বুকের ভেতর রইও রে বন্ধু বুকের ভেতর রইও...

গোবিন্দ ধর 

মঞ্চ মাতানো গানের পাখি পাগল হাসান আর নেই। বৃহষ্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪ দোয়ারাবাজার থেকে ফেরার পথে ছাতকে এক সড়ক দুর্ঘটনায় পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। 
জনপ্রিয় এই কণ্ঠশিল্পীর প্রয়াণকে আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আমার বুকের ভেতর অহর্নিশ ভাঙা-গড়া চলছে।আমি উথাল-পাতাল হয়ে আছি।আমি মেনে নিতে পারছি না।সত্যি বলছি পাগল হাসান এরকম মরে যেতে পারে না।

আসমানে যাইও নারে বন্ধু,
ধরতে পারবো না- তোমায়
পাতালে যাইও নারে বন্ধু,
ছুইতে পারবো না- তোমায়।

আসমানে যাইও নারে বন্ধু,
ধরতে পারবো না- তোমায়
পাতালে যাইও নারে বন্ধু,
ছুইতে পারবো না- তোমায়।

বুকের ভিতর-রইও রে বন্ধু
বুকের ভিতর- রইও,
অন্তরে অন্তর মিশাইয়া
পিরীতের গান গাইও তুমি
বুকের ভিতর-রইও রে বন্ধু
বুকের ভিতর- রইও,
অন্তরে অন্তর মিশাইয়া
পিরীতের গান গাইও।

একজন মাটির মানুষ মাটি কাদামাখা মানুষ 
সহজিয়া মানুষ লালন হাছন
রাধারমণ দূরবীন শাহ 
আর শাহ আব্দুল করিমের উত্তরসরী 
সুনামগঞ্জের ছাতক থানার কাদামাখা মানুষ 
আমার বন্ধুজন পাগল হাসান। 

পাগল হাসান মোহম্মদ মতিউর রহমান হাসানের জন্ম ১লা জুন সেই সেদিন ১৯৯১ সাল।তখন আমি মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।

মো: মতিউর রহমান হাসান (পাগল হাসান),পিতা দিলোয়ার হোসেন দিলশাদ,মাতা আমিনা বেগম সালেহা,গ্রাম শিমুলতলা, পোস্ট ছাতক ৩০৮০, থানা,ছাতক, জেলা সুনামগঞ্জ। গীতিকবি ও কণ্ঠশিল্পী। লোকগানকে মানুষের কাছে নিয়ে  গেছেন। গীতিকবিতা মানুষের কথা সময়ের কথা বলে। পাগলের কণ্ঠের সুর দিয়েছে মানুষকে আনন্দ ও ভাবনার জগৎ।  লোকগান বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে নানা দেশে পৌঁছে গেছে উপস্থিত মঞ্চ থেকে।পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমেও পাগলের গান আমাদেরকে সজাগ রাখে।এই সময়ের একজন মরমী মানুষ পাগল।
ছাতক উপজেলার শিমুলতলা গ্রামের বাসিন্দা হাসানের ছোটবেলায়ই পিতৃহারা হোন।অনেক অভাবের ভারে জর্জরিত ছিলেন।একটি সরকারী চাকুরী পেয়ে কোনোক্রমে চলছিলো তার পরিবার। ঐসময়ই তার গানের খাতা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন সংগীত গুরুর কাছে।সেখান থেকেই তিনি ক্রমেই সারাক্ষণ গানের জগতে আসেন।এক সময় চাকরীও ছেড়ে দেন।
তার গানে প্রেম বিরহ ও দুঃখ কষ্টের কথা লিপিবদ্ধ। 

২০২২ সালে লোকগবেষক সৈয়দা আঁখি হককে স্রোত প্রকাশনার একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করার পর তিনি বলেছিলেন আসবো তবে তখন নয় পরবর্তী কোনো সময়।
এরকম কথা চালাচালি হতে হতে এক সময় আঁখি কথা দিলেন আসবেন ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ সালে।কেন ২৯ ডিসেম্বর? আসলে আঁখির জন্ম তারিখ ২৯ ডিসেম্বর। আমি রাজী হয়ে যাই।বললাম ঠিক আছে এসো।স্রোত আয়োজন করতে ইচ্ছুক লোকসংস্কৃতি উৎসব। এই অনুষ্ঠানে লোকসংস্কৃতির পাশাপাশি লোকগবেষক সৈয়দা আঁখি হকের জন্মদিন উদযাপন করা হবে। তিনি মানে আঁখি সম্মত হলে আমরা কাজটি ধীরে ধীরে এগুচ্ছি।
এমন এক সময় বাংলাদেশ থেকে আরো একজন লোকগবেষককে নিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানাই।আঁখি তখন প্রস্তাব করেন পাগল হাসনের নাম।

কে এই পাগল?কে হাসান?আমি তখন অব্দি পাগল হাসান হরফে মতিউর রহমান হাসানের নামের সাথেও পরিচিত নয়।পরিচিত নয় সিলেটে তার গান কতটুকু কি।ধীরে ধীরে পাগলচর্চা করতে গিয়ে বুঝেছিলাম পাগলের বয়স অল্প হলেও তার ভেতরে আগুন লাগানো এক খনি বিরাজমান। তিনি সাধক।লোকগান তার জীবনের অংশ। 

লোকসংস্কৃতি উৎসবে পাগল এসেছিল। খুব সহজ অথচ তীব্র ছিলো তার উপস্থিতি। খুব ব্যক্তিত্বময় নিরহংকারী অথচ অহংকার করার মতো যথেষ্ট উচ্চ স্তরীয় সহজিয়া ধারার শিল্পী পাগল।লোকসংস্কৃতি উৎসবে পাগল হাসানকেও সম্মানিত করতে পেরে আমরা সম্মানিত। 

লোকগান তার যাপন।লোকগানের আগামী প্রবাহ পাগল হাসান। 

ইতিমধ্যে আমি সামাজিক মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানাই বন্ধু হওয়ার।তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করেন।মাঝে মধ্যে টুকটাক কথা চালাচালি হয়।আমি টুক করলে সে টাক করে।চলছে।নানা কথা।হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর আদানপ্রদান করা হলো।কথাচালাচালি হয়।মনে করিয়ে রাখি আমাদের প্রোগ্রাম ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩।তিনি বলেন, "ভাই চিন্তা নেই, মনে আছে "। আমি আশ্বস্ত হই।আবার কদিন গেলে ঝালিয়ে রাখি।এমন চলছিলো মাস দুয়েক।হাসান প্রতিবারই আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি আসবেন আমাদের লোকসংস্কৃতি উৎসবে।
অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩ আমি কুমারঘাট থেকে আগরতলা বের হই।সে এবং আঁখিও সুনামগঞ্জ ও ঢাকা থেকে ভোরের ট্রেনে উঠে আখাউড়া চেকপোস্টে আসার জন্য বেরিয়ে পড়েন।পথে কতবার যে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছিল তা হিসেব রাখিনি।কিন্তু বারবার কতটুকু আসছিলেন তা খবরা-খবর নিচ্ছি। সব সময়ই আশ্বস্ত করেযাচ্ছিলো হ্যাঁ আসছি ভাই। 
সৈয়দা আঁখি হক চেকপোস্টে আগে থেকেই এসে পৌঁছে গেছেন।হাসান অনেকপরে আসেন চেকপোস্ট। আমি সকাল এগারোটা থেকে চেকপোস্ট দাঁড়িয়ে আছি।সময় যেন স্থির দাঁড়িয়ে আছে। কখন আসবেন পাগল।কখন দেখা হচ্ছে। আমার আর তর সইছে না।হাসান আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছিলো আসছি ভাই।আঁখি প্রায় ২ ঘন্টা চেকপোস্ট পৌঁছে বসে আছেন।আমি তিন ঘন্টা। অবশেষে বেলা তিনটে প্রায় পাগল  হাসান চেকপোস্ট পেরিয়ে আগরতলা আখাউড়ায় দাঁড়িয়েছেন।মনে হলো কতদিন তার সাথে আমার পরিচয়।কত বছর ধরে আমাদের বন্ধুত্ব।এত ঘনিষ্ঠজন।আপনজন।আমি বরণ করে নিলাম। আগরতলা তখন একটুআধটু কনকনে ঠান্ডা প্রবাহিত।শীতের জন্য উলেবুনা টুপি দিয়ে গোলাপ দিয়ে আঁখি ও হাসানকে বরণ করে নিলাম।
হাসান বললো এত মায়া লাগাচ্ছি কেন।আমি বললাম আপনজনকে আর কি দিই বলো।আমি তো মায়ায় আগেই পড়ে আছি।
দুজন অতিথিকে প্রথমে ড.মুজাহিদ রহমানের আতিথিয়েতায় আখাউড়া একটি হোটেল কাম বাড়িতে তুলে তাদেরকে স্নান খাওয়া সেরে ফ্রেস ও রেস্ট করতে বলে আমি লিচুবাগান আসি।
বিকেলে সামান্য ঘুরঘুর করছি।অতিথি হলেও পাগল ও আঁখি বন্ধুজন।সুতরাং তাদের অসুবিধা সুবিধা জানতে চাইলে দুজনই আমাকে সমবেত ভাবে বলেছিল এখানে একটু অসুবিধা। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্য রয়াল গেস্ট হাউসে দুটি পৃথক রুমের ব্যবস্থা করিয়ে দিলাম।ওরা খুব স্বাচ্ছন্দ্যে আমাদের অন্য অতিথিসহ গেস্ট হাউসে কটিদিন কাটিয়ে গেলো।
এই কদিন উজ্জয়ন্ত মিউজিয়াম ঘুরে দেখা থেকে স্থানীয় বেণুবিহার বুদ্ধ মন্দির, স্টেট হেরিটেজ পার্ক ঘুরঘুর করতে করতে পাগলের গভীর গান পাগলামির সাথে পরিচিত হতে লাগলাম। 
পাগলের মধ্যে গভীর সহজিয়া দরদী একজন গান পাগল মানুষের ক্ষেপামি এত কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য করে দিয়েছেন লোকগবেষক সৈয়দা আঁখি হক।
সে আমার পরম সৌভাগ্য। 
অবশেষে আমাদের সেই স্বপ্নের দিন ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩।আগরতলা প্রেসক্লাবের ভূমিতলে বন্ধুজন আঁখির জন্মদিন উদযাপন ও লোকসংস্কৃতি উৎসব। দুইবাংলার লেখক শিল্পীদের সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের শুভক্ষণ। সময় ধরে আঁখি ও পাগল যথা সময়ে উপস্থিত। ঠিক সময় মতো আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হয়।
পাগল মঞ্চে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ করেও মঞ্চে সে বসেনি।
বলছিলো আমি আছি।আমার সরম করে।আমি গান করবো।তারপর যথারীতি প্রোগ্রাম চলছিলো।সময় কমে যাচ্ছে। হলভর্তি লোকজন।স্থানীয় শিল্পী।সবাইকে যারযার প্রোগ্রামের সুযোগ করে দিতে দিতে কখন নয়টা হয়ে গেছে রাত।
আগরতলা প্রেসক্লাবের সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের সময় রাত নয়টা অব্দি। কিন্তু অনুরোধ করে সময় চেয়ে নিয়েও যতটুকু একজন শিল্পীকে গান করার সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন সেদিন আমি ততোটুক সময় পাগলকে দিতে পারিনি।
তবুও পাগল হাসান সেই অনুষ্ঠানে চারটি গান করেছিলো।বাকী সব কিছু ঠিকঠাক চললেও আমার মনে যতটুকু প্রশান্তি পেতো পাগলকে আরো সময় দিতে পারলে,আঁখির কথা আরো শুনতে পারলে ততটুকু সেদিন আমি আমাদের লোকসংস্কৃতি উৎসবে তাদেরকে দিতে পারিনি।মনে মনে গ্লানি আর অনুসূচনা আমাকে প্রতিদিন কামড়ায়।তবুও প্রতিনিয়ত তাদের জন্য আমি নানা রকম প্লেন করে যাচ্ছিলাম পুনরায় ত্রিপুরায় তাদেরকে এক মঞ্চে আমন্ত্রণ করবো।সারাক্ষণ পাগল হাসান আর আঁখির কথা শুনবো।
কিন্তু সেদিন ১৮ ই এপ্রিল সকালে লণ্ডন থেকে একজন সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ পোস্ট করেন পাগাল হাসান নেই, মনটা ভালো লাগছে না।
আমি তখনো বিশ্বাস করিনি আমাদের প্রিয়জন পাগল হাসানের কিছু হতে পারে। 
তারপর সৈয়দা আঁখি হক ঠিক আটটা নাগাদ ফোন করে বললো, "পাগল নেই। রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে "। কথাটি শোনামাত্র বুকের ভেতর থেকে একটুকরো মাংস কে যেন ছিঁড়ে নিলো।আমি তখন বুঝতে পারছি না। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়।আমি সত্যি কি শুনলাম আবার জিগ্যেস করলাম কী বলছো?কি বলছো?ঠিক বলছো?
এখনো বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।তখন থেকে আজ অব্দি নিজেকে কতভাবে বুঝাতে চেয়েছি সেদিনের দূর্ঘটনা পরবর্তী সময়ের সমস্ত খণ্ড চিত্র সামাজিক মাধ্যমে অবলোকন করেছি তথাপি পাগল হাসান নেই কথাটি বিশ্বাস করতে পারছি না। 
ইতিমধ্যে জানলাম আঁখির প্রচেষ্টায় পাগল হাসান সড়ক নামে একটি সড়কের নামকরণ করতে সাংসদ সম্মত হয়েছেন।তথাপিও আমি পাগলের অকাল প্রয়াণের খবরকে বিশ্বাস করতে পারছি না। 

ঘাতক বাস তার জীবনদীপ নিভিয়ে দিলে রেখে গেছেন দুই পুত্র স্ত্রী মা ও এক অবিবাহিত বোন।এক পুত্র মাদ্রাসায় পাঠ নিচ্ছে অপরপুত্র সরকারী বিদ্যালয়ে।
দুটো শিশুর কান্না সামাজিক মাধ্যমে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।বুক ধরে রাখা কঠিন।ছাতকবাসীর চোখের জলে চিরনিদ্রায় শায়িত হোন পাগল।
সব কেমন স্বপ্নের মতো। কিছুই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।

আর তার গানই অজান্তে গেয়ে যাই" বুকের ভেতর রইও রে বন্ধু বুকের ভেতর রইও..."।

২৩:০৪:২০২৪

0 Comments