আনোয়ারা একটি ছোটনদী:আমি বলি আনোয়ারা নামের মেয়েটি 

গোবিন্দ ধর 

মেয়েটি বিষাদ বালিকা, তার ওষ্ঠে যে তিল তাতেই লেখা আছে মৃত্যুবাণ।


এক.

আমি যে গ্রামে বড় হয়েছি নাম তার রাতাছড়া। আমাদের বাড়ির চারিদিকেই সামনা। বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে সূর্য যে দিকে উঠে সেদিকে মুখ করে দাঁড়ালে বাম হাতে পড়ে করমছড়া কৈলাসহর রোড। এই রোডের ডানদিকে আমাদের ছোটবেলার ছবিগ্রাম রাতাছড়া।


দুই.

গ্রামের একটি ছড়া আছে। তাহার নাম রাতাছড়া। আমার পাঠশালা স্কুলের পাশ ঘেসে ছড়াটি চিকচিক বালুস্রোত বয়ে মনুর সাথে সঙ্গমে আসে।

তিন.

রাতাছড়ার ককবরক নাম রাতাছড়া। রাতা মানে ককবরকে পুরুষ মোরগ। রাজমালায় রাঝধর ছড়া কালক্রমে রাজধরছড়া- ক্রমে ক্রমে রাতাছড়া।

চার

রাজমালায় বলা আছে রাজধরের অভিষেক হয় মনুনদী নিকট রাতাছড়ায়। তারপর আফিম সেবনে আত্মনিবেদন করেন তাঁর পিতা।তারপর থেকে রাজধর ছড়াই আজকের রাতাছড়া।

পাঁচ.

আমার বাড়ির বাঁদিক বরাবর একটি ছোট হাওর এক কিমি অব্দি যাওয়ার পর টিলা হয়ে আছে। এই হাওর ধরে চোখ মুদে হাঁটলেও যাওয়া যায় গঙ্গানগর।

ছয়.

হাওর থেকে অজগরের মতো নামছে একটি নালকাটা ছড়া। তার নাম আনোয়াছড়া।

সাত,

আনোয়াছড়া নিয়ে জনশ্রুতি একটি প্রেমকাহিনী। একটি মেয়ের আত্মহত্যার গল্প। একটি মেয়ের স্বপ্ন, বিকেলের আগেই কি রকম হেজেমজে গেলো। একটি মেয়ের বুকের চারাগাছ অকালে মরে যাওয়া গল্প।

আট

বিকেল আসার আগেই তার মুখ থেকে সূর্য থেমে গেলো। রোদ ঝলমল মুখ থেকে ফেনিয়ে বেরিয়ে এলো পূরণ না হওয়া একটি ছোটগল্প যার নাম আনোয়াছড়া।

নায়

আনোয়ারা একজন সংখ্যালঘু মেয়ে। প্রেমের সখ্যতা তার ছিলো ছড়াজলের সাথে।


দশ

আনোয়ারা বেগম ছড়াজলে পা ডুবিয়ে প্রিয়সখার বুকে মাথা রেখে একটু ঘুমাতে চেয়েছিলো। চারজন নিরক্ষর তার স্বপ্ন কেড়েনিলো। জলের স্রোতের মতো মিশে গেলো জলে মেয়েটি। মেয়েটি জলে গুলে গেলো। অকালে মরে যাওয়া গল্প।


এগারো 

ছোট ছোট টিলার জল লাফিয়ে লাফিয়ে সাগরের ঢেউ যতো। জলের স্রোত সব কেড়ে নেয় মানুষের পুকুর ডুবা ডুবুডুবু । হাওর জলে জলাকার। জলকাতর মানুষেরা জলবন্দি। জল নামছে জল নামছে জলের তোড়ে সব ভাসিয়ে নিলো। মেয়েটি। আনোয়ারা নামের মেয়েটিও। দুই টিলার ফাঁক বরাবর নামছে জল। বাড়িঘর সব ভাসিয়ে জল নামছে।

বারো,

একজন সংখ্যালঘু মেয়ের নাম আনোয়ারা। একজন মেয়ে মানুষের নাম আনোয়ারা। একজন প্রেমিকার নাম আনোয়ারা। একজন মানুষের নাম আনোয়ারা। একটি অপূর্ণতার নাম আনোয়ারা। একটি সবুজ ফুলের নাম আনোয়ারা। একটি ছড়াজলের নদীর নাম আনোয়ারা। একটি জীবনের নামে আনোয়ারা। আনোয়ারা আসলে একটি প্রতিবাদও।

তেরো,

কপট ভালোবাসার কাছে জীবন দিয়েছে আনোয়ারা বেগম?

নাকি সমাজ করেছে নিষিদ্ধ এই প্রেম? লোকমুখে গালগল্প ফিসফাস তার প্রেম বুকে নিয়ে কলকল শিৎকারে জল যায় মনুর নিকট।

চৌদ্দ 

নিজেকে লুকাতে গিয়ে মেয়েটি তার সব কোমায় লুকালো। আনোয়ারা তো একটি মেয়ে শুধু নয় একটি সময় একটি সকাল। তার সূর্য তো শেষ  হবে না কখনো। সমাজ বদলের সলতে সে রোপন করেছিলো।

পনেরো,

ধীরে ধীরে মেয়েটি অভিমানে মিশে যায় ঘোলাজলে। দূরে বসে কেউ একজন পাঁজরের হাঁড়ের ভেতর কনকনে শীত টের পায়। মেয়েটির কোন রোগ ছিলো না। মেয়েটির ভালোবাসা ছিলো নিখাদ কেউ একজন কেড়ে নিলো মেয়েটির সকল পাখি।


ষোলো.

মেয়েটি পাখি ছিলো
মেয়েটি স্বপ্ন বুনতো আকাশের মতো
নানান রঙ্গের।
সব রঙ জলে মিশে জলাকার
মেয়েটি জলের মত
কলকল বয়ে যায় নদীর কাছে।
নদীও নারীর মতো
আনোয়ারা একটি ছোটনদী
ভিরতির প্রবাহিত।

সতেরো.

আনুয়ারা একটি নদী ও মেয়ে। তার শিৎকার শুনি মাঝরাতে। তিরতির তার কল্লোল বজ্র নির্ঘোষ।

আঠারো.

সব পথ নদীতে এসেই মিশে যায়। নদীই সাক্ষী থাকে প্রকৃত প্রেমের আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টিজল বয়ে নিয়ে সাক্ষী রইলো আনুয়ারার লোকশ্রুতি।

0 Comments