ঝাড়খণ্ডের 'কুখ্যাত' জামতাড়ায় প্রথম লিটল ম্যাগাজিন ও গ্রন্থমেলায় দুই দেশের বাঙালিরা পুঁতল সংস্কৃতির বীজ || গোবিন্দ ধর 


ঝাড়খণ্ডের জামতাড়ায় শিল্পে অনন্যা আয়োজিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিটল ম্যাগাজিন ও গ্রন্থমেলা :২০২৩

সকাল সকাল আগরতলা বীর বিক্রম মানিক্য আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে পৌছলাম। তখন সকাল ৭টা ১০ মিনিট।আমাদের বোর্ডিং ৮টা৩০ মিনিটে।কলকাতা পৌঁছলাম ১০টা ছুঁই ছুঁই। নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট থেকে এসি বাসে করে  হাওড়া স্টেশনে এলাম প্রায় ১২টা তখন।দুপুরের খাওয়া শেষে দীর্ঘ সময় বসে আছি হাওড়া রেলস্টেশনে। আমাদের ট্রেন মিথিলা এক্সপ্রেস। ছাড়বে ৩টা ৫৯ মিনিট।জামতাড়ায় পৌঁছার কথা ৮:৫৯ মিনিটে।কিন্তু ট্রেন বরাবরই সময়ে গন্তব্যে পৌঁছার অভিজ্ঞতা নেই 
অবশেষে জামতাড়া ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিটল ম্যাগাজিন ও গ্রন্থমেলায় উপস্থিত হলাম।স্টেশনে ভোলা রাম সাকরা রিসিভ করে রাত ১০টায় নিয়ে এলেন অনুষ্ঠান মঞ্চে। বইগুলো রাখলাম। তারপর রাতের খাওয়া।রুটি রাইস তরকা ডাল সবজি মিস্টিমুখ শেষে হোটেলে এসছি।টটো করে এলাম।আমাদের রাতে থাকার জায়গা 
ডায়মন্ড merried হল বাস স্ট্যান্ডের আগে রুম নম্বর ৩।
স্টেশন থেকে গাড়ি করে নিয়ে এলেন।বিয়েবাড়িতে খাওয়ার আয়োজন।পাশেই অনুষ্ঠান মঞ্চ। তার নিকট মেলার টেবিল সেজে উঠেছে।
দীপককুমার সেনদা ও কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়দা উষ্ণ অভ্যর্থনায় বরঙ করে নিলেন আমি গোবিন্দ ধর, সুমিতা পাল ধর ও গৌরব ধরকে।আগামীকাল সকাল সাতটায় প্রভাতফেরি। অনুষ্ঠান শুরু হবে সকাল ১০টা আগামী তিনদিন ব্যাপী।
রাতে অনুষ্ঠান হলের সামনেই দেখা হলো অরূপ কুমার মিত্র ও বাউলশিল্পী শাশ্বতী বানার্জীর সাথে।

২৭:০৭:২৯২৩
রাত:১১টা১৫মি।
জামতাড়া, ঝাড়খণ্ড।
 ঝাড়খণ্ডের জামতাড়া বরাবর আতঙ্কের নাম হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে ৷ সেই জামতাড়াতেই এবার প্রথম বইমেলার আয়োজন করলেন সেখানকার বাঙালিরা ৷

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিটল ম্যাগাজিন মেলায় বই প্রেমীদের ভিড় উপচে পড়ে                              

 ২৮ জুলাই ২০২৩:শুক্রবার জামতাড়া শহরের সেন্ট এন্থনী স্কুল চত্বরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিটল ম্যাগাজিন সহ গ্রন্থ মেলার উদঘাটন করেন আয়োজন সমিতির সভাপতি ড দীপক সেন ও ভারত জ্ঞান বিজ্ঞান সমিতির জাতীয় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ড কাশীনাথ চ্যাটার্জি ।

উপস্থিত ছিলেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা সমিতি ঝাড়খণ্ডের স্টেট সেক্রেটারি গৌতম চট্টোপাধ্যায় ,বিহার বাঙালি সমিতির রাজ্য সমিতির কর্ণধার বিদ্যুৎ পাল ,সুনির্মল দাস ,অধ্যাপক তন্ময় বীর ছাড়াও স্রোত সম্পাদক কবি গোবিন্দ ধর, ত্রিষ্ঠুপ সম্পাদক ও কবি ব্রজকুমার সরকার,আরিত্রিক সম্পাদক ও কবি দুর্গাদাস মিদ্যা।ছিলেন  বিহার বাঙালি সমিতির পূর্ণিয়া শাখার অজয় সান্যাল। বাংলাদেশের লেখক ,কবি ও সাহিত্যিক আইনজীবী  মুজিবুল হক ,মোহাম্মদ শরিফুল রহমান  ,সকিল মাসুদ , শ্যামালিমা পত্রিকার সম্পাদক ড ছায়া গুহ ,দুর্গাদাস ভাণ্ডারী ,ড কাঞ্চন গোপাল মণ্ডল ,নবারুণ মল্লিক  দিবাকর মাহাতো ।

মেলায় দুমকা ,ধনবান ,কোলকাতা , পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন জেলার লেখক ও প্রকাশক দের স্টলে পাঠক দের ভিড় লক্ষণীয় ছিল ।  ড সেন উদঘাটন বক্তব্যে লিটল ম্যাগাজিন মেলার আয়োজন এর প্রাসঙ্গিকতার উপর আলোচনা করেন । ড কাশী নাথ , গৌতম ও চন্ডি দাস পুরী বক্তব্য রাখেন ।

কার্মাটাঁড়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

২৯ জুলাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রয়াণ দিবস।আমার সৌভাগ্য তাঁর প্রয়াণ দিবসে কার্মাঢাঁড়ে উপস্থিত থাকতে পেরেছি।
কার্মাটাঁড়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাড়িই ‘চেঞ্জারদের বাড়ি’। পারিবারিক নানা সমস্যা, সামাজিক নানা বিড়ম্বনা ও শারীরিক কারণে বিদ্যাসাগর পশ্চিমে নিভৃতে থাকার জন্য ঘর খুঁজেছিলেন। কার্মাটাঁড় স্টেশনের সামনে ৫০০ টাকায় এক ইংরেজ মহিলার কাছ থেকে এই বাগানবাড়ি কিনেছিলেন তিনি। নাম দিয়েছিলেন নন্দনকানন। তিনি এখানে ১৮৭৩ থেকে ১৮৯১ পর্যন্ত অবস্থান করেছিলেন। এখন স্টেশন চত্বর ঘিঞ্জি। বাগানবাড়িটার পরিবেশ ভালই আছে। কিন্তু বাগানে গাছের বড় অভাব। একটা বটগাছতলায় বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি আছে। প্রতিবছর এখানে ঝাড়খণ্ড (পূর্ব নাম বিহার) বাঙালি সমিতি বিদ্যাসাগরের জন্মদিবস পালন করে ও অন্যান্য অনুষ্ঠান করে। এখানে থাকার জন্য গেস্ট হাউস আছে। সাধারণের জ্ঞাতার্থে জানাই, ‘করমা’ সাঁওতালদের লৌকিক দেবতা, টাঁড় শব্দের অর্থ পতিত ডাঙা। এই দুয়ে মিলে কার্মাটাঁড়। কার্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগর নামাঙ্কিত একটি ভগ্ন লাইব্রেরি দেখলাম। স্টেশনের নাম কার্মাটাঁড় থেকে বিদ্যাসাগর হয় ১৯৭৮ সালে। স্টেশনে নাম বদলের ফলক লেগেছে ১৯৮৯ সালে। এখানে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, উর্দু ভাষাতে বিদ্যাসাগর নাম লেখা আছে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়; ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা নামেও স্বাক্ষর করতেন।(২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ – ২৯ জুলাই ১৮৯১;১২ আশ্বিন, ১২২৭ – ১৩ শ্রাবণ ১২৯৭ বঙ্গাব্দ ) ঊনবিংশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার।সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৩৯ সালে তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। সংস্কৃত ছাড়াও বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল তার। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ ও সহজপাঠ্য করে তোলেন। বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক রূপকার তিনিই। তাকে বাংলা গদ্যের প্রথম শিল্পী বলে অভিহিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি রচনা করেছেন যুগান্তকারী শিশুপাঠ্য বর্ণপরিচয়-সহ একাধিক পাঠ্যপুস্তক, সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থ। সংস্কৃত, হিন্দি ও ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ সাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞান সংক্রান্ত বহু রচনা। নারীমুক্তির আন্দোলনেও তার অবদান উল্লেখযোগ্য।

মাত্র নয় বছরের কিশোর কলকতার রাস্তায় যেতে যেতে মাইলফলক দেখে শিখে নিলেন ইংরেজি অংক। কলকতার ইংরেজি স্কুলে ভর্তি নিচ্ছিলেন না শিক্ষক।  তার বাবার অনুরোধে শিক্ষক মহোদয় পরীক্ষা নিলেন । মুহূর্তের মধ্যেই অংকটি সমাধান করলেন। 
কিশোরটি সংস্কৃত শিক্ষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করে বাংলা ভাষার জন্য তৈরি করলেন বর্ণমালা। 
সমাজের কুসংস্কার দূর করার জন্য কাজ শুরু করলেন। রাজা রামমোহন রায়ের অসম্পূর্ণ কাজকে পূর্ণতা দান করার জন্য শাস্ত্রসম্মত বিধবাবিবাহ আইন প্রবর্তন করলেন। 
নিজের দর্শন সমাজে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে আপোষ করেননি নিজের সন্তান এবং পিতার সাথে। 
জীবনের শেষ আঠারো বছর তিনি মিশেছিলন সাঁওতালদের সাথে। স্বজনদের ছেঁড়ে থাকতেন সাঁওতাল পরগণার কারমাটার গ্রামের নন্দনকান বাংলোতে । 
তাঁর নাম পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আজ বিদ্যাসাগরের ১৩২ তম প্রয়াণদিবস। শ্রদ্ধা জানাই। 
বিদ্যাসাগর সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, 
'দয়া নহে বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব- তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষত মনুষ্যত্ব। '

এই পুণ্যভূমির কাছেই আসানসোল, চুরুলিয়া। যেখানে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের আবাসভূমি। 
উল্লেখ্য, আজ সকালে বিদ্যাসাগর লিটিলম্যাগাজিন ও গ্রন্থমেলা আয়োজকদের সাথে বিদ্যাসাগরের নন্দনকানন বাড়ি ভ্রমণসূত্রে জানা গেল যে, জামতাড়ার এই অঞ্চল দেশভাগের আগে অনেক বিত্তবান মুসলিম বাস করতেন। যারা ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় ভিটেমাটি ফেলে চলে যান বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তানে)। পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান।

বিদ্যাসাগরের মতো শ্রেষ্ঠ মানুষও পারিবারিক কারণে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসে মানসিক শান্তি খুঁজে জীবনের অন্তিম দিনগুলো এক সাধারণ মানুষের মতো কাটিয়ে দিতে হয়েছে। 
বাংলা ভাষা যার হাত ধরে আজ আমাদের পরিচয় বহন করে চলেছে সেই মানুষটির জীবন কত অবহেলায় অতিবাহিত হয়েছিল জামতাড়া কার্মা
ঢাঁড়ে না এলে অজানাই থেকে যেতো আমার। 

২৯/০৭/২০২৩


দিনপঞ্জিকা:জামতাড়া:২৯:০৭:২০২৩

সকাল সকাল শৈলী লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক অমলেন্দু চক্রবর্তী মহোদয় দরজায় টোকা দিলেন চলুন গোবিন্দ চা খেতে। আমিও একপায়ে রাজী। সাথে সুতপা লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক রাজকুমার সরকার। দুজনই ধানবাদ থেকে শিল্পে অনন্যা আয়োজিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিটল ম্যাগাজিন ও গ্রন্থমেলা উপলক্ষে জামতাড়ায় এসছেন গতকাল। আমরা ডায়মন্ড ম্যারেজ হলে রাত্রিযাপন করেছিলাম।
জামতাড়া বাসস্ট্যান্ডে মাটির ভাঁড়ে চা নিলাম।জামতাড়ায় এখনো মাটির হাঁড়িতে চা বানানো হয়।এই প্রাপ্তিও জীবনকে ধন্য করেছে।আমার জীবনের নানা বাঁকে অনেক কষ্ট করে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয়।গতকাল গৌরব প্রচণ্ড অসুস্থ। সারাদিন জ্বরে কাবু।রাতে তার মা সুমিতাও অসুস্থ হয়ে যায়। লিটল ম্যাগাজিন মেলায় আমার বা হাত কেটে গেলো।তারপর ইনজেকশন মেডিসিন নিলাম।এ এক ঘোর কুয়াশাময় জীবনচরিত আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে সময়।


পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কর্ম ভূমিকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে উন্নিত করা হোক.বললেন ড: কাশীনাথ চ্যাটার্জি

৩১ জুলাই২০২৩:জামতাড়া শহরের সেন্ট অ্যান্থনী বিদ্যালয় চত্বরে তিন দিনের ঈশ্বরচন্দ্রবিদ্যাসাগর লিটল ম্যাগাজিন মেলার সাফল্যের জন্য আয়োজন সমিতির পক্ষ থেকে ওই সমিতির সভাপতি ড দীপক কুমার সেন সাধারণ সম্পাদক দুর্গা দাস ভাণ্ডারী ,ড কাশীনাথ চ্যাটার্জি ,পার্থ বোস ,চঞ্চল রায়  ,ড কাঞ্চন গোপাল মণ্ডল ও মিডিয়া ইনচার্জ ধনেশ্বর সিংহ রায় জেলার আপামর জনগন এর সহযোগিতার ভূয়সী প্রসংশা করেছেন ।

৩১:০৭:২০২৩

0 Comments