মনু নদী : লোককথা, ইতিহাস ও স্মৃতিতে উজ্জ্বল আমার অবগাহনবেলা || গোবিন্দ ধর
মনু নদী : লোককথা, ইতিহাস ও স্মৃতিতে উজ্জ্বল আমার অবগাহনবেলা
গোবিন্দ ধর
সুপ্রাচীন বায়ুপুরাণে ত্রিপুরার মনুনদীর উল্লেখ পাচ্ছিঃ
"সমুদ্রস্যোত্তরে দেশে ততো মনুনদী স্মৃতঃ ।
যং গত্বাপি মহারাজন্ পীত্বা পানীয়মুত্তমম্ ।।
মনুনদ্যাং মহারাজ বরবক্রেণ সঙ্গমম্ ।
তত্র স্নাত্বা নরোযাতি চন্দ্রলোকমনুত্তমম্ ।।" --
অস্যার্থঃ - সমুদ্রের (বঙ্গোপসাগরের) উত্তরদিকের ভূভাগে মনুনদী প্রখ্যাত, যেখানে গিয়ে মহারাজ (মনু -- পুরাণকথিত সেই রাজর্ষি) উত্তম জলপান করে বরবক্র ( বরাক) নদীর ও মনুনদীর মিলিত মধ্যবর্তী উপত্যকায় তপস্যা করেন । সেই মনুনদীতে স্নান করলে মানুষ মৃত্যুর পর শ্রেষ্ঠ চন্দ্রলোকে গমন করে ।
আহা, আমার প্রিয় নদীটির কতো মাহাত্ম্য ।
[ঋণঃ পান্নালাল রায় ও সুজিত দেব]
সভ্যতা নদীমাতৃক, নদীকেন্দ্রিক। কৃষি-ফসল-হাসি-কান্না-প্রেম-পুজো-আবেগ আর মৃত্যুর ছবি নদীর সঙ্গে চিরকালের সম্বন্ধ। মনু তীরবর্তী মানবসভ্যতায় জলের অফুরান যোগান দিচ্ছে মনু। শেষ বিকেলে তার তীরের চিতাবহ্নি লহমার জন্যেও স্তব্ধ করছে উচ্ছ্বাস চপলতার। জীবন আর মরণের দুই ডালি নিয়ে নিরন্তর গতিতে মনু এগিয়ে চলেছে মিলন সঙ্গমে।
ত্রিপুরার দীর্ঘতম নদী মনু উত্তরবাহিনী। দক্ষিণ দিকে শাখান পাহাড়শ্রেণীর পশ্চিম ঢাল থেকে বেরিয়ে ১৬৭ কিমি. পথ অতিক্রম করে এটি মিশেছে বাংলাদেশের কুশিয়ারায়। তারপর পদ্মার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে। মনু নদীর উৎস অংশের নাম ছামনুগাঙ। মালধারছড়া, ছইলেংটাছড়া, মতিছড়া, কাঞ্চনছড়া ও লক্ষ্মীছড়া, মনুর ডানদিকের ফটিকছড়া, ধনবিলাসছড়া ইত্যাদি। কাঞ্চনপুর মহকুমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত দেও নদীও কুমারঘাট মহকুমার হালাইমুড়াতে মনুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
ঊনকোটি মনু তীরবর্তী তীর্থভূমি। ভূতাত্ত্বিকরা বলেন পূর্বে মনু ঊনকোটির আরও নিকটবর্তী ছিল। ত্রিপুরানৃপতি রাধাকিশোর মানিক্যের (১৮৯৬-১৯০৯) সভাপণ্ডিত চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ 'শ্রীশ্রীযুতের কৈলাসহরভ্রমণ' পুস্তিকায় লিখেছেন: 'অধুনা মনু প্রায় এক মাইল পশ্চিমে সরিয়া গিয়াছে।'
অতীতে যখন উন্নত রাস্তাঘাট ছিল না তখন উত্তর ত্রিপুরার যোগাযোগ সহ পণ্য পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম ছিল এই নদী। লোকশ্রুতি, ৬০ বছর আগেও কৈলাসহর বাজারের ঘাটে এসে ভিড়তো বড় বড় নৌকো। নদীর ঘাটে হতো বিকিকিনি। নৌকায় করে নদী পারাপার। জোছনা রাত, মাঝির গান আর জলের ছল ছলাৎ রচনা করত মায়াময় পরিবেশের।
ত্রিপুরার দীর্ঘতম নদী মনু। প্রায় ১৬৭ কিমি. দৈর্ঘ। উৎপত্তিস্থল শাখানটাং। এই শাখানটাং পাহাড় থেকে তিরতির ছুটে উত্তরে প্রবাহিত হয়ে ছাওমনু, মনুঘাট, ৮২ মাইল, কাঞ্চনবাড়ি, বেতছড়া, নতুনবাজার, রাতাছড়া, ফটিকরায়, জলাই ও কৈলাসহরের ওপর দিয়ে মনুর মুখ বর্তমান বাংলাদেশের কুশিয়ারা নদীতে মিশেছে। বর্তমান কুমারঘাট অর্থাৎ পাবিয়াছড়া ও লালডহর অঞ্চলের পাশে মনুর সাথে এসে দেও মিশেছে। ত্রিপুরার আদিবাসী হালাম সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি লোককাহিনী প্রচলিত আছে উত্তরের মনু, দেও, লংগাই ও ধলাই নদীকে নিয়ে।
দেও, লঙ্গাই ও ধলাই ছেলে। আর মনু মেয়ে। দেও, লঙ্গাই ও মনুর একই গ্রামে জন্ম। তারা একসাথে তিনটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় সমবয়সী। ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে রূপবতী মনুর রূপে দেও ও লঙ্গাই প্রেমে পড়ে। মনুও দেও-লঙ্গাই'র প্রেমে পাগল। পরস্পর মন দেওয়া নেওয়া, ভাব জমতে জমতে একসময় গ্রামে জানাজানি হয়ে যায় তাদের কথা। মনুর বাবা খুব প্রতাপশালী ওঝা, খুব তেজী। তিনি এসব সহ্য করতে না পেরে পাশের গ্রামের যুবক ধলাই বা চল্লির বাবার কাছে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। যথাসময়ে বিয়েও ঠিক হয়। রূপবতী মনু এই খবর জেনে দেও ও লঙ্গাইকে বলে- 'দেখো, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। আর বাবা যখন বিয়ে ঠিক করেছেন তখন বিয়ে দেবেনই। এই অবস্থায় তোমরা কিছু করো।' দেও ও লঙ্গাই ভীষণ চিন্তিত। একে অপরের দিকে চেয়ে থাকে। এখন কী উপায়?
মনু বলল, একটা উপায় ঠিক করো।... একটা উপায় অবশ্য আছে। চলো, আমরা পালিয়ে যাই। বিয়ে করি। মনুর কথা শুনে দেও বলল, তা কি করে সম্ভব। এক মেয়ের সাথে দুই পুরুষের বিয়ে সম্ভব নয়। মনু তখন বলল, দেখো, আমার পক্ষে কাউকেই ছাড়া সম্ভব নয়। হয় দুজনকেই বিয়ে করব, অন্যথায় আত্মহত্যা ছাড়া উপায় নেই।
ধার্মিক লঙ্গাইও চিন্তায় পড়ে গেল। কি করা, কি করা, কোনো উপায়ান্তর নেই। এদিকে মনুকে কেউ ছাড়তে পারছে না। মনুও দুজনকেই বিয়ে করতে চায়। কারণ দেওকে গ্রহণ করলে লঙ্গাই কি দোষ করল। লঙ্গাইকে বিয়ে করলে দেও কি দোষ করল? এই ত্রিকোণ প্রেমে কেউ কাউকে বাদ দিতে পারছে না। এই অবস্থায় বেশি ভাবনারও সময় নেই।
শেষপর্যন্ত মনু প্রস্তাব দিল-দেখো, আমি কাউকে বাদ দিতে পারব না। কারণ, এইভাবে বাদ দিলে আমার মনে এক অপরাধবোধ সারাজীবন কষ্ট দেবে। তার চেয়ে এক কাজ করি। আগামীকাল মোরগের প্রথম ডাকের সাথে সাথে তৈরি হও। আর দ্বিতীয় ডাক দিলে ঘর ছেড়ে পশ্চিম দিক বরাবর বেরিয়ে পড়ব। যে আমার সাথে আগে দেখা করবে, যেখানে দেখা করবে, সেখানেই আমরা বিয়ে করব। মনুর প্রস্তাবে দেও ও লঙ্গাই পরস্পর চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে। প্রস্তাবটা মন্দ নয় ভেবে তারা রাজি হয়।
রাত হল। কারও চোখে ঘুম নেই। কখন রাত শেষে মোরগ ডাকবে। সূর্যোদয় হবে, ঘর ছাড়বে। কার সাথে দেখা হবে প্রথম। কার ভাগ্যে ওই রূপবতীকে বিয়ে করা সম্ভব।
মনুও ভাবছে, কার গলায় মালা দেবে? কাকে স্বামীরূপে পাবে? কাউকেই তো ছাড়তে পারছে না। ভাবতে ভাবতে আধো ঘুম আধো জাগরণে সারারাতের পর প্রথম মোরগ ডাক দিল। সাথে সাথে মনু ক্ষিপ্র গতিতে হাতের কাছে যা আছে, জামাকাপড় গুছিয়ে হাতমুখ ধুয়ে প্রস্তুত। দ্বিতীয় ডাক দিতেই বেরিয়ে পড়ল।
দেওও যথারীতি হাতমুখ ধুয়ে ঝড়ের বেগে প্রস্তুত হয়ে দ্বিতীয় ডাক দিতেই পশ্চিম দিকে বেরিয়ে পড়ল।
এদিকে লঙ্গাই তো ধীরস্থির। প্রথম ডাকে উঠল। হাতমুখ ধীরে ধীরে ধুয়ে এল। তারপর একটু ঠাকুর দেবতাদের নামধ্যান করে দ্বিতীয় ডাকের সময় জামাকাপড় কোন্টা নেবে কোন্টা না, ভেবেচিন্তে ঠিক করে সূর্যোদয়ের আগে পশ্চিমদিকে বেরিয়ে পড়ে।
তখনই একটু দূরে মনুর সাথে দেও দেখা করে। দুজন দুজনকে বিয়ে করে। মনুর মনে পরম শান্তি আসে। তার অনুতাপ, পাপবোধ আর নেই। পরম শান্তি আছে শুধু।
এদিকে লঙ্গাই পশ্চিম দিকে যেতে যেতে পথে দেখা পেল তিতির পাখির। তিতির পাখি লঙ্গাইকে ডেকে বলল-ভাই, এত হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছ? লঙ্গাই মনুকে বিয়ে করতে যাচ্ছে বলল। তখন তিতির পাখি বলল, সেই এইমাত্র দেখে এসেছে মনুর সাথে দেও-এর বিয়ে হয়ে গেছে। প্রথমে লঙ্গাই বিশ্বাস করেনি। তিতিরের দিকে একদৃষ্টে করুণভাবে চেয়েই রইল। তিতিরপাখি বলল, আমি সত্যি বলছি, দেও ও মনুর বিয়ে হয়েছে। কথাটা বিশ্বাস কর।
আমি এখনও দানাপানি কিছুই খাইনি। নিজের চোখে দেখে এসেছি তাদের বিয়ে। এবার লঙ্গাই বিশ্বাস করল তিতিরের কথা।
লঙ্গাই চুপচাপ বিরস মুখে দাঁড়িয়ে থেকে মনের কষ্ট চেপে রেখে মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে অতি কষ্টে বলল, তা ভালোই হল। আমার প্রিয় বন্ধু দেও। তাই এই বিয়েতে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি খুব খুশি। এই কথা বলে লঙ্গাই তার গতিমুখ বদলে উত্তরের দিকে চলে গেল।
গ্রামের মধ্যে সকাল হতেই হৈ চৈ কাণ্ড। মনু নেই। দেও নেই। লঙ্গাই নেই। তারা কোথায় গেল। কোথায় পালিয়ে গেছে কেউ জানে না। গ্রামের লোক প্রকাশ্যে অকথা-কুকথা বলাবলি করতে লাগল।
এই সময় দক্ষিণের গ্রাম থেকে লংতরাই-এর বাড়ির লোকজন ও হবু জামাই চন্দ্র-সব মনুর বাড়ি কন্যাপণের সামগ্রী নিয়ে হাজির। তারাও এসব জানে না। মনুর বাবা অনেক তর্জন গর্জন করে চল্লি অর্থাৎ ধলাইকে ডেকে বললেন-যাও বাপু, তুমিও যাও, মনুকে এক্ষুণি খুঁজে আনো। চুলের মুঠি ধরে নিয়ে আসবে।
অনেক খোঁজাখুঁজির পরও কেউ মনুকে পেল না। তেমনি পাওয়া গেল না দেও ও লঙ্গাইকেও। লোকমুখে জানা গেল তারা তিনজনের বিয়ে হয়ে গেছে। মনুর বাবা এখন অগ্নিশর্মা। রেগে লাল। একমাত্র মেয়ে শেষপর্যন্ত মুখ পুড়িয়ে ছাড়ল। এবার গুণিনপিতা চরম প্রতিশোধ স্পৃহায় একটি তান্ত্রিক পুজোর আয়োজন করে মন্ত্রতন্ত্র জপ করতে করতে মনু, দেও ও লঙ্গাইকে অভিশাপ দিতে লাগলেন। অলস নিষ্কর্মার ঢেঁকি চল্লিকেও বাদ দিলেন না। এই অভিসম্পাতের কারণে একসময় মনু, দেও ও লঙ্গাই মানুষ থেকে সত্যি নদীতে বদলে গেল। তখন থেকে মনু চলছে, দেও চলছে, লঙ্গাই চলছে। তিরতির প্রবাহে।
এই তো গেল লোককথা। আরো অনেক কাহিনী আছে মনুকে নিয়ে
ত্রিপুরার ইতিহাস ঘাঁটলে মনু নদী সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। বারবার ত্রিপুরার রাজমালায় মনু এসেছে। ত্রিপুরার মহারাজা অমর মানিক্য উত্তর ত্রিপুরার রাতাছড়ায় রাজধানী স্থানান্তর করেন, আরাকানীদের আক্রমণে পরাজিত হয়ে। মনু নদীর তীরে রাতাছড়ায় পুত্র রাজধর মানিক্যের অভিষেককর্ম সমাধা করে মনু নদীতে নৌভ্রমণের সময় আফিং খেয়ে আত্মহত্যা করেন ভাগ্যবিপর্যস্ত অমর মানিক্য। সেই থেকে রাজধরছড়া নামে এই অঞ্চল প্রসিদ্ধি লাভ করে। 'যেই স্থানে রাজধর হৈল নরপতি। সেই ছড়া নাম ধরে রাজধরখ্যাতি।' কালের স্রোতে একসময় রাজধরছড়া, রাতাছড়া নামে অভিহিত হয়।
কৈলাসহরের ঊনকোটি তীর্থ মনু নদীর তীরে অবস্থিত। রাজমালায় তৈদাক্ষিণ খণ্ডে রয়েছে-
'মনুনদী তীরে মনু বহু তপ কৈল/তদবধি মনু নদী পুণ্যনদী হৈল।'
শ্রীরাজমালা সম্পর্কে কালীপ্রসন্ন সেন লিখেছেন:
... যোগিনী তন্ত্র, ঊনকোটি তীর্থমাহাত্ম্য, এংব বায়ুপুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থে মনুনদীকে পুণ্যনদী বলা হয়েছে-
সমুদ্রস্যোত্তরদেশে তত্যে মনুনদী কৃত্য।
যং গত্বাপি মহারাজ পীত্বা পানীয়মৃত্তমম্।।
মনু নদ্যাং মহারাজ বরবক্রেন সঙ্গমম্।
তত্র স্নাত্বা নব্যে যাতি চন্দ্রলোকং মনুত্তমম্।।
(বায়ুপুরাণ)।
উত্তরের জলপ্রবাহে মনুনদী এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। আমার জীবনের পঁয়ত্রিশ বছর কাটিয়েছি রাতাছড়ায়, মনুনদীর তীরে। আমার ছোটবেলা থেকে জীবনের ধাপে ধাপে মনু আমাকে গড়েছে।
বাঁক নিয়েছে মনু নদী, যেভাবে সেই উৎস থেকে মোহনা অবধি বার বার বাঁক নেয়, সেভাবেই। আমার দেখা মনু, বর্তমান রাতাছড়ার যে স্থান দিয়ে প্রবাহিত, সেখানে ছিল না। তা থেকে প্রায় আধমাইল দক্ষিণে স্বর্গত গোপিকারঞ্জন রায় মহাশয়ের বাড়ির পাশের টিলা ঘেঁষে ছিল। ধীরে ধীরে আমার কাছে, আমাদের কাছে আসতেই যেন, ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে বর্তমান রাতাছড়া চৌমুহনী বাজার সংলগ্ন আমাদের বাড়ির পাশে চলে এসেছে। একসময় আমাদের গ্রাম ছিল বর্তমান কুমারঘাট, ফটিকরায়, কাঞ্চনবাড়ি, বিরাশিমাইল, নতুনবাজার, বেতছড়া, এমড়াপাশা সহ সমগ্র অঞ্চল থেকে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে উন্নত। শিক্ষায়ও আর দশ গ্রাম থেকে অনেক অনেক এগিয়ে। তখন নদীনির্ভর জীবনযাত্রায় রাতাছড়ার আমতলী বাজার ছিল পার্শ্ববর্তী দূরবর্তী সব অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র। আজ সব অতীত। কিন্তু আমার স্মৃতিরেখায় উজ্জ্বল কিছু স্মৃতি মনুনদীকে ঘিরে স্রোতের মতো আবহমান কাল ধরে প্রবাহিত হবে।
আমাদের বাড়িতে তখন চাকর-বাকর, ঝি-মাসি অনেক লোক নানা কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তাদের সাথে আমাদের
আত্মিক সম্পর্ক। কেউ জেঠু, কেউ কাকু, দাদা, জামাইবাবু, কেউ বা শুধু রহমতভাই, ইয়াচিন ভাই, তাকে নিয়ে মনু
নদী সংশ্লিষ্ট একটি স্মৃতি আমাকে দিয়ে লিখিয়েই ছাড়ছে। রহমতভাই শুধু আমাদের গো-মহিয় পালন করত। বর্ষায়
বড় বাঁশবেতের ছাতা মাথায় তার সেই কষ্ট কষ্ট মুখ নিয়ে গো-মহিষ চারণ আমার এখনও মনে পড়ে। সে থাকত
আমার বড়দার ঘরের সাথে পার্টিশান দেওয়া অন্য ঘরে। এক রাতে সে খাওয়া-দাওয়া করে যথারীতি ঘুমালো।
সকালে আর মহিষ মাঠে ছাড়ছে না। তাই দেখে বাবা-মা, কাকা সবাই ডাকাডাকি করছে, কিন্তু তার সাড়া নেই।
সেই ঘর বাইরে থেকে লাগানো ও খোলা যেত। ডাকাডাকিতে সাড়া না দেওয়ায় বাইরে থেকে ঘর খুলে দেখা গেল
সব জিনিসপত্তর নিয়ে বাইরে থেকে ঘর সেঁটে সে পালিয়েছে। অনেক খোঁজাখুজির পরও তাকে আর পাওয়া
গেলনা। তার বাড়ি ছিল কুমারঘাটের বর্তমান আম্বেদকর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। তার জন্য আমার দীর্ঘদিন
মনখারাপ ছিল। মনে মনে আজও তার ছবি আমি ভুলতে পারিনি।
একদিন হলো কি, তাকে দেখি মালপত্তর বোঝাই বড় নৌকার গুণ আমাদের বাড়ির পাশ-ঘেঁষা মনু নদীর উজানে টানছে। আমি তাকে জাপটে ধরে অনেক অনুরোধ করেছি আমাদের বাড়ি ফিরে আসার জন্য। কিন্তু সে আর আসেনি। অবশ্য রহমত ভাই আমাকে সেই নৌকায় তুলে আদর করে অনেক দূর রাতাছড়ার (ছোট নদী) মুখ অব্দি প্রথম নৌকা চড়ার আনন্দ দিয়েছে। সেই আনন্দ অদ্যাবধি আমাকে আর কেউ দিতে পারেনি। সেই দিন সেই বড় নৌকায় অনেক মালপত্র ছিল। কোনো এক মহাজনের ব্যবসা সামগ্রী। কিন্তু রহমত ভাই আমাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে বড় নৌকায় গুণটানার কাজ নেওয়ায় তার যে পরিশ্রম হতো, আজ মনে হচ্ছে তুলনায় গো-মহিষ চারণ অনেক বেশি আরামদায়ক ও আনন্দের ও কম পরিশ্রমের ছিল। তাই তার আমাদের বাড়ি ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্তকে আজ অব্দি মেনে নিতে পারিনি।
ছোটবেলা থেকে দেখছি, মনু গুটি গুটি পায়ে ধেয়ে আসছে আমাদের বাড়ির দিকে। মনুর চর থেকে অনেক কাঠ জ্বালানির জন্য সংগ্রহ করতাম। রহমতভাই যখন অনুপস্থিত তখন সে দায়িত্ব কিছু কিছু করে আমাদের ওপর আসতে শুরু করল। মনুর চরে আমি মহিষের লেজ ধরে ওপার-ওপার হতাম মহিষ চরাতে। একসময় মনু বাঁক নিয়ে ঝিল ছেড়ে কিছু দূরে চলে গেল। সেই ঝিলে বাবা বঁড়শিতে মাছ ধরতেন। কাৎলা, রুই, মাগুর, বড় বড় কাৎলা, কই বঁড়শিতে ধরতেন। একদিন তো এক রুই বাবাকে টেনে ঝিলেই ফেলে দিল। বাবাও নাছোড়, রুই ধরলেন তো হাঁপ ছাড়লেন। অনেক স্বাদ ছিল এই মাছে। ঝিল থেকে প্রথম বর্ষায় একসাথে সব মাছ যেন ড্রেন দিয়ে মাছ-স্রোত হয়ে মনুতে মিশে যাচ্ছে। সে দৃশ্য কত মনোরম। না দেখলে বোঝানো যাবে না। আমরা প্লেনজাল, হাতজাল দিয়ে কই, ঘুঙ্গি, পুঁটি ধরতাম তখন। খুব আনন্দ লাগত।
মনু আবার ঠিক ধীরে নয়, কিছুটা চপল মেয়ের মতো আঁকাবাঁকা হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বাড়ির কাছে চলে এল। আসতে আসতে আমার ছোটবেলার বন্ধু আব্দুল মতিন, বদরুল হোসেন আরো কতজনের বাড়িঘর তার গর্ভে নিয়ে নিল। মনু তবু চঞ্চল। গর্ভে নিল একে একে রাতাছড়ার প্রথম বিদ্যালয়কে, আমতলী বাজার, যার জন্য অহংকার ছিল এই অঞ্চলের, মক্তব মাদ্রাসা, কো-অপারেটিভ, কৃষি অফিস সহ অসংখ্য মানুষের ঘরদোর।
আমতলী বাজারে তখন যাত্রা হতো, পুতুলনাচ হতো। সার্কাস দল আসতো। স্থানীয় যাত্রাপালাতে কৈলাসহরকেও টেনে আনতো এই অঞ্চলে। মানুষের মনে সংস্কৃতির চেতনা ছিল। রাতাছড়ার প্রায় প্রত্যেক ঘরের পুরুষ কেউ না কেউ যাত্রাপালায় অভিনয় করেছেন। একসময় কলকাতার নাট্যদল, যাত্রাদল রাতাছড়ার আমতলী বাজারে যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করেছেন। আজ সব স্মৃতি। আমতলী বাজার আর নেই। মনু সব কেড়ে নিল।
মনুর ভাঙাগড়া চলছে। আমাদের মনেও চলছে ভাঙাগড়া, বাঁক। গরমের দিনে তবুও ক্লান্তি দূর করতে মনুতেই বারবার লাফিয়ে লাফিয়ে পড়তাম। কত লাই (জলখেলা) খেলতাম। ডুবসাঁতার। ডুব দিয়ে লাইখেলার আনন্দ ভোলা যায় না। বিশেষত ছোটবেলায় সর্দিজ্বর হতোই না, এতো সব জলডুবের পরও।
বন্যায় মনুর জল বেড়ে আমাদের বাড়িতেও বারকয়েক হাঁটুজল থেকে গলাজল হয়েছে। যখন জল নামে বাড়ির উঠোনেও মাছ ধরার আনন্দ। তাজা মাছ সাথে সাথে ভাজা। গরম গরম, কি স্বাদ। মুখে লেগে আছে।
বন্যা হলেই মনুতে ভেসে আসতো নানারকম লাউ-কুমড়ো। আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তাম। কার আগে কে গিয়ে ধরবে, এক প্রতিযোগিতা। আর আসতো কাঠ (লাকড়ি)। তখন তো লাকড়ি ধরতাম। সারাদিন ক্লান্তিহীন লাকড়ি ধরা। সাঁতার দিয়ে লাকড়ি ধরার অভিজ্ঞতাও আনন্দের। লাকড়ি কাঁধে করে বাড়িতে আনতেই পরিশ্রম হতো।
বন্যার শেষে সারা চর জুড়ে পলি পড়ত। জল নামার সাথে সাথে ছিটিয়ে দিলেই উর্বর মাটি পেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ধানগাছ মাথা তুলে দাঁড়াত, সারা চর সবুজে ভরে যেত। তারপর সোনালি ধান। চোখ জুড়ে আনন্দস্রোত প্রবাহিত হতো। ঝিলে আসত অতিথি পরিযায়ী পাখি। নদীর চরে মহিষের পিঠে চড়ে চরাতাম। সারাদিন চরালেও যেন ক্লান্তি নেই। মনুর চরে মহিষ চরানোর ফাঁকে গাছের নিচে কিংবা কাশবনে বসে ক্লাসের পড়া শেষ করতাম।
সেই সব দিন আর ফিরে আসবে না। মনে হলে আনন্দ ও কষ্ট পাশাপাশি মনুর স্রোতের মতো প্রবাহিত হয় আজও।
শরৎকালে মনুর চরে কাশফুল। আহা কি সুন্দর। চোখ জুড়িয়ে যেত। এখনও কাশ ফুটলে শরৎ আসে। ধীরে ধীরে প্রকৃতি তার রূপ ছড়ায় নতুন রঙে। আমাদের বাড়ি থেকে দক্ষিণের জানালায় চোখ তুলে তাকালে শুধু সাদা আর সাদা। চোখে সে কি প্রশান্তি-আজও মনে পড়ে।
মধ্যবিত্ত মৎস্যজীবিদের জীবনের উৎস মনু নদী। যদিও কিছু মানুষ নদীকে দুষিত করছে মৃত গো-মহিষ জলে ভাসিয়ে। নদীতে বিষ দিয়ে মাছ ধরছে। এতে আগামী দিনে যে মাছ আরও খাদ্য যোগান দিত, তা আর হচ্ছে না। এতে খাদ্য নষ্ট হচ্ছে। মাছের সাথে সাপ, ব্যাঙ মরছে। প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। জল হচ্ছে দূষিত। নদীনির্ভর মানুষেরা দূষিত জল ব্যবহার করে নানা রোগের শিকার হচ্ছে। মনুকে তাই দূষণমুক্ত রাখতে হবে।
শীতে মনুতেই স্নান করতাম, বাবার সাথে। মনুতেই আমার সাঁতারের চন্দ্রবিন্দু পর্ব। যদিও বাড়ির পুকুরে অ-আ-ক-খ।
ধীরে ধীরে জীবনের ছোটবেলার বেলাশেষে, স্কুলের পাঠ শেষে, কর্মজীবনের আরম্ভ। মাঝামাঝি পর্যন্ত জীবনের অধিকাংশ সময়ই মনু যেমন বিভিন্ন ভাঙাগড়ায় বাঁক নিয়েছে, আমারও বাঁক নেওয়া জীবন তরঙ্গায়িত হতে হতে প্রবাহিত। নদীকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা থেকে বর্তমান সময় সড়ককেন্দ্রিক হয়ে গেল। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনেও চলে এল নতুন বাঁক। এখন জীবনযাত্রায় আর তেমন নদীকেন্দ্রিকতা নেই। কিন্তু নদী মানুষের আজীবনের বন্ধু ছিল। আজও আছে। আগামী দিনও তার প্রভাব বাড়বে বৈ কমবে না। হয়তো অর্থনীতির মানদণ্ডে খালিচোখে তার প্রভাব অনেক দূর অব্দি দেখা যাবে না। কিন্তু তার সুফল সুদূরপ্রসারী। মনু আজও বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষকের মনের মণিকোঠায় বাঁচার চাবিকাঠি। জেলেদের জীবনের উৎস। বর্তমান ক্যানেল যখন মনুর জলবন্টন সুষ্ঠুভাবে করবে তখন কৃষক তার সুফল পাবেন। যদিও অতি নিম্নমানের ঠিকেদারি কাজে কতটুকু সুফল ঘরে আসবে আমরা জানি না। তবু এক বুক প্রত্যাশা তো বুকে আছে। সময়ই বলে দেবে তার আসল কুশল। ততদিন আমাদের অধীর প্রতীক্ষা। নদীনির্ভর এই প্রতীক্ষা অনন্তকাল প্রবাহিত হবে মনুর স্রোতের মতো।
0 Comments