কবি ও কথাকর্মী গোবিন্দ ধরের মুখোমুখি অসমিয়া ভাষার কবি ড.আরমেদা আহমেদ
কবি ও কথাকর্মী গোবিন্দ ধরের মুখোমুখি
অসমিয়া ভাষার কবি ড.আরমেদা আহমেদ
(১)পরিচিতি দাও?
গোবিন্দ ধর : সম্পাদক 'স্রোত' পত্রিকা ও প্রকাশনা।কথাসাহিত্যিক রামকুমার মুখোপাধ্যায় সংখ্যাটি সহ পত্রিকাটির মোট ৭৮ টি সংখ্যা এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। কয়েকটি বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশিত হয়েছে। জীবিকা, ত্রিপুরার গজেন্দ্রকুমার অমূল্যবালা নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এখন পর্যন্ত মোট ১০টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে 'জলঘর',সূর্য সেন লেন, 'দ্রোহবীজ পুঁতে রাখি',মনসুন মাছি, 'শ্রীচরণষু বাবা' লিখি দ্রোহবীজ,চাঁদশুক্র,চাঁদমুখ,আনোয়ারা নামের মেয়েটি, দেওনদী সমগ্র এবং নির্বাচিত কবিতা ইত্যাদি।গবেষণাধর্মী গ্রন্থ শ্রীহট্টীয় লৌকিক সংস্কৃতি ও শব্দকোষ। এছাড়াও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩০ টির বেশি।
(২) তুমি কখন থেকে কবিতা লিখো?
গোবিন্দ ধর:ছোটবেলা থেকেই। তখন বুঝতেই পারিনি আমি কবিতা লিখি।প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সাল।স্কুলের খাতায় আঁকতাম লিখতাম। খাতা শেষ হয়ে গেলে কবিতাও আর সংরক্ষণ করে রাখার অভ্যেস ছিলো না। যা এখনো নেই।
(৩)প্ৰেম, আঘাত, অন্যায়, অবিচার বলতে কি কিছু আছে ?তোমার প্রিয় বিষয়?
গোবিন্দ ধর:প্রেম অফুরন্ত। অন্যায় আপেক্ষিক। অবিচারও আপেক্ষিক। এগুলো একেকজনের কাছে একেকরকম। প্রিয় বিষয় বারবার ঠগে গিয়েও মানুষকে পুনরায় বিশ্বাস করে ফেলা।আবার বাঁশ খেয়েও মনে বাঁশ করুলের গোদকের টেস্ট-ই বাঁশের অরিজিনাল স্বাদ।
(৪) জীবনে কিসের প্ৰয়োজন বেশি অৰ্থ না ভালোবাসা?
গোবিন্দ ধর:আমি অর্থের চেয়ে ভালোবাসার কাঙালপনায় অপরিসীম ধৈর্য ও শক্তি নিহিত আছে মনে করি।আমার নিকট ভালোবাসার বিকল্প নেই। অর্থ বিত্ত বিতর্ক কিছুতেই এত টান অনুভব হয় না।যতটুকু আকর্ষন হয় ভালোবাসায়।
(৫) কষ্টে না সুখে শব্দ কবিতা হতে ভালোবাসা?
গোবিন্দ ধর:দুটোতেই কবিতা পায়।বিরহ না পেলে কবিতা ফুরিয়ে যায়।
(৬) প্ৰেম শব্দর অৰ্থ তুমি কি মনে করো?
গোবিন্দ ধর:প্রেম তো পরস্পর পরস্পরের সহযোগী হওয়া।একেকজনের নিকট একেক রকম। কিন্তু মূলত আকর্ষিত হওয়াই প্রেম। শব্দের মধ্যে ডুবে যাওয়াও প্রেম।বিপ্রতীপ বিশ্বের সৌন্দর্যে মোহিত হওয়াও প্রেম।প্রেমের বিশালতা সম্পর্কে অবগত হলে তা আর অচ্ছুৎ হয় না।আদরনীয় হয়ে গ্রহণযোগ্যতা ঈর্ষণীয় উদাহরণ হয়ে যায় তখন।
(৭)অপ্ৰিয় শব্দ কি?
গোবিন্দ ধর:কিছুই অপ্রিয় নয়।স্ল্যাং নয়।প্রতিটি শব্দই শক্তি।প্রতিটি মুহূর্ত কবিতা।প্রতিটি শব্দই কবিতা।শব্দ আমাদের আত্মার যাপন।কবিতা স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ
(৮) গুরু কাকে মনে করো?কবিতায় গুরুবাদ প্রয়োজন?
গোবিন্দ ধর:গুরুবাদে বিশ্বাস করিনা।কবিতার কেউ গুরু হোন এমন আশ্চর্য গল্পে আমি বিশ্বাসী নয়।কবিতা যাপনের নির্যাস।উপন্যাস গল্পের অনুরনন।
(৯) ধৰ্মের প্ৰতি আস্থা আছে?যদি থাকে কেন?
গোবিন্দ ধর:প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাসী নই।বাঁচা ও বাঁচানোই হলো প্রকৃত পক্ষে ধর্ম।। বাঁচা বাড়ার বাইরে কোনো ধর্ম হয় না।মন্দির মসজিদ গীর্জা গুরুদ্বারে ধর্ম নেই। ধর্ম আসলে আচার অনুষ্ঠান নয়।ধর্ম হলো পরস্পর পরস্পরের আশ্রয়।
(১০)সংসার আর কবিতা কে তোমাকে আকৃষ্ট করে বেশি?
গোবিন্দ ধর:দুটোই। সংসারের দায়িত্বগুলো ভালভাবে পরিপাটি করেই কবিতায় যাপন সম্ভব। উদাসীন লোকজনের কবিতা পায় কিন্তু কবিতা হয় না।কিন্তু কবিরা এক ঘুরের আদিবাসী।ডহরলাগা ঘুরের মধ্যে কবিদের যাপন কবিতার জন্য। কবিতা আসলে স্কুলের ছোট মেয়ে মধুপর্ণা।সুতরাং কবিতা ও সংসার কেউ বেশি নয়।পরস্পরের বিরোধ নেই। পরস্পর কবিতা ও সংসার স্বামী স্ত্রী।একজন আরেকজনের পরিপূরক।
(১১) সমাজের প্ৰতি তোমার দায়িত্ব আছে মনে করো কখনো?
গোবিন্দ ধর:না নেই। কবিদের দায়বদ্ধতা সংসার ও কবিতায়।আর কোনো দায় নেই। দায়িত্ব নেই। একজন মানুষ হিসেবে সমাজের শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার নিকট আমিও দায়বদ্ধ।
(১২) কখন লিখতে ভালোবাসো?
গোবিন্দ ধর:ভালোবাসা পেলে লিখি।দুঃখ পেলে লিখি।মানুষের মানবিকতা যখন অমানবিক নিষ্ঠুরতায় রূপান্তরিত হয় আমার কলম তখন কবিতায় গর্জে ওঠে।যেখানে প্রয়োজন কলম সেখানেই কথা বলে।দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে লিখি।লিখে কিচ্ছু হয় না।তবু লিখি মনের ভেতর
(১৩)কেন লিখো?কী লিখো?
গোবিন্দ ধর :না লিখে পারি না।না লিখে পারি না বলে লিখি বললে প্রশ্ন জাগে কার জন্য লিখি?সত্যি বলছি আমি আমার জন্য লিখি।
কিরকম লিখি?যেমন পারি তেমন।তাতে কার কি?
হয়তো কারো কিছু নয়।
কিন্তু লেখা তাহলে প্রকাশ করি কেন?পাঠক জানুক আমি কবি।আমি লেখক।
এই যদি ইচ্ছে হয় তাহলে কিছু বিষয় মনে রাখতেই হবে একজন কবিকে।একজন লেখককে।
একজন কবি যদি নিজের জন্য লেখেন তাহলে আমাদের আর কোন কথা নেই। কিন্তু কবি যদি কিংবা লেখক যদি কোথাও লেখা প্রকাশ করেন তখন কিছু কথা থেকে যায়।কিছু বিষয় তাঁর রপ্ত করতেই হবে।
কবিকে পাঠের মধ্যে দিয়ে তৈরি হতে হবে।এ যাবৎ কি লেখা হয়েছে। কোথায় কোথায় বাঁক তার নিবিড় পাঠ অভিজ্ঞতা থাকা জরুরী।
লেখাটি কার জন্য কেন লিখবো এর ক্রমপর্যায় জেনে নিতে হবে নিজেকে পরিশীলিত করার জন্য। বারবার নিজেকেই ভাঙতে হবে তারপর।তারপর চাই এ যাবৎ যা লেখা শেষ তাকে মোচড় দিয়ে কবিকে জীবনানন্দ ক্রস করতে হবে।বিনয় টপকে যেতে হবে।শ্রীজাত,শঙ্খ সুনীল শক্তি জয় সুবোধ রামেশ্বর দিলীপ টপকে কবিকে হতে হবে নিজস্ব আরাধ্য গোবিন্দ। এই যে দীর্ঘ জার্নি তা জানতে হলে ক্রমাগত গোগ্রাসে পাঠই একমাত্র নিদান কবির নিকট।কবিকে কবিই তৈরী করেন।কবির কাছে আর কোন পাঠশালা নেই। আর কোন বিদ্যালয় নেই। নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোর। কবির সামনে পেছনে ডানে বাঁয়ে প্রথম শত্রু কবি নিজেকে।তারপর গণশত্রু তৈরী হলে জানবেন আপনার হয়েছে। ততদিন নিরবচ্ছিন্ন চর্চাই কবির কাজ।লেখালেখা খেলা।খেলতে খেলতে কাটাকাটি করা ছাড়া কবির আর কোন পথ নেই। সকল পথ রুদ্ধ। এই রুদ্ধ সিলেবলের বর্ণানুক্রমে সাজানো গোছানো পরিবেশে কবি জারিত রাখবেন নিজেকে।আঙুলের কড়া বেয়ে শত্রু সংখ্যা বাড়তে থাকলে ধরে নেবেন আপনি কবির দরজায় পা গলিয়েছেন।এবার কবি আরো পরীক্ষা নিরীক্ষা চর্চার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তৈরী হতে থাকবেন।ঠিক তখনই আপনার বোধিলাভ হবে।ততদিন চর্চা পাঠ আর লেখালেখিই শুধু একজন কবির কাজ।
আর কোন কাজই কবিকে তৈরী হতে সাহায্য করে না।না তরুণ না প্রবীণ কেউ গুরুত্ব দিলেই কী না দিলেই কী।কবির কাজ নিজেকে তৈরী করে যাওয়া।সময়ে আপনি তখন মূল্যায়ণ না হলেও জীবনানন্দকে আবিস্কারের মতো চর্যাপদ আবিস্কারের মতো একজন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ঠিক মাটি ভেদ করে তুলে আনবেন কবিকে।কিছুই না হলে কবিকে কোন তরুণদের ভালোবাসায় বাঁচিয়ে রাখা যায় না।ভেন্টিলেশনের দরকার নেই একজন কবির।তার শুধু দরকার নিজেকে জারিত রাখা।তৈরী হওয়ার সঠিক পথ ধরে হাঁটা।
(১৪)লেখালেখি প্রথম কবে থেকে শুরু করেছো?
গোবিন্দ ধর :ছোটবেলা থেকেই। যখন কিছুই বুঝতে পারতাম না তখনও লিখতাম।লেখালেখি আসলে মনের গভীরে কল্লোলিনী ফল্গুধারার মতো। আমি বৌদ্ধিক মানুষ নয়।হৃদয়ের মর্জি হলে লিখি।মনের গ্লানি দূর হয় বলে লিখি।
(১৫)লিখে কিছু হয়?
গোবিন্দ ধর :কিচ্ছু হয় না।বরং অনেকগুলো সবুজ বৃক্ষ ধ্বংসের আমি পরোক্ষভাবে দায়ী লিখি সেজন্য। এই ১০০ টি গ্রন্থ তৈরি হয়ে পাঠকের নিকট গেলো তাতে যে কাগজ খরচা হলো তাতে অনেকগুলো বৃক্ষের দেহাংশ। যা আমাদের প্রকৃতিকে সবুজ রাখতে পারতো।লেখালেখি করি বলে বৃক্ষগুলো ধ্বংস হলো।নয়তো এত অপচয় হতো না।আসলে আমি লিখি না আমার আমির ভেতর এক ফকির লিখে সে আমি বুঝি না।তবে আমি শুধু আমি নয়। আমি গোবিন্দ এবং চৈতন্য একই সাথে। আমি যখন গোবিন্দ তখন আমি আমি।আর আমি যখন লিখি তখন আমি আমি নয় আমি তখন চৈতন্য ফকির। সুতরাং লিখে কিচ্ছু হয় না জেনেই লিখতে হয়।না লিখলে আমি ফকির না হয়ে সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত হতেও পারতাম। কিংবা একজন সিঁদেল চুর বাটপার কিছু একজন হতাম হয়তো।আমার ভেতর চুর বাটপর প্রেমিক আত্মার মিশেলে গোবিন্দ ধর। আর এতসব থেকে নিজেকে আলাদা করতে পেরেছি আমি লিখি বলে।আসলে লিখে কিচ্ছু হয় না জেনেও লিখি কারণ আমার আমির ভেতর আরেক আমি সারাক্ষণ কিছু একটা করতে চায়।তাকে নিষেধ করলে শুনে না।এখানে এসে বুদ্ধি দাঁড়িয়ে পড়ে। আমি তখন ফকির।
(১৬)না লিখলে কিছু হবে?
গোবিন্দ ধর :কিচ্ছু হবে না। জগৎ সংসার সব ঠিক ঠাক যেমন চলছে ঠিক সেরকমই ঘূর্ণন প্রক্রিয়া বিবর্তন সব কিচ্ছু অবিকল চলতেই থাকবে। কিচ্ছু থেমে যাবে না। খাবো যাবো ঘুমাবো মানে আহার নিদ্রা মৈথুন সব চলতেই থাকবে। নদীর কল্লোল থাকবে।কলকল ঝর্ণা নামবে।টগবগ ঘোড়া যুদ্ধ জয়ের নেশায় হ্রেষা ডেকে উঠবে।তবু আমি লিখি।
কারণ আমি লিখি।আমি লিখি আমি কিচ্ছু পারি না।
0 Comments