মনের ডায়েরি - ৩৭ 

সিদ্ধার্থ রায়

 কবি গোবিন্দ ধর শৈল্যবিদের মত নিজেকে কাঁটাছেঁড়া করে বিশুদ্ধ উচ্চারে ছড়িয়ে দিয়েছেন জীবনবেদ||সিদ্ধার্থ রায়


উত্তরপূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা রাজ্যে এক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চেতনায় আলোকিত মানুষ যিনি লিটিল ম্যাগাজিন আন্দোলনের পুরোধা এক সৈনিক যিনি ১৯৯৫ সাল থেকে সাহিত্য আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে ও "উত্তরপূর্ব  লিটল ম্যাগাজিন সংরক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র" র জনক, যাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও কর্মপ্রতিভার পরিচয় হল "ত্রিপুরা লিটিল ম্যাগাজিন গিল্ড" এবং বর্তমানে যিনি বঙ্গ-বহির্বঙ্গে সহ বাংলাদেশেও বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছেন। কবি, শিক্ষক, কথাশ্রমিক ও প্রকাশক হিসেবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র যিনি তাঁর নিরলস যুদ্ধে সাফল্যের শিখর ছুঁতে বদ্ধপরিকর ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে হয়ে উঠেছেন এক জীবিত দ্রোহবীজ যা তাঁর বিস্ময়কর সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছ।ইনি হলেন স্বনামধন্য কবি ও সাহিত্যিক শ্রী গোবিন্দ ধর যাঁর কথা বলতে গেলে প্রথমে একথাই বলতে হয় যে একজন সফল সাহিত্যিক বা শিল্পী আমাদের সৌন্দর্যবোধকেই শুধু চরিতার্থ করেন না, আমাদের চিন্তার রুচিশীলতা ও কর্মের প্রেরণাকেও গতিশীল রাখেন। আমরা যেমন ‘কাল’কে প্রভাবিত করি, তেমনি কালও প্রভাবিত হয় আমাদের দ্বারা। সফল সাহিত্যিক কালস্রোতে ভেসে যাওয়াতেই মনুষ্যত্বের সার্থকতা নিহিত বলে মনে করেন না বরং কালস্রোতের গতি পরিবর্তন করে তাকে নির্ধারিত লক্ষ্যপানে প্রবাহিত করাকে নিজের একটা বড় কর্তব্য বলেও মনে করেন।

সাহিত্যিক গোবিন্দ ধর যিনি ত্রিপুরার একজন শিক্ষক সহ কবি, প্রকাশক, নাট্যকর্মী, গল্পকার, সর্বোপরি একজন প্রগতিশীল লেখক ও সংগঠনকর্তা যিনি বিশ্বাস করেন যে মানবজীবনের অন্যান্য সব দিকের মতো সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ঐতিহ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। ঐতিহ্যকে বাদ দিয়ে  সাহিত্য যেমন কালজয়ী হয় না, তেমনি মানুষের কোনোরূপ কল্যাণ সাধনে কিংবা মানবমনে মহৎ প্রেরণা ও কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি না করতে পারলে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হতে হয় । মানুষের ঐতিহ্য তার অস্তিত্ব ও ইতিহাসের মূল দর্শন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। নিজেই হয়ে উঠেছেন একটি প্রতিষ্ঠান যে প্রতিষ্ঠানে শব্দ ও ছন্দের গতিকে ধারালো ইস্পাত কাঠিন্যে তৈরী করার বীজমন্ত্র প্রদান করা হয় সাধনায় রত তপস্বী ভাষাপ্রেমীদের আরাধনার বিরামহীন কর্মযজ্ঞে। তাঁর এই সৃজনশীলতা ও স্বতন্ত্রবোধ তাঁকে করে তুলেছে সর্বজনপ্রিয় এবং নবীন লেখক ও লেখিকাদের পরম আশ্রয়দাতা। কিন্তু তরুণ লেখকদের প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বার বার আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন সেই স্বঘোষিত কবি ও লেখক গোষ্ঠীর কাছে যারা আজও এই ভ্রান্তিতেই বাঁচেন যে "তাদের গোষ্ঠীস্বার্থে যাঁরা ধুনো দেবেন তাঁরাই লেখক আর যাঁরা তাদের স্বার্থ পূরণ করবেন না ও তাদের তোয়াক্কা করবেন না তাঁরা লেখক নন"।

গোবিন্দ বাবুর জন্ম ১৯৭১ সালে ত্রিপুরা রাজ্যের ধর্মনগর অঞ্চলের অফিসটিলা-য়। প্রাথমিক শিক্ষা রাতাছড়া বিদ্যালয়ে ও তারপর কাঞ্চনবাড়ি উচ্চবিদ্যালয়ে।খুবই অভাব ও অসহায় অবস্থা কে সঙ্গী করে বড় হয়েছেন। একসময় বাবার সাথে দিনমজুরিও করেছেন, করেছেন কৃষিকার্যও এবং হকার হয়ে সংবাদ-পত্র বিক্রিও করেছেন। তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে, তারপর প্রানের স্পদনে জিজ্ঞাসা ও তার বিশ্লেষণের স্বকীয় বোধ তাঁকে তাড়া করে নিয়ে গেছে দেশের এক প্রান্তর থেকে অন্য প্রান্তরে। তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের বহু পত্র- পত্রিকায়। সে লেখায় মানুষ ও তার  প্রবাহমান স্রোতধারার আওয়াজ মুখরিত হয়ে পাঠককে দিয়েছে বেদবীজের সন্ধান ও মানুষ সেই লেখা পড়ে নিজেরাই হয়ে উঠেছেন দ্রোহবীজ। "স্রোত", "স্রোতস্বিনী", দিয়ে সম্পদনায় তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল তারপর "কবিতার কাগজ", "কবিতা ঘর", শিশু-সাহিত্য "কুসুম", "বইবাড়ি", "অন্যপাঠ", "উৎসব সমাচার" সহ অসংখ্য পত্র-পত্রিকার সম্পদনায় মগ্ন রয়েছেন। "স্রোত" প্রকাশনার শাখা এখন বিভিন্ন রাজ্যে বিস্তৃত এমনকি বাংলাদেশ ও লন্ডনেও শাখা গড়ে উঠেছে। বিদগ্ধজনের কাছ থেকে গোবিন্দ ধর একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন। বহু অভিধায় ভূষিত হওয়া গোবিন্দ ধরের প্রকাশিত কবিতা সংকলনগুলি " জলঘর",  "সূর্যসেন লেন", "মনসুন মাছি", "দ্রোহবীজ পুতে রাখি", "একা", "শ্রীচরণেষু বাবা", "দেওনদীসমগ্র", "আনোয়ারা নামের মেয়েটি" ও "আষাঢ়ের দিনলিপি"। এছাড়াও যৌথ কবিতা সংকলন, ছড়া সংকলন, শ্রীহট্টীয় লৌকিক সংস্কৃতি ও শব্দকোষ এর মতো অসংখ্য প্রবন্ধ ও গবেষণাসহ ভিন্ন স্বাদের রচনা সঙ্কলনও প্রকাশিত হয়েছে।

কোনো সাহিত্যই স্থান-কালের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। সাহিত্য সাহিত্যের জন্য হোক কি জীবনের জন্য দুটি ক্ষেত্রেই সাহিত্যিককে তার চার পাশে নিত্যসংঘটিত ঘটনাবলি ও পরিস্থিতির কাছ থেকে চিন্তার উপকরণ গ্রহণ করতে হয়। মূলত জীবনের বস্তুনিষ্ঠ বিষয়াদির ভিত্তিতেই সাহিত্যিক তার রচনার কাঠামো নির্মাণ করেন। অতঃপর দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে সেই অবকাঠামোর ওপর রচনার অবয়ব নির্মাণে স্বভাবতই পার্থক্য সূচিত হয়। যারা সাহিত্য জীবনের জন্য মতাদর্শে বিশ্বাসী, তারা সেই অবকাঠামোর ওপর রচনার পূর্ণ অবয়ব নির্মাণ করেন বাস্তবতা ও যথার্থতার উপকরণ দিয়ে। এখানেই নিজের অনবদ্য রচনা শৈলীর জন্য মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন কবি গোবিন্দ ধর এবং তাঁর লেখা পড়ে সবাই  স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, সাহিত্য যে মতাদর্শকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠুক না কেন, চিন্তার যে ধারা যে আদর্শেরই অনুসারী হোক না কেন, জীবনের প্রকৃত বাস্তবতার সাথে তা কোনোভাবেই সঙ্গতিবিহীন হতে পারে না এটাই বাস্তব ও শাশ্বত সত্য।

0 Comments