ত্রিপুরার
          এক নির্বাসিত রাজকুমার এক
                 উপেক্ষিত রাজবধূ   ।(২)     ।
          --------------------------------------------
 শচীন কর্তা মীরাদেবী পরিণয় বিতর্ক
-------------------_---------------------------------
১৯৩৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি,শচীন কর্তার বিয়ে হয়।রাজসিংহাসনের অধিকার থেকে বিচ্যুত হলেও,ছিলেন তো তিনি রাজকুমার।ত্রিপুরার রাজ পরিবারের প্রথা অনুযায়ী বলা উচিত 'মহারাজকুমার '।কিন্তু শচীন কর্তা সেই কুলগৌরব নিজের হাতেই ছিন্ন করে দিয়ে তিনি লিখতেন - কুমার শচীন দেববর্মণ।

কলকাতায় তাঁদের বিয়েতে কোনো রাজকীয় ঠাটবাট ছিল না। হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে কর্তার বিয়েতে কর্তার মা,দাদা - বৌদিরা উপস্থিত থাকলেও,প্রথা অনুযায়ী রাজকুমারের বিয়েতে রাজবাড়ীর তরফে রাজ প্রতিনিধি হয়েও কেউ উপস্থিত ছিলেন না।(পিতা নবদ্বীপচন্দ্র অবশ্য ১৯৩১ সালেই প্রয়াত হোন)।এ রাজ্যের কুলোবধুরা ' রাণী ' হিসেবে সম্বোধিত হোন,কিন্তু মীরাদেবী সেই কুল সম্বোধন থেকেও বঞ্চিত হোন।প্রথানুযায়ী 
 বর - বধূকে রাজপ্রাসাদে আহ্বান করে বরণ করে নেওয়াও হয়নি।অথচ ত্রিপুরার প্রচলিত আইন ও প্রথানুযায়ী শচীন কর্তার  এই মর্যাদাটুকু প্রাপ্য ছিল কেনো না তাঁর পিতা মহারাজকুমার নবদ্বীপচন্দ্র রাজ সিংহাসনের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারের দাবিদার  ছিলেন।যাক সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

বিয়ের পরে শচীন কর্তা তবু মীরাদেবীকে নিয়ে রাজবাড়ীতে মহারাজ বীরবিক্রমের সঙ্গে  তাঁর সৌজন্য অনুযায়ী সাক্ষাৎ করতে এসেছেন।কিন্তু রাজার তরফে আনুষ্ঠানিক কুলাচার অনুযায়ী 
মীরাদেবীকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেওয়া হয়নি।

শচীন কর্তা এর পরেও আগরতলা রাজবাড়ীতে এসেছেন বার দু ',এক ,বড় মহারানী প্রভাবতী দেবীর অনুরোধে  আসরে গানও শুনিয়ে গেয়েছেন।

একবার মহারাজ বীরবিক্রমের দরবারি অনুষ্ঠানেও শচীন কর্তা তাঁর নিজের গুরু ওস্তাদ বাদল খাঁ ও তাঁর দুই পুত্রকে নিয়ে গানের আসরে যোগ দিয়েছেন।কিন্তু দেখা গেলো অনুষ্ঠানের পরে রাজকীয় প্রথা অনুযায়ী যে উদার  "গুরুদক্ষিণা" ওস্তাদ বাদল খাঁ ও তাঁর দুই সঙ্গীকে দেওয়ার কথা , কারও কুমন্ত্রণায় সেখানে নাম মাত্র অর্থ তুলে দেওয়া হয়,যা ওস্তাদ বাদল খাঁ র মর্যাদার ধারে কাছেও নয়।এই ঘটনায় শচীন কর্তা ভীষন  ভাবে অপমানিত বোধ করেন এবং স্বয়ং মহারাজার কাছে এর তীব্র প্রতিবাদও করেন।শুরু থেকে এভাবে অপমান ও অবজ্ঞা চলতে থাকায়,শচীন কর্তা ও তাঁর নব পরিণীতা বধূ মীরাদেবী সারা জীবনের জন্যে ত্রিপুরা ত্যাগ করেন।

এ ভাবেই তাঁর পিতা নবদ্বীপচন্দ্রও একদিন চরম অপমানিত বোধ করে মহারাজ বীরচন্দ্রের আমলে রাজ্যত্যাগী হয়েছিলেন। তারপর সুদীর্ঘ ৪০ বছর তিনি আগরতলার অনতিদূরে কুমিল্লায়  কাটিয়েছেন ,কেবল মাত্র বঞ্চনা ও অপমানের প্রতিবাদে। পরে অবশ্য দুই প্রজন্ম পেরিয়ে মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোরের আমলে তাঁর একান্ত অনুরোধে চার দশক বাদে এসে সাসম্মনে ত্রিপুরার রাজমন্ত্রীর গুরু দায়িত্ব সামলেছেন সগৌরবে।

         আজীবন বিষাদের আবহ
---------------------------------------------------
এবার সংগীত সাধনার প্রসঙ্গে ফেরা যাক।এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, শচীন কর্তার গানের ভুবনের অনন্য কান্ডারী হয়েও এই মীরাদেবী জীবনের প্রথম  ও শেষের প্রলম্বিত প্রহর পরম বিষাদের আবহ থেকে উঠে আসতে পারেন নি।কর্তার সুর ও সাধনার বহু অনন্য প্রহরের সাক্ষী,নিবেদিত প্রাণ এই সহযোগীর জীবন সায়াহ্নে চরম বিষন্নতা রীতিমত অভাবনীয়।

১৯৭৫ সালে শচীন কর্তার মৃত্যুর পর তিনি একে বারই একা হয়ে যান।এই দুঃসহ বেদনার ভার বইতে না পেরে লোকচক্ষুর অন্তরালে নিতান্ত 
অপরিচয়ের গণ্ডির  মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করেন।তারপর ১৯৯৪ সালে একমাত্র পুত্র রাহুল এর  মৃত্যুর পর সুরলোকের এই রাজরানী,অনন্ত প্রাণ মাতানো গীতিকাব্যের বিস্ময়কর স্রষ্টা, একেবারেই হারিয়ে গেলেন আমাদের বোধলোকের অমানিশার তিমিরান্ধকারে।পুত্রবধূ আশা ভোঁসলে তো বটেই ,বাংলা বা হিন্দি সংগীত জগতের তিন ভুবনের কেউ বহুদিন একেবারে খবরও রাখলেন না, প্রথিতযশা শিল্পী মীরাদেবী বেঁচে আছেন কিনা কিম্বা থাকলে কোথায় কী অবস্থায় আছেন,কেমন আছেন?

             
    

   মীরাদেবী ত্রিপুরার কুলবধূ, দায় 
           ছিল না আমাদের? 
           
---------------------------------------------------

  এ ব্যাপারে ত্রিপুরাবাসী হিসেবেও আমাদের চরম অবহেলা ও অবজ্ঞার অভিযোগ থেকে আমরা নিজেদের অব্যাহতি দিতে পারি না! সাংস্কৃতিক দায় ও দায়িত্বের এই বিশেষ ক্ষেত্রে আমাদেরও বোধের অমানিশা দীর্ঘ কাল গ্রাস করে রেখেছিল।আমরাও একবারের জন্যেও ভাবিনি যে ওই সুর লোকের  মহাসাধিকা তো আমাদেরই ত্রিপুরার কুলবধু,তাঁর প্রতি উত্তরপুরুষ হিসেবে, আমাদেরও কি কিছু মাত্র দায় দায়িত্ব নেই?ক্রমশ:

0 Comments