাও দাঁড়াবার জন্ম।
কবির এই নুতন করে দাঁড়াবার জন্ম এক গভীর ইঙ্গিতে দিকে পাঠককে টেনে নিয়ে যায়। এই - 'ভাঙাপাঁজরে দাঁড়াবার জন্মের জন্যই কী কবির স্থান ত্যাগ? প্রিয় মনুর থেকে আড়ালে চলে যাওয়া। ঠিক দূরে নয় কিছুটা হলেও আড়ালে- একি তবে কবির আনবাড়ি? যা মনুর নামে চালিয়ে দেওয়া যা পাঠককে আলোছায়ার ঘোরে টেনে নিয়ে যায়।এরপরই কবি দেওলা দেওয়ের বুকে আসেন!দেওলার বুকে ডুবেই কি তবে তিনি রণকৌশল পাল্টে সাম্যের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে চান? দেখা যাক-
এবার কবির দেওসমগ্র অবগাহন করে।
----------------------------------------
নোট:
(১)একটি পাতায় একটি কবিতা পরের পাতায় আলোচনা রেখে সেটিং করবেন।
(২)
0 Comments