গোবিন্দ ধরের নদী নদীর গোবিন্দ
গোবিন্দ ধরের নদী নদীর গোবিন্দ
হারাধন বৈরাগী
কবি গোবিন্দ ধর
ত্রিপুরা একটি ছোট পার্বত্যরাজ্য। এর তিনদিকে বাংলাদেশ।বর্তমানে যা বাংলাদেশ অতীতে ছিলো পূর্বপাকিস্থান।সময়টা ১৯৭১,জুলাই মাস।মুক্তিযুদ্ধ চলছে।পূর্বপাকিস্থানের বারুদবাতাস সারা ত্রিপুরার সাথে উত্তরত্রিপুরার আকাশটাও মেঘলা করে চলেছে।কৈলাশহর ধর্মনগর কুর্তি কদমতলার মতো প্রান্তীয় শহর গ্রামের বাতাসে বারুদের গন্ধ - মানুষের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।বাতাসে স্বজনহারানো আর্তনাদ ভেসে আসছে ওপার থেকে।আকাশ পথে কামানের মেঘগর্জন মেসিনগানের হিসহিস আওয়াজ, মর্টার সেলের কড়কড় শব্দ, বন্দুকের চড় চড় ধ্বনি, যুদ্ধবিমানের সাঁই সাঁই রব, ড্রাকুলা বিমানের গড় গড় শব্দ - মানুষের মনে বিভীষিকা সৃষ্টি করে চলেছে।মাঝে মাঝে সেল এসে পড়ছে ওপার থেকে এপাড়ে। মানেষের মনে উদ্বেগের অন্ত নেই। এপারের প্রায় সকলেই দ্বখণ্ডিত ভারতমাতার সন্তান।এপারের প্রায় অনেকেরই নাড়ীর স্বজন পূর্বপাকিস্থানে। ছিন্নমূল মানুষের ঢল বয়ে চলেছে ওপার থেকে এপারে।পশ্চিমপাকিস্থানী ফৌজ ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওপারে পূর্বপাকিস্থানের বাঙ্গালীদের শ্বাসনালী চেপে কন্ঠস্বর চিরদিনের জন্য রুদ্ধ করে দিতে। বাঙ্গালীরাও থেমে নেই। তারাও মুক্তিযোদ্ধার নামে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পশ্চিমপাকিস্থানী ও রাজাকার বেইমানদের বিরোদ্ধে।প্রতিদিন অসমপ্রতিরোধের রুদ্ধশ্বাস খবর ভেসে আসছে বেতারে। সন্ধ্যা হলেই বেতারের সামনে ছেলেবুড়োর ঝটলা। সকলের আতঙ্কিত পাংশুটে মুখ।কখন কার ওপারের স্বজন হারানোর খবর ভেসে আসে।
এমন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বুকে ধরে আছেন আজও স্বয়ং লেখকও ।আমার দাদী তখন স্বজনদের দেখতে বেড়াতে গেছেন পাকিস্তানে।আবাল্যসখি দাদীর পথ চেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জলে চোখ ভরে আসছে। দাদী ফিরছেন না। দিনে রাতে মেঘগর্জনের মতো কামান মেসিনগান আর শেলের শব্দ ভেসে আসছে।কত গুজব উড়ছে বাতাসে।বুকের ভেতর তীর তীর কম্পন। মুক্তিফৌজ বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ময়দানে। পশ্চিমপাকিস্থানী সৈন্যদের ঘাড়ে শ্বাস ছাড়ছে।পশ্চিমপাকিস্থানীদের সমর্থনে পূর্বপাকিস্থানে রেজাকারনামী একদল বেইমানের জন্ম হয়েছে।এরা মুক্তিফৌজের বিরুদ্ধে লড়ছে।শত্রুদের পক্ষে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছে।মাথার উপর আকাশে ড্রাকুলা বিমানের সাঁই সাঁই আওয়াজ।যুদ্ধবিমান এপার ওপারের আকাশে চিলের মতো উড়ছে।
সন্ধায় আমার নিজের গাঁয়ের সবেধন দুটি রেডিওর সামনে ছেলেবুড়োর জটলা। আতঙ্ক।কবে ফিরবে দাদী। ফিরতে পারবে তো।আমার কাকা জেঠারা স্বপরিবারে পূর্বপাকিস্থানে আটকা পড়েছেন। কে কোথায় আছে কেউ বলতে পারছে না। একমাত্র অমরচান টাউটের মুখে মাঝে মাঝে শোনতে পাচ্ছি স্বজনদের নিয়ে আশ্বাস। তারা নিরাপদে আছে।কেউ বাঙালপাড়া, কেউ বালাটক্যাম্পে।তবে একটা দু:সংবাদ আছে। আমার কাকীকে পাকিস্তানীসৈন্যরা ধরে নিয়ে গেছে।
জুলাইমাস।আমার বয়স আট। দাদার সাথে গিয়েছি সকালবেলা গরুঘাসে দিতে। আমাদের বাড়ি ছিল অবিভক্ত উত্তর জেলার কাঞ্চনপুরের এক অজগাঁ উজানমাছমারার যোগেন্দ্রকারবারী পাড়ায় ।আমাদের বাড়ির উত্তরে গভীর গর্জনজঙ্গলের ভেতরে একটি খোলাঘাসের আঙ্গিনা। আঙ্গিনার মাঝে বিশাল এক আকাশছোঁয়া গর্জনগাছ।আমার দাদা বঙ্কেশ গরু ডিগরা দিচ্ছে ঘাসে। আমি দাদার গায়ে গায়ে। সহসা দক্ষিন থেকে মাথার উপর মৌমাছির পনপন আওয়াজ। ভয়ে দাদার ইঙ্গিতে শুয়ে পড়েছি ঘাসে।চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আকাশে নজড় পড়তেই ভয়ে গলাকাঠ। একটি যুদ্ধবিমানকে দক্ষিন থেকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে উত্তরে।একেবারে যেন মাথার নাগাল দিয়ে। সুউচ্চ গর্জনগাছে অল্পের জন্য লাগেনি। গাছের পাশে এসে দুটি দুদিকে চলে গেছে পাশকাটিয়ে।সন্ধ্যায় রেডিওর সংবাদে জানা গেলো-একটি ইন্ডিয়ান ফাইটারবিমান পাকিস্তানিবিমানকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে।
জুলাইমাসের এমন একটা কর্কটসময়সন্ধিক্ষনে কবি গোবিন্দ ধরের জন্ম।১৯৭১, ৩০জুলাই অবিভক্ত উত্তর ত্রিপুরা জেলার ধর্মনগরের পদ্মপুরে অফিসটিলায় বৃষকেতু নাথের বাড়িতে।তাঁর বাবা দক্ষিণারঞ্জন ধর তখন চাকরি করেন পদ্মপুর দ্বাদশস্কুলে লেবরেটরী সহকারী হিসেবে।মাতা সুষমারানী ধর গৃহিনী।কবির জন্ম বৃষকেতু নাথের নারায়ন মন্দিরে হয়েছিল বলে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল গোবিন্দ।গোবিন্দ ধর।এই গোবিন্দ নামের মাঝেই বুঝি সেদিন লুকিয়ে ছিল আগামীর দ্রোহবীজ ।যে নামে আজ কর্ণফুলি-মেঘনা-পদ্মা-ব্রম্মপুত্র-গঙ্গা-ভাগীরথী অজয়-কোপাই-সুবর্ণরেখা-তিস্তা-তোর্সা-জুরী-মনু-দেও ঐকতানে বাঁজে।ঢেউ এ ঢেউ এ পরাঅপরা কলধ্বনি বাঁজে গোবিন্দ গোবিন্দ-- নামে।
পদ্মপুর অফিসটিলার বৃষকেতুবাবুর বাড়ির বগলদিয়ে বয়ে গেছে জুরী নদী। বাড়ি থেকে জুরীর জাড়িজুরী দেখা যায়। শৈশবে বৃষকেতুবাবুর বাড়িতে কাঠালগাছ জড়িয়ে কবি বলতেন এই গাছ আমার। নিশ্চয়ই তিনি নদী দেখিয়ে বলতেন ওই নদী আমার। নদী হয়তো বাল্যসখির মতো চোখের ইঁশারায় জারিজুরী খেলতো তার সাথে।তিনিও বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরতে চাইতেন নদীকে।
জলখেলির নামে সেই শৈশবে তাঁর দিদি মল্লিকারাণী ধরের হাতধরে নদীতে নামতেন বাল্যসখির সাথে জলখেলি খেলতে। একদিন তাই নদীর বুকে জলখেলি করতে করতে হেরে যান আর স্রোতের তোড়ে ভেসে যেতে থাকেন কবি ও দিদি।ঘটনাটি জনৈক ব্যক্তির নজড়ে আসলে সাথে সাথে খবর যায় পদ্মপুর দ্বাদশশ্রেণি বিদ্যালয়ে। বাবা দৌঁড়ে এসে জুরীতে নেমে স্রোতের তোড়ে ভেসে যাওয়া কবি ও তাঁর দিদিকে সে যাত্রায় রক্ষা করেন। তা নাহলে সেদিনই হয়তো তাঁদের জলডুবি হতো জুরী নাম্নী কুহকিনীর বুকে।
কবির যখন ৩বছর ছয় মাস বয়স তখন তাঁর পিতা পদ্মপুর দ্বাদশশ্রেনীবিদ্যালয় থেকে বদলি হোন কাঞনবাড়ি দ্বাদশশ্রেনীবিদ্যালয়ে - যার বর্তমান নাম ধনসিং মেমোরিয়াল স্মৃতিদ্বাদশশ্রেণি বিদ্যালয়।পিতা কাঞ্চনবাড়ি বদলি হওয়ায় তারা স্বপরিবারে চলে যান তাদের স্থায়ীবাড়ি রাতাছড়ায় ।এখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা।মাঝখানে একটি বছর ২০০২-৩ বাদ দিলে শৈশব বয়:সন্দি ও যৌবনের একটা বড়ো সময় এখানেই কাটে কবির। শুধু ওই একটি বছর কাটে তাঁর কৈলাশহরে।
১৯৭৯ এর জানুয়ারী মাসে আটবছর তিনমাসের সময় রাতাছড়া উচ্চ বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে প্রথমশ্রেনীতে ভর্তি হোন কবি বড়বোন মল্লিকারাণীর হাত ধরে।বর্তমানে এই বিদ্যালয়টি দ্বাদশমান বিদ্যালয়ে উন্নত হয়েছে।এটির বর্তমান নাম হাজিবাড়ি দ্বাদশশ্রেণি বিদ্যালয়।
তখন স্কুলবাড়ি বলতে ছনের ছাওনি দেওয়া দু'চালা ঘর। একটি উঁচু টিলায় মুলি বাঁশের বেড়া দেওয়া চাম্পাকাম্পাঘর।মেঝের মাটি থেকে ধুলো উড়তো।ডেক্স ছিলো না।ছোট ছোট চাটাই ছিলো ক্লাস ওয়ানে বসার ব্যবস্থা। দ্বিতীয় শ্রেণিতেও ছিলো ছোট ডেক্স। দুজন বসা যেতো।ছাত্রের তুলনায় ডেক্স ছিলো কম।সুতরাং যারা আগে যেতো পারতো তারাই বসতো।তাঁরা ছিলেন আট ভাইবোন পিতার সংসারে সচ্ছলতা ছিলো না।তাই সকালে জমিচাষে সময় দিয়ে একটু দেরীতে স্কুলে যেতে হতো।অনেক রকম ফসল কবি নিজের হাতেই ফলাতেন। লাউকুমড়ো থেকে শুরু করে পেয়ারা পেপে জিঙ্গে বেগুন পটল সিম লতচই টমেটো ধান ইত্যাদি সবরকম চাষেই তিনি হাত পাকিয়ে ছিলেন।শুধু তাই নয় বাবাকে সাহায্য করতে গিয়ে বিনা অসন্তোষে রাস্তায় কংক্রিট তৈরী থেকে দিনমজুরী- কোন কিছুই বাদ যায়নি তাঁর।বিবাগীপিতার সংসারে কোনদিন এমন গিয়েছে যে উপোস থেকেও কাজ করে অর্থ উপার্জন করে বাজার থেকে চাল এনে মায়ের উনান জ্বালাতে হয়েছে।কবিতার কাগজ ছাপাখানা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে জীবিত রাখতে রাতাছড়া থেকে কুমারঘাটে এসে পত্রিকা হকারি করতে হয়েছে।এতো সব করে দেরীতে স্কুলে যাওয়ার জন্য স্থানের অভাবে সারা সময় ধুলোর উপর দাঁড়িয়ে মৃন্ময় দে ও উমেশ চন্দ্র দে স্যারের পড়া শুনতেন। তাঁর খাতায় আঁকিবুকি দেখে উমেশ স্যার বলতেন - আঁকার একটি আলাদা খাতা নিয়ে আসতে।মিতবাক কবি ভয়ে কোন দিন বাবাকে বলতেন না খাতার কথা। তাঁর আঁকা মানে হিজিবিজি সাপ ব্যাঙ কিছুই বুঝা যেতো না।বাবাকে বলাও হয়নি আর আঁকার খাতাও কোন দিন হয়নি।আর লেখার খাতায় হিজিবিজি চলতো আর সমান্তরালে--- স্যারের বকাবাদ্যাও।তাঁর এই জীবনসংগ্রামচিত্র এখন যদিও কিছুটা পাল্টেছে কিন্তু দেখা দিচ্ছে অন্যরূপে অন্যভাবে। কবির জীবন এখনও সচ্চল নয়। সচ্চল থাকতো যদি তিনি স্রোত ও স্রোতস্বীর দিকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন।কিন্তু তা যে সম্ভব নয়। এ যে তার আত্মা। এর চেয়ে মৃত্যুই যে শ্রেয়।প্রকাশনা চালাতে ও বিবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড চালাতে গিয়ে মাঝে মাঝে কদর্পক শুন্য হয়ে যান তিনি । তখন পদ্মশ্রী কিংবা সুমিতার স্বর্ণালঙ্কারই একমাত্র তড়াইমধুসূদন।এখন যে আর দুধেল গাভী নেই। এই গাভী যে আগেই এমনঅবস্থা উত্তরনে বিক্রি হয়ে গেছে। আমি মাঝে মাঝে অবাক হই কি করে এতো সব পারেন গোবিন্দ।কবির সাথে কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন করে দেখেছি অনুষ্ঠানের আগে থেকে শেষ অবধি খোঁপে খোঁপে শুধু টাকা আর টাকা ঢালতে হয়। আর অনুষ্ঠানের অনেকদিন পরেও চলতে থাকে ঋণের ঘানিটানা।এরপরও এই রাজ্যে গোবিন্দ গোবিন্দই।চলছে চলছেই।এমন শক্তি কোথা থেকে পেলেন কবি।ভেবে পাই না। আমি শুধু এর একটা ঊপাত্ত অনুমান করেছি। কবির বুকে একটা অদ্ভুত আগুন আছে যা কখনও নেবেনা।জগতে কিছু পাগল থাকে-আর তাদের বুকে এই আগুন জ্বলতে থাকে নিরবধি। আমার মনে হয়, এই আগুন যাদের বুকের মনি তাঁদের যতক্ষণ শ্বাস আছে ততক্ষণ তাঁরা পিছু হটতে পারে না - না না।এ আগুনমণিই পৃথিবীর সকল সাকসেসফুল মানুষের সাফল্যের চাবিকাঠি।
ছোটবেলা থেকেই বইপড়ার প্রতি কবির ছিলো অসম্ভব নেশা।পাঠ্যবইর বাইরে জনশিক্ষামূলক বিভিন্ন বই তিনি পড়তেন। তিনি যখন ষষ্ঠশ্রেনীতে পড়েন তখন একটি কালোসুন্দরী মেয়ে ছিলো কবির সহপাঠী। তার নাম ছিল লীলাবতী। সে কবির বইপ্রীতির প্রতি অসম্ভব আকৃষ্ট হয়। এই থেকে মেয়েটি কবির কাছে নিয়মিত বই চাইতো।এই থেকে কবিও তার প্রতি আকৃষ্ট হোন। একদিন একটি দু'লাইনের প্রেমের কবিতা লিখে ফেলেন তিনি। আর এই কবিতাচিরকুটটি বইর ভেতরে ঢুকিয়ে লীলার হাতে দেন। দুটি লাইন ছিলো এরকম-
"ভালোবাসি ভালোবাসি--
তোমাকে-সত্যি ভালোবাসি"
বেশ।আর কী।শ্রীমতি লীলাবতী বইটি হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতেই সাপ বেরিয়ে পড়ে। লীলা লজ্জারুন হয়ে সাথে সাথে স্থান ত্যাগ করে। প্রচার হয়ে যায় কবির কবিতা। ক্লাসে গুঞ্জন ওঠে। লীলাবতীর সহজ হতে বেশ কদিন লেগেছিলো।এটাই ছিল কবির কাঁচাহাতের প্রথম কবিতা।
আজ লীলাবতী কোথায় আছে জানিনা। জানলে বলতাম।লীলা তুমি কবির প্রথম কবিতানারী। তুমিই সৌভাগ্যবতী কবির প্রথম কবিতা। তুমি কবিকৃতি - তুমি কবির প্রথম ক্ষরিত নারী। তুমি সাক্ষী। তুমি কবির ইতিহাস। এমন সৌভাগ্যবতী কজনা হয় বলো।
তিনি যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়েন তখনই আওয়াজ ওঠে বিদ্যালয়টি মাধ্যমিক করার জন্য।সে আওয়াজ বামপন্থী ছাত্ররাই তুলেছিলো।তিনিও মিছিলে যেতেন।আওয়াজ বাস্তব হয় ১৯৮৪-৮৫ সালে। সহপাটি ছিলো ষাটজন।ক্লাসে তিনিই প্রথম।১৯৯০ এ তিনি মাধ্যমিক পাশ করেন।এ বছরই তাঁর বাবার অকাল প্রয়ান ঘটে। ১৯৮৪তে তাঁর বাবা দক্ষিণারঞ্জন পাবিয়াছড়া দ্বাদশশ্রেণি বিদ্যালয় থেকে বিলথৈ দ্বাদশশ্রেণি বিদ্যালয়ে বদলি হোন। ১৯৯০ সালের মে-মাস,তাঁর পিতা গ্রীষ্মের বন্ধে বাড়িতে ছুটি কাটাতে এসেছেন। ৩০শে মে ১৯৯০ - হঠাৎ সন্ন্যাসরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি ।পিতার মৃত্যু ভূমিকম্পের মতো নাড়িয়ে যায় কবিকে।আটভাইবোন মায়ের দায়িত্ব এসে পড়ে নিজের উপর।
তাই মাধ্যমিক পাশ করেই ১৯৯১এ ডাই-ইন-হার-নেসে চাকুরীতে ঢুকেন।প্রথম চাকুরীজীবনের শুরু উত্তর রাতাছড়া উচ্চবুনিয়াদী বিদ্যালয়ে। নিয়মিত স্কুলে যান।মাধ্যমিক পাশ করে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন।দ্বাদশ শ্রেণির টেষ্টও পাশ করেছিলেন ।চাকুরীর জন্য দ্বাদশ ফাইনালে বসতে পারেননি।তিনবছর পর অর্ডার এনে ফাইনালে বসলেও উত্তীর্ণ হননি রিক্স লাগে। আর বসা হয়নি -কারন কিছু খামখেয়ালিপনা আর সার্টিপিকেটের প্রতি উদাসিনতা-বাবার অবর্তমানে ছোট ছোট বোন ভাইদের প্রতি দায়িত্ব পালন, তাকে ডিগ্রির প্রতি বিমুখ থাকতে হয়েছে।
ছোটবেলা রাতাছড়া বাজার খুব জমজমাট ছিলো। পার্শ্ববর্তী সকল গ্রাম থেকেই এই বাজারে লোকজন আসতো। যাত্রাদল, পুতুলনাচের দল আর স্থানীয় ধামাইল কীর্তনীয়া মনসামঙ্গল কবিগান সবই ছিল।সে সময় পূজোর বিশেষ আকর্ষণ ছিলো রাতাছড়ার যাত্রাদল।এই সময় কিছু ঘটনা কবি মনে প্রশ্নচিহ আঁকতো।পুতুলনাচ কবি মনে মারাত্মক ছবি আঁকতো।একদিন পুতুলনাচের টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়িয়ে আসরে ঢুকবেন, এমনসময় কেউ ছোঁমেরে টিকিট নিয়ে পালিয়ে যায়।সেদিন বিনাটিকিটে পুতুলনাচ পেণ্ডেলের বাইরে থেকে বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করায় কমিটির লোকের দাবড়ানি খেয়ে মনকষ্টে বাড়ি ফেরেন।
কলকল প্রবাহিত মনুর জলডাক বালক কবিমনকে চ্ঞ্চল করে দিত। বালুস্নান, বালুপ্রেম ছোটবেলাকে এতটাই ঘিরে ছিলো যে মন সকল সময় রাতাছড়ার জন্য আনচান করতো। আসলে তাঁর বাবা এবং রাতাছড়া সমান্তরাল তাঁর জীবন ডিঙ্গির পাটাতন ধরে গুণ টানতো।আর টানবেই না কেন। এই রাতাড়াই কবির কবিতার আঁতুরঘর। কবিমা এখানেই তার কবিতাসন্তানের প্রসব করেছেন। এখানেই তাঁর কম্পিউটারে লেটারপেড থেকে সিল্কস্ক্রিন ছাপার আনাড়ি অভিজ্ঞতা।এখানেই ১৯৯৫এ কবির গ্রাফিপ্রিন্ট ছাপাখানার জন্ম। ব্যবসা নয় উদ্দেশ্য সংস্কৃতি বিষয়ক কাগজগুলোর কাজ চালিয়ে যাওয়া। অথচ এবিষয়ে তাঁর কোন পূর্বধারনা নেই। না থাকলে কী হবে তিনি যে থেমে থাকার জন্য আসেননি।তাই সফলতা এসেছে।এও বুঝি পিতার জীন থেকেই তার এই প্ররনা এসেছে।ছাপার সাথে সম্পর্কিত না হলেও একটি বিষয়ে পিতার হাত ছিলো। তাঁর পিতা যখন ধর্মনগর চাকরি করতেন তখন একটি বুকবাঁধাই দোকান ছিল। তিনি নিজের হাতে এই কাজ করতেন। এটির নাম ছিলো - নিত্যানন্দ বুক বাইন্ডিং হাউস কবির বড়ভাই নিত্যানন্দের নামে। ।পরে রাতাছড়ায় এসেও তাঁর পিতা এইকাজ করতেন। আর কবি খুব কাছে থেকে এই কাজগুলো পরখ করতেন।তাই পিতার এই কাজে অসীম ধৈর্য্য কবিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।তিনিও পিতার পদাঙ্ক অনুসরন করে সময়ের দাবী মেনে লেখালেখি প্রকাশনা, ছাপার কাজ ও বুকবাঁধাইর মতো মতো আয়াসসাধ্যযাপনে ক্ষুরধার হয়ে ওঠেন। তাঁর পিতা বই বাঁধাই করতেন।তা তিনি দেখতেন।পিতার অনুসরনে কাচমিলকা আর ময়দা জ্বাল দিয়ে আঁঠা তৈরী করে নিতেন ।কাচমিলকা দিলে বই পোকায় কাটে না।তিনি পিতার কাজে আঁটা এগিয়ে দেওয়ার মতো ফায়ফরমাস খাটতেন।এই থেকে বাঁধাই শিখে নেন। তাই পিতার অবর্তমানে তিনি নিজের প্রয়োজনে কিছু কিছু বই বাঁধাই করতেন। যখন লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে শুরু করেন তখন অনেক গুলো সংখ্যাই তাঁর নিজের হাতে বাঁধাই করেছেন।কুমারঘাটের সপ্তাহিক সেই সময়ের শারদ সংখ্যা নিজেই বাঁধাই করেছেন।
এরকম অসংখ্য বই লিটল ম্যাগাজিন বাঁধাইরপ্রয়োজনে করতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর কবিতার খাতাও তিনি নিজে বাঁধাই করতেন।খাতায় কবিতা নাটক গল্প লিখতেন। একটি কবিতা লিখলেই মনের আনন্দ ধরে রাখতে পারতেন না।
একবারের এক ঘটনা।তাঁদের গ্রামের বাড়ি তখন যৌথ থাকায় অনেকেই মুরগী পালন করতেন।বাড়িতে তখন পাঁচ পরিবার।কবির পিতা তখন নেই ।তাঁদের দক্ষিণের ভিটায় ঘর।তিনি আর তাঁর বড়দা দুই ঘরে থাকেন। এক ঘর তাঁর থাকা ও পড়াশোনা করার ব্যবস্থা।সে ঘরে তিনি অনেকগুলি কবিতা লিখেছেন। তখন খাতায় কবিতা লিখতেন।সাদা পাতা সেলাই করে খাতা তৈরী করতেন নিজেই।তাঁদের বাড়িটি যৌথ থাকায় যার তার মোরগ কবির ঘরে এসে ঢুকতো। তাঁর কবিতার খাতা গুলো টেবিলে এলোমেলো সাজানো থাকতো।প্রায় হাজার কবিতা হবে টেবিলে।সেদিন একটি মুরগী চুপিচুপি এসে তাঁর টেবিলে কবিতার খাতা আচড়ে ডিম পাড়ার বাসার মতো করে বসে ডিম পেড়ে দেয়।খাতার আর চিহ্ন রইলো না।ডিম পাড়ার পর মুরগী ডাকছে।এমন সময় তিনি ঘরে প্রবেশ করেন। টেবিলে চোখ পড়তেই তাঁর কান্না চলে এলো।দেখলেন একটা ডিম পেড়েছে মুরগী তাঁর হাজার কবিতার বিনিময়ে।কবিতার কোন চিহ্ন নাই।খাতা ছিন্নভিন্ন।বুকের পাঁজার ভেঙ্গে চৌচির হবার অবস্থা। বুক ফেঁটে কান্না দলা পাকিয়ে গলায় গিয়ে আটকে যাচ্ছে। কিছুতেই আর দুপুরের ভাত গলা দিয়ে নামলো না।হাজারটি কবিতা তাঁর কাছে যে অঙ্কের টাকার চেয়ে অনেক দামি।মনে কোন শান্তি এলো না।রাতে ঘুম আসলো না।কয়েকদিন নাওয়া খাওয়া বন্ধ থাকলো।প্রায় পাগল পাগল অবস্থা ।কেউ শান্তনা দেওয়ার নেই।পিতা যে নেই।ভাবলেন আর লিখতে পারবেন না।এত কবিতা আমার নষ্ট হলো। একটা কবিতাও উদ্ধার করতে পারলেন না।লেখাও আর আসছে না।ধরেই নিয়েছিলাম তিনি আর কবি হতে পারবেন না।মন বিষন্ন।দিনের পর দিন যায়।কবিতার কথা মনে পড়লেই চোখে জল আসে।কোন ভাবেই মনের অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছিলেন না।অনেকদিন পর ধীরে ধীরে কবিতার ভুত ঘাড় থেকে নেমে গেলো।আবার লিখতে লাগলেন।আবার কবিতা এলো।একটার পর একটা।বাঁধ না মানা কবিতার ঢল নামলো।
যতদিন গেলো পুরাণো কবিতাগুলো ফিকে হতে লাগলো। হাজার হাজার নষ্ট হওয়া লাইনকে আর কবিতা বলে মনে হলো না।মনে হলো না কিছু হারিয়েছেন। আজ তাঁর সেই মুরগীকে খুব মনে পড়ে।সেদিন এই কবিতাগুলো মুরগী নষ্ট না করলে দূর্বল সন্তানদেরকেই পিতার দায়িত্ব দিয়ে আগলে রাখতেন।আর কবিতাগুলো তাঁকে মুরগী ডিম পেড়ে নষ্ট করার মতো কষ্ট দিতো সারাজীবন
এখন হোয়াটসআপে লেখেন।প্রায়ই অনেক লেখা সহ হঠাৎ আর হোয়াটসআপ খুলে না।কিন্তু সেরকম আর কষ্ট হয় না।মনে হয় - কবিতা লিখেই বা কি হলাম।
না লিখলেই কি।তবুও কে যেন আবার লিখিয়ে নেয়।সে যেন তিনি নন।তাঁর ভেতর কতজন তিনি তা গুনতে পারেন না। কবি কথায়-"আমার আমি - আমি চিনলাম না।"
ছোটবেলা পুজোর সময় কবি ও ভাইবোনদের জন্য ড্রেস আসতো-বাবার পছন্দ মতো। তাঁরা কোন রা করতেন না। এক কালার। এক ডিজাইন।তাঁরা যেন ভারতীয় সৈন্যদল। বাবা কমান্ডার। তাঁরা রাস্তায় বেরোলেই পাড়াশুদ্ধ সকলেই বাবার নাম বলে দিতে পারতেন। এতে তাঁদের অহংকার হতো।পুজো এলেই বাবার জন্য মন অপেক্ষা করতো এই বুঝি বাবা এসে ড্রেস কিনে দেবেন।
জমি জমার প্রতি ছিলো কবি পিতার উদাসিনতা। কবির ঠাকুরদাদা দেবেন্দ্রনাথরা দু'ভাই ছিলেন।ঠাকুরদা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক ছিলেনপাকিস্তান আমলে তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন মৌলভীবাজার মিঞারপাড়া প্রাইমারী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক।এই স্কুলে তিনি পঁয়ত্রিশ বছর শিক্ষকতা করেন।কিন্তু রায়টের কারণে ছেঁড়া মানচিত্র বগলে নিয়ে চলে আসেন বাবা - কাকা আর দাজিকে নিয়ে।
কবির ঠাকুরদার বড় ভাই এতটাই উদাসিন ছিলেন রোদে শুকাতে দেওয়া ধান গরু খেয়ে নিচ্ছে দেখে প্রতিবেশীরা ডেকে বললে তিনি বারান্দায় হুকো টানতে টানতে বলতেন খাকগে।কত আর খাবে।ঠাকুরদার অবর্তমানে তাঁর পিতা আর কাকার যৌথ সম্পতির দিকে কখনো সজাগ থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেননি।কাকা সুভাসচন্দ্রের উপর সে ভার ছিলো।আর এতেই তার পিতা পারিবারিক সম্পতি থেকে বঞ্চিত নাগরিক।কাকার যথেচ্ছাচার জমিজমা বিক্রি-ইত্যাদি কারনে ধীরে ধীরে আজ জমির পরিমাণ কয়েক কানিতে নেমে এসেছে।কবিও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য উদাসীনতা থেকে জমিজমা বড় ভাই নিত্যানন্দ আর ছোট ভাই স্বপনকে উপহার দিয়ে সেই ২০০৩ থেকে হালাইমুড়ায় খাসভূমির উপর দেওমনু সঙ্গমমোহনায় ঠাঁই নিয়েছেন।
সেই থেকে আজ অবধি তিনি ভূমিহীন ।কৈলাসহর কোর্টের কাছে তাঁর সাড়ে ছগন্ডা ভূমি ছিলো।তখন দুলক্ষ রেট কানি বিক্রি হতো সে জমি।স্রোত প্রকাশনাকে সমৃদ্ধ করতে গিয়ে বিক্রি করে দিলেন জমিটা।সেবারই সে জমির দাম হয় চল্লিশ লক্ষ টাকা।আসলে একটি স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তখন জমি হাতছাড়া করতেও তাঁর কোন বেদনা ছিলো না।২০১০ সালে কুমারঘাট আড়াইগন্ডা জায়গা কেনেন।তখন দাম ছিল পাঁচ লক্ষ টাকা ।আবারও স্রোত তাঁর জমি বিক্রি করতে প্রেরণা যোগায়।কিছুটা ঋণের হাত থেকে এবং আগামী পরিকল্পনার তাগিদ থেকে তাও বেঁচে দেন। একটি স্বপ্নের পেছনে দৌড়তে গিয়ে হয়তো তিনি নিস্ব ভূমিহীন।স্বপ্ন মানুষকে নি:স্ব করলেও স্বপ্নহীন মানুষের বেঁচে থাকার কি কোন মানে থাকে তিনি জানেন না।প্রতিক্ষণ জেগে জেগে স্বপ্ন দেখেন। একটা স্বপ্ন তাঁর ঘুম কেড়ে নেয়। স্বপ্ন দেখেন যতক্ষণ স্বপ্ন সফল না হয় যত ক্লান্তি আসুক তিনি ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে যেতে শিখেননি।হয়তো স্রোত একটি শব্দ।তাঁর কাছে এক সাগর জল।যে জল ক্রমাগত বয়ে চলেছে অন্যভুবন সঙ্গমের দিকে।
কবি কথায়-"আমার চাই মানুষ।মানুষের ভালোবাসা আমি পেয়েছি।মানুষের ঘৃণা আমি পেয়েছি।তবুও মানুষের কাছেই আবার ছুটে যাই।মানুষই আমার কাছে চিরন্তন সত্য।রাতাছড়ার বাসায় প্রতিবেশিরা ক্রমাগত আল কেটে জমি ঠেলতেন।বাবা জেনে বুঝেও কাউকে কোনদিন কটুকথা বলতে শুনিনি - এতটাই নির্লিপ্ত ছিলেন বাবা।" কবি গোবিন্দ এমন পিতার জিনেটিক উত্তরাধিকার।
ছোটবেলা পুতুলনাচ যাত্রাপালার প্রতি আকর্ষণ ও নিজ জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘাতপ্রতিঘাত পিতার টানাপোড়েনসংসার পিতার সংগ্রামশীল বায়ে চলা নীতি কবির মনে অসম্ভব রেখাপাত করে। ১৯৯৫-২০০৩ সালে আঞ্চলিক নাটক যাত্রার সাথে যুক্ত হন।আর সময়ের দাবী মেনে তিনি মহামায়া নাট্য সংস্থা গঠন করেন।তিনি সর্বসম্মতিতে এই সংস্থার সম্পাদক নিযুক্ত হন।এই থেকে বেশকয়েকটি নাটক লেখেন।এগুলি এরকম
পূর্নাঙ্গ নাটক
(১)প্রতিদিনের প্রতিবাদ
(২)সভ্যতার অকথিত কাহিনী
একাঙ্ক নাটক
(১)সাক্ষরতা অভিযান
(২)হুরুতার তালাপি
(৩) ভালাকরি বাঁচার যাদু
(৪)প্রায়শ্চিত্য
কবির ছোটবেলা আমতলী বাজারে যাত্রা হতো।তখন তিনি কাছ থেকে কাছ থেকে যাত্রার মহড়া দেখতেন।যাত্রা যেদিন মঞ্চায়ন হতো সেদিন খড় বিছানো থেকে মঞ্চ তৈরী এবং গ্রীন রুম থেকে মঞ্চে যাওয়ার সিঁড়ি তৈরী ইত্যাদি কাজে নিজে হাত লাগাতেন।তৎকালীন রাতাছড়ায় কোন নাট্যকর্মীর খুব অভাব ছিলো। মহিলা নাট্যকর্মী পাওয়া দুস্কর ছিলো। রাতাছড়ায় প্রথম মহিলা নাট্যকর্মী দিয়ে অভিনয় করতে উদ্যোগী হয় স্রোতস্বিনী সাংস্কৃতিক সংস্থা।এই সংস্থাটি সাহিত্য সংস্থা হিসেবে কবির হাতেই ১৯৯৫এ ঘঠিত হয়। তারপর রাতাছড়ায় অনেকেই ধীরে ধীরে নাট্যাভিনয়ে আসেন।কবির জিনেটিককোডে ছিলো নাটকের নেশা। বাবা দক্ষিণারঞ্জন ধর নাটকে অভিনয় করে পুরস্কার স্বরূপ একবার "আলোয়ার আলো" নামে একটি বই পেয়েছিলেন। একই সাথে সাহিত্যের পুড়াসংরক্ষনের জন্য উদ্দিপ্ত সংগ্রহশালা।এখানেই কবির প্রথম লিটলম্যাগাজিন আন্দোলনের অঙ্কুরোদগম হয়।পরবর্তী সময় কবির হালাইমুড়া আগমনের সাথে সাথে সেই কর্মকান্ড এখানে স্থানান্তরিত হয়। শুরু হয় কুমারঘাট সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্য এক অধ্যায়-স্রোত ও স্রোতস্বীর কলকল যাত্রা -যার কেন্দ্রবিন্দু হতে চলেছে
২০১০ স্থাপিত "বইবাড়ি" নামক একটি বইর একটি অপ্রথাগত প্রতিষ্ঠান।বইবাড়ির উদ্দেশ্য শুধু সুলভমূল্যে বই বিক্রয় নয়।সাহিত্যের আড্ডা লেখক পাঠকের নৈকট্যস্থাপন,নুতন প্রজন্মের সাহিত্যমানসজমিন কর্ষন।সাহিত্য আড্ডা চলছে কবির সেই রাতাছড়ার জীবন থেকেই নাপরিচয়ে। কিন্তু ২০১৮ ১লা অক্টোবর তার প্রচেষ্টায় ঘটিত হয় কুমারঘাটে "দেওমনুসাহিত্যমঞ্চ"যার উদ্দেশ্য সাহিত্যমানসকর্ষনে সাহিত্যআড্ডা পরিচালনা।এর কাজ ইতিমধ্যেই স্পোরাডিক ভাবে শুরু হয়ে গেছে।
রাতাছড়া থাকাকালে ২০০০এ প্রথম কবির হাতে জন্ম নেয় একটি শিশু সাহিত্যের কাগজ - কুসম।তারপর হালাইমুড়া এসে ২০০৭এ কবিতার একটি মননশীল সাহিত্যপত্র- কবিতা ঘর।আর স্রোত ও স্রোতস্বীকে কেন্দ্র করে বইবাড়ি, উদ্দিপ্ত সংগ্রহশালা কবিতাঘর ও কুসুমের ডালপালা বিস্তৃত হয়ে বর্তমানে ব্রুইফাং এ পরিণত হতে চলেছে-যাকে কেন্দ্র করেই হালাইমুড়া তথা কুমারঘাটের সাংস্কৃতিক মুখ ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
সময়ের দাবী মেনে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে অনেক ঝড়ঝঞ্জা স্রোত ও স্রোতস্বী মতো পরিব্রাজন করে চলেছেন কবি। যতো ঝঞ্জাই আসুক থেমে নেই তিনি। এগিয়ে চলেছেন কুহেলিকা পথে সফেন সঙ্গমের দিকে।আর তাঁর সাথে ছুটে চলেছে অসংখ্য অপ্রান্ত ও প্রান্তজন।.স্রোত ও অস্রোত অনেক আলোচনা সমালোচনার ডহর ভেদ করে ভাটার টানের দিকে জলজ মনুর সন্তান।জীবনের মধ্যগগন ফাড়ি দিতে গিয়ে অগনিত বন্ধু ও বন্দুক পেয়েছেন । অনেকেই কাছে আসেন-জলজ পথে কেউ টিকে থাকেন কেউ না। কেউ তাঁর সাথে চলতে গিয়ে স্রোতের তোড়ে নিমজ্জিত হয়ে হাড়িয়ে যান মাঝ দরিয়ায়।তিনি থেমে নেই চলছেন ত চলেছেন। জীবনের মধ্যগগন অতিক্রম পর্বেই তিনি আজ ব্রুইফাং। এই ব্রুইফাংকে নিয়ে আলোচনা করা আমার মরুমায়া মনে হয়।নীচে কবির সংক্ষিপ্ত কর্মতালিকা তুলে তাঁর জীবন বিষয়ক আলোচনার ইতি টানছি।
গোবিন্দ ধরের সংক্ষিপ্ত জীবন রচনা ও সম্মান পুরস্কার
গোবিন্দ ধর
পিতা:-- দক্ষিণা রঞ্জন ধর
মাতা:-- সুষমারাণী ধর
জন্ম: -- ৩০শে জুলাই ১৯৭১
জন্মস্থান :অফিশটিলা,ধর্মনগর,উত্তর ত্রিপুরা।
স্কুল:রাতাছড়া দ্বাদশশ্রেণি বিদ্যালয়।বর্তমান হাজিবাড়ি দ্বাদশশ্রেণি বিদ্যালয়।
পেশা:শিক্ষকতা।
প্রথম শিক্ষক জীবন:উত্তর রাতাছড়া উচ্চ বুনিয়াদি বিদ্যালয়:১৯৯১।
প্রথম প্রকাশিত রচনা:১৯৯১
প্রথম বই:জলঘর:২০০৭(কবিতা সংকলন)।
ছদ্মনাম:চৈতন্য ফকির
সম্পাদিত কাগজ:
স্রোত
স্রোত.com
স্রোত.f
কবিতাঘর
কুসুম
বাংলাভাষা
বইবাড়ি
অন্যপাঠ
উৎসব সমাচার
ভাষাচর্চা
প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্তি
প্রতিষ্ঠানের নাম,পদের নাম
ত্রিপুরা রবীন্দ্র পরিষদ :আজীবন সদস্য
সুতপাঃআজীবন গ্রাহক
স্রোতস্বিনী সাংস্কৃতিক সংস্থা :সম্পাদক
মহামায়া নাট্য সংস্থা :সম্পাদক
স্রোত:সম্পাদক
স্রোত পরিবার:সম্পাদক
স্রোত বন্ধু দল:সম্পাদক
দোলনা:উপদেশক
কুসুম:উপদেশক
কবিতাঘর:উপদেশক
বইবাড়ি:কর্ণধার
স্রোত.f.:সম্পাদক
স্রোত.com:সম্পাদক
উৎসব সমাচার:সম্পাদক
অন্যপাঠ:কর্ণধার
বাংলাভাষা:সম্পাদক
গ্রাফিপ্রিন্ট:উপদেশক
ত্রিপুরার পুঁথি-পাণ্ডুলিপি গবেষণা কেন্দ্র:সংগ্রাহক
উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিন গবেষণা ও চর্চা কেন্দ্র:সংগ্রাহক
বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ
কুমারঘাট শাখা:সম্পাদক
সৃষ্টিলোক সাংস্কৃতিক সংস্থা :সহসভাপতি
ত্রিপুরা লিটল ম্যাগাজিন গিল্ড:সম্পাদক
উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় প্রকাশনা সংসদ:কার্যকরী সদস্য
দেও-মনু সাহিত্য মঞ্চ:কার্যকরী সদস্য
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা চর্চা সমন্বয় পরিষদ:কেন্দ্রীয় কমিটি,সদস্য
ত্রিপুরা পাবলিশার্স গিল্ড:সদস্য
শ্রীহট্টীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদ :কার্যকরী সদস্য
কবিতা সংকলন:
(১)জলঘর
(২)সূর্যসেন লেন
(৩)দ্রোহববীজ পুঁতে রাখি,একা
(৪)মনসুনমাছি
(৫)শ্রীচরণেষু বাবা
(৬)আনোয়ারা নামের মেয়েটি
(৭)দেওনদীসমগ্র
(৮)আষাঢ়ের দিনলিপি
যৌথ কবিতা সংকলন:
(১)মেঘ বৃষ্টি রোদ
(২)গোপন জোছনা
(৩)তামাদি হয়নি যে ভালোবাসা
(৪)কখনো পাহাড় কখনো নদী
(৫)এই সময়ের বত্রিশ জন কবির কবিতা
(৬)আঞ্চলিক ভাষার কবিতা
(৭)শেখড়ের ধ্বনি
(৮)কবিতা :২০০১/২০০২/২০০৩/২০০৯/২০১০
(৯)সমকালীন পনেরজন কবির কবিতা
(১০)ত্রিপুরার আবৃত্তির কবিতা
আবৃত্তির অডিও সিডি:
(১)দ্রোহবীজ:২০১৭
(২)আত্মদ্রোহ:২০১৭
(৩)শ্রীচরণেষু:২০১৭
ছড়া সংকলন:
(১)থইথই ছড়া
(২)তোমার উনিশ আমার একুশ
যৌথ ছড়া সংকলন:
(১)এই শতাব্দীর ছড়া
প্রবন্ধ ও গবেষণা:
(১)শ্রীহট্টীয় লৌকিক সংস্কৃতি ও শব্দকোষ
(২)আত্মক্ষর
(৩)ত্রিপুরার লিটল ম্যাগাজিন
(৪)ত্রিপুরার সাহিত্যকোষ
(৫)ত্রিপুরার লেখক অভিধান
(৬)কুমারঘাটের ইতিবৃত্ত ও তথ্যপুঞ্জী
(৭)কুমারঘাটেরর স্থান নাম
(৮)ত্রিপুরার লিটল ম্যাগাজিন শিশুসাহিত্য ও অন্যান্য
(৯)আলোকিত বিজয় রায়
ছদ্মনামের আড়ালে:চৈতন্যফকির
(১)সময়ের গোল্লাছুট
সম্পাদিত:
(১)শতবর্ষের আলোকে সমর সেন:ফিরে দেখা
(২)হিমাদ্রি দেব রচনা সমগ্র
(৩)ত্রিপুরার প্রথম কবিতাপত্র জোনাকি সমগ্র
(৪)অনন্য অনিল সরকার
(৫)জননেতা দশরথ দেব:জীবন ও সংগ্রাম
(৬)কথাসাহিত্যিক শ্যামল ভট্টাচার্য
(৭)সমকালীন ত্রিপুরার পাঁচজন কবি সাহিত্যিক
(৮)পীযুষ রাউত উজ্জল উদ্ধার
সম্মান ও পুরস্কার:
(১)কুমারঘাট নগর পঞ্চায়েত:২০০১
(১)অণির্বান দেশবার্তা:২০১০
(২)উত্তরণ :২০১২
(৩)প্রাণেরকথা:২০১৫
(৪)বিজয়া:২০১৬
(৫)বহ্নিশিখা সম্মান:২০১৭
(৬)কথাশিল্প(পশ্চিমবঙ্গ):২০১৭
(৭)সৃষ্টিলোক:২০১৭
(৮)ক্রিয়েটিভ :২০১২
(৯)ষষ্ট উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন(আসাম):২০১৬
(১০)বিশ্ব কবিমঞ্চ, আগরতলা শাখা সম্মান:২০১৭
(১১)সমভূমি সাহিত্য সম্মানঃ২০১৮
(১২)উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মান(পশ্চিমবঙ্গ) :২০১৮
(১৩)শব্দকোষ সাহিত্য সম্মান:২০১৮
(১৪)মণিহার সাহিত্য সম্মান:২০১৯
(১৫)উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিন সম্মান(আসাম):২০১৯
(১৬)আন্তর্জাতিক ভাষাচর্চা সম্মান(আাসাম):২০১৯
(১৭)আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা সম্মান(আসাম):২০১৯
(১৮)মাতৃভাষা সম্মান স্মারক (উদারবন্দ,আসাম):২০১৯
(১৯)বিশ্বনাথ দে স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার(সুতপা,ঝাড়খণ্ড):২০১৯
বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় গোবিন্দ ধরের কবিতা
তাপসী, যুগভেরী,কবি মঞ্চ, ভোরের আলো, উত্তর ভাবনা,
কন্ঠসাধন পত্র, দেশ প্রসঙ্গ, সবুজের জয়যাত্রা, ভাটিয়াল,
ময়মনিসংহের ‘স্বতন্ত্র’ পত্রিকায়(নদী সংখ্যা)
বঙ্গ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ,
শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮৬-১৯৭১:আত্মপ্রতিকৃতি,
বাংলাদেশে গোবিন্দ ধরের প্রবন্ধ, নৃপেন্দ্রলাল দাশ স্মারকগ্রন্থ, হাবীবুল্লাহ সিরাজী সংবর্ধনা গ্রন্থ,
ভূপতিভূষণ বর্মা সংবর্ধনাগ্রন্থ,
বাংলাদেশে গোবিন্দ ধরের সম্মান ও পুরস্কার
(১)বিশ্ব কবিমঞ্চ একুশে পদক:২০১৬
(২)কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ স্মৃতি পুরস্কার :২০১৬
(৩)বাংলাদেশ বুকক্লাব সম্মান:২০১৭
(৪)দক্ষিণ এশিয়া সাহিত্য সম্মান :২০১৭
(৫)বজ্রকথা সাহিত্য সম্নান:২০১৭
(৬)চট্রগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র সম্মানঃ২০১৭
(৭)সাহিত্য একাডেমি ব্রাহ্মণবাড়ি সাহিত্য সম্মান:২০১৭
(৮)কন্ঠসাধন সম্মান:২০১৮
(৯(বরমা বৈশাখী মেলা সম্মান:১৪২৪
(১০)উষসী সাহিত্য -সংস্কৃতি পর্ষদ সম্মান :২০১৮
(১১)সিলেট বইমেলা অতিথি সম্মান :২০১৯
(১২)জয়বাংলা ইয়থ এয়ার্ড:২০১৯
বাংলাদেশে গোবিন্দ ধর :আমন্ত্রিত অতিথি
চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র :২০১৭
দক্ষিণ এশিয় সাহিত্য উৎসব :২০১৭
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমি :২০১৭
কন্ঠসাধন আবৃত্তি উৎসব :২০১৮
উষসী আবৃত্তি উৎসব:১৪২৪
কবিমঞ্চ কবিতা আড্ডা :২০১৮
সিলেট বইমেলা:২০১৯
রৌদ্রজল বইপ্রকাশ:২০১৯
বাংলাদেশ ভ্রমণ :
ঢাকা,বাংলাদেশ :২০১৭
রংপুরঃ২০১৭
চট্টগ্রাম :২০১৭
ব্রাহ্মণবাড়িয়া:২০১৭
কমিল্লা:২০১৭
কুমিল্লা :২০১৮
কুমিল্লা :২০১৯
একুশে বইমেলা :২০১৮
সিলেট:২০১৮
মৌলভীবাজার :২০১৮
ব্রাহ্মণবাড়িয়া:২০১৮
ব্রাহ্মণবাড়িয়া:২০১৯
একুশে বইমেলা:২০১৯
সিলেট:২০১৯
তিনি থেমে নেই। যতো দিন যাচ্ছে তিনি নদীর মতো বাঁক নিচ্ছেন।আর বাঁকে বাঁকে গজাচ্ছে একটার পর গাছ চেতুয়াংবৃক্ষ।
0 Comments