ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য || অধ্যাপক শাহানা পারভীন লাভলী

তৃতীয় আগরতলা লিটিল ম্যাগাজিন মেলা অনুষ্ঠিত হবে ২৬ ও ২৭ মে। যেহেতু এই আয়োজনটি হচ্ছে মে মাসে এবং ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পরে ১৯৬১ সালের এই মে মাসে (১৯ মে) আসামের  বরাক উত্যকার শিলচরে বাংলা ভাষার দাবিতে আরো একটি মিছিলে পুলিশের গুলিতে ১১ জন শহীদ হন। যাদের মধ্যে একজন নারীও ছিলেন। যেহেতু এই মে মাসে ভাষার মিছিলে গুলি চলে সে কারণে সেই ভাষার মিছিলে শহীদ হওয়া একমাত্র নারী ভাষা শহীদ  কমলা ভট্টাচার্যকে নিয়েই আজকের লেখা।
 
অনেককে বলতে শোনা যায় মাতৃভাষার জন্য রক্ত দেয়ার নজির রয়েছে একমাত্র ঢাকাতেই। এটা যারা বলেন তারা হয়তো বিষয়টি সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত নন অথবা না বুঝেই বলেন। মাতৃভাষার জন্য সবচেয়ে বেশি মানুষের রক্ত দেয়ার ঘটনা ঘটে এই সাব-কন্টিনেন্টেই। তবে, সেটা ঢাকায় নয়। ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকার শিলচরে। এই শিলচরটাও এসময় বাংলাদেশের মধ্যেই ছিল। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা সবই বাংলাদেশের মধ্যেই থাকার কথা ছিল। কিন্তু ভারত ভাগের পর এক অবাক করা কাগুজে ভাগের কারণে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামের মানুষেরা আজ আমাদের কাছে ভিনদেশি হয়ে গেছে। অথচ আমাদের এক বাংলা মায়ের সন্তানই থাকার কথা ছিল। 
সে যাই হোক। ওটা অনেক বড় আলোচনা। আজ ও বিষয়ে যাচ্ছিনে। আজকে বলবো ঊনিশে মে’র কথা। এক সাহসী নারীর জীবন দেয়ার কথা। এটা সকলের জানা, ১৯৬১ সালে ১৯ মে শিলচরে মাতৃভাষার দাবিতে বিক্ষোভ-আন্দোলন শুরু হয়। শিলচরের বরাক উপত্যকায় মাতৃভাষা দাবির এক শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশ অতর্কিতভাবে গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে সেখানেই ঝরে পড়ে ১১টি তরতাজা প্রাণ। যাদের মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য নামে একজন নারীও ছিলেন। যে ১১ জন মানুষ মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান তারা সবাই একসময় এই বাংলাদেশের অধিবাসী ছিলেন। তাদের সকলেরই জন্ম বাংলাদেশেই। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর ব্রিটিশদের এক অদ্ভুত নিয়মে সিলেটের করিমগঞ্জ জেলা আসামের ভাগে চলে যায়। বাংলাদেশের এই মানুষগুলো হয়ে যান অসমীয়া তথা ভারতীয়। 
এখানে একজন নারীকে নিয়ে আলোচনা করবো। যিনি মাতৃভাষা আন্দোলনের একমাত্র শহিদ নারী। তিনি সিলেটের ১৬ বছরের কিশোরি কমলা ভট্টাচার্য। তিনি বাংলা ভাষার জন্যে প্রথম এবং একমাত্র নারী শহিদ।

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
ভাষাবিপ্লবি কমলা ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৫ সালে অবিভক্ত বাংলার সিলেটে। তাঁর বাবার নাম রামরমন ভট্টাচার্য এবং মা সুপ্রবাসিনী দেবী। ছেলেবেলায় বাবাকে হারান কমলা। সাত ভাইবোনের মধ্যে কমলা পঞ্চম আর বোনদের মধ্যে তৃতীয়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কমলারা পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আবারও হিন্দুদের ওপর অত্যাচার এবং গণহারে হত্যা শুরু হলে কমলার পরিবার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তারই রেশ ধরে সাত সন্তানকে নিয়ে বিধবা সুপ্রবাসিনী দেবী ভারতে পাড়ি জমান। পশ্চিমবঙ্গে না গিয়ে তিনি আশ্রয় নেন একসময়ের অবিভিক্ত বৃহত্তর সিলেটের অংশ শিলচরে। মাত্র ৫ বছর বয়সে উদ্বাস্তু হয়ে শিলচরে পা রেখেছিল কমলা।
   

শিক্ষাজীবন
কমলার শিক্ষা জীবন শুরু হয়, ছোটেলাল শেঠ ইন্সটিটিউটে। একে তো উদ্বাস্তু, তার ওপর অনটনের সংসার। কমলার বড় দিদি বেণু নার্সিংয়ের চাকরি পেয়ে প্রশিক্ষণের জন্যে শিমুলগুড়ি চলে যান। কমলার মেঝ দিদি প্রতিভা ছিলেন স্কুলের শিক্ষিকা। অর্থনৈতিকভাবে গোটা পরিবার তার ওপরই নির্ভর ছিল। বই খাতা কেনার পয়সা ছিল না কমলার। সহপাঠিদের কাছ থেকে বই ধার করে খাতায় টুকে নিয়ে পড়তো কমলা।
শোনা যায়, একটি অভিধানের জন্যে বোন প্রতিভাকে বলেছিল কমলা। অর্থের অভাবে সেটাও কিনে দিতে পারেনি বোন। অভাবের মাঝে বড় হওয়া কমলা তবুও  স্বপ্ন দেখেন স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়ালেখা করার। পড়াশোনার পাশাপাশি টাইপরাইটিং শিখে একটা কেরানির চাকরি হলেও জুটিয়ে নেবে। তাহলে আর মায়ের কষ্ট থাকবে না। 
১৯৬১ সালে কমলা ক্লাশ টেন’র ছাত্রী। এসময়ে বরাক উপত্যকা মাতৃভাষার সংগ্রামে উত্তাল হয়ে ওঠে। অভাবের সংসারে বেড়ে উঠলেও কমলা ছিলেন প্রতিবাদি স্বভাবের মেয়ে। আসাম রাজ্য সরকারের ভাষানীতির বিরুদ্ধে সেও ছিল সোচ্চার।

মাতৃভাষার সংগ্রামে
১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে শিলচরের কাছাড়ে গঠিত হয় ‘কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ’। সেখানে নেতাদের বক্তৃতা শুনে ভাষা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয় কমলা। সামনেই তার মাধ্যমিক পরীক্ষা। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে চলে যায় সত্যাগ্রহি আন্দোলনে।
১৯৬১ সালের ১৪ এপ্রিল নববর্ষের দিনে ‘সংকল্প দিবস’-এ সেও অংশগ্রহণ করে। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার শপথ নেয়। এদিকে সত্যাগ্রহি আন্দোলনকারিরা ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু করে পদযাত্রা শেষ করে ২ মে শিলচরে। আন্দোলনকারিরা ঘোষণা করেÑ ১৩ এপ্রিলের মধ্যে ভাষা বিল বাতিল না হলে ১৯ মে বরাক উপত্যকায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হবে।
১৮ মে ছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিন। তাই পরীক্ষা শেষে হরতালে যেতে আর কোন বাধা নেই। সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করলো কমলা। দেশ ছেড়ে আজ পরবাসে। তাদের পরিচয় উদ্বাস্তু। যে ভাষাটা নিজের ছিল,  সেটাও আর থাকছে না। এই মর্মবেদনা কমলার মনকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। মেজো বোন প্রতিভা কমলাকে হরতালে যেতে নিষেধ করে। কিন্তু কিছুতেই তাঁকে ঘরে আটকে রাখা যায়নি। কমলার মা সুপ্রবাসিনী দেবী মেয়ের মর্মবেদনা বুঝলেন। কিন্তু বাধা দিলেন না। নিরবে চোখের জল ফেলে মেয়েকে বিদায় দিলেন।

ডেটলাইন ১৯ মে
১৯৬১ সালের ১৯ মে সকালে মেঝো বোন প্রতিভার স্কুলে যাওয়ার শাড়ি-ব্লাউজ পরে কমলা বাসা থেকে বের হয়। যাওয়ার আগে মায়ের কাছ থেকে এক টুকরো কাপড় চেয়ে নেয়। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়লে যেন মুখে চেপে ধরতে পারে। যাওয়ার আগেমা মেয়েকে কিছু খেয়ে যেতে বলেছেলেন। কিন্তু ঘরে কিছুই না থাকায় কমলা খালি পেটেই বের হয়। সাথে ছিল কমলার সবসময়ের সঙ্গী ১১ বছরের ছোট বোন মঙ্গলা।
স্থানিয় সত্যাগ্রহ আন্দোলনের নেত্রী জ্যোৎস্না চন্দের ডাকে ২০/২২ জনের একটি নারীর দলে যোগ দেয় কমলা।  গন্তব্য শিলচর রেলওয়ে স্টেশন।
মায়ের মনে সেদিন কী উঠেছিল কে জানে! দুপুরের দিকে কমলার ছোট ভাই বকুল আর বড় বোনের ছেলে বাপ্পাকে নিয়ে রেলওয়ে স্টেশনে আসেন কমলার বিধবা মা সুপ্রবাসিনী দেবী। বকুল আর বাপ্পাকে প্রথমে পুলিশ ধরলেও পরে ছেড়ে দেয়। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মাকে আবার বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় কমলা। সেই ছিল মায়ের তার শেষ সাক্ষাত।
আন্দোলনের তীব্রতায় হতচকিত এবং দিশেহারা হয়ে পড়ে আসাম রাজ্য সরকার। রাজ্য সরকার পুলিশের সাথে আসাম রাইফেল বাহিনীকেও শিলচর রেলস্টেশনে পাঠায়। আন্দোনরত নেতাদের ধরে ট্রাকে তুলতে গেলে জনতা পুলিশের ট্রাক ঘেরাও করে।
তখন সকলের মুখে একটাই শ্লোগানÑ 
‘বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ
মাতৃভাষা জিন্দাবাদ।’
এসময় পুলিশ ও রাইফেল বাহিনী আন্দোলনকারিদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে। লাঠিচার্জ থেকে বোনকে বাঁচাতে মঙ্গলাকে নিজের সাথে আকড়ে ধরে কমলা। বিনা প্ররোচনায় দুপুর ২.৪৫ মিনিটে পুলিশ ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে ১৭ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। পুলিশের গুলিতে একটি গুলি কমলার চোখ দিয়ে ঢুকে মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। লুটিয়ে পড়েন কমলা ভট্টাচার্য। সেখানেই ১৬ বছরের কিশোরি কমলার মৃত্যু হয়। ভাষা আন্দোলনের প্রথম এবং একমাত্র নারী শহিদ কমলা ভট্টাচার্য। এরপর একে একে আরো ১০টি তরতাজা প্রাণ ঝরে যায়। কমলার বোন আহত হলেও মঙ্গলা হাসপাতালে গিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে, তার চোখের সামনে বোনের মৃত্যু তাকে চিরদিনের জন্যে অপ্রকৃতস্থ করে তোলে।

একমাত্র নারী ভাষাশহিদ কমলা
কমলার মৃত্যুর পর রেজাল্ট বের হয়। মাধ্যমিকে সে ঠিকই পাস করেছিল। কিন্তু তাঁর আর চাকরি করা হয়নি। মেয়ের রেজাল্ট নিয়ে বিধবা মা বাকি জীবন আর্তনাদ করেকাটিয়েছেন। কমলার আত্মদান বৃথা যায়নি। কমলাসহ সেই ১১ জন শহিদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাকে আসামের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় আসাম রাজ্য সরকার।

স্বীকৃতি
কমলাসহ ১১ জন শহীদের আবক্ষ মূর্তিসহ একটি ব্রোঞ্জ ফলক রয়েছে শিলচর স্টেশনের এক শহিদ বেদির ওপর। শিলচর স্টেশনকে ‘ভাষা শহিদ স্টেশন’ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।
২০১১ সালে ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তিতে কমলার স্কুল ছোটেলাল শেঠ ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গনে কমলার একটি আবক্ষ ব্রোঞ্জমূর্তি স্থাপন করা হয়। শিলচরের পাবলিক স্কুলের পাশের সড়কটির নামকরণ করা হয়ে ‘কমলা ভট্টাচার্য সড়ক’। এই রাস্তার পাশেই ভাড়া থাকত কমলার পরিবার।
 
 
অধ্যাপক শাহানা পারভীন লাভলী
কবি, লেখক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ
অধ্যাপক, শেখ ফজিলাতুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর, ঢাকা
যোগাযোগের ঠিকানা : মোহসেনা ফেয়ারি ভিস্তা, ৪৩৩, সেনপাড়া 
পর্বতা (ফ্লাট # এ-১, দোতলা), কাফরুল, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬ 
ফোন : +৮৮০১৭৭৭ ৯৮৭ ৭০৩, 
ইমেল : ংঢ়বৎাববহষড়াবষু@মসধরষ.পড়স
প্রকাশিত বই

0 Comments