শমসেরনামা || গোবিন্দ ধর
শমসেরনামা
গোবিন্দ ধর
কথাপৃষ্টা
------------
একজন মুসলিম ডাকাত সর্দার কিংবা রাজা কিংবা রাজার বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের নায়ক শমসের গাজী।তাঁর জীবন দর্শন ছিলো ধনিকশ্রেণির শোষনকে ধ্বংস করা।ধনিদের থেকে ধন এনে তিনি দুস্তদেরকে বিলিয়ে দিতেন।তিনি দীর্ঘ বার বছর ধরে চট্টগ্রাম কুমিল্লা ত্রিপুরা শাসন করেন।বিস্তিন্ন অঞ্চলের দীনদরিদ্র মানুষের নিকট তিনি ভগনান।হিন্দু ও মুসলিম উভয় অংশের নিকটই তাঁর গ্রহণ যোগ্যতা ছিলো।কথিত আছে মাতাবাড়ির মাকে তিনি পুজোও দেন।এখনো সমশের গাজীর দীঘি,রাজবাড়ির গোপন সুড়ঙ্গ পথ যে পথ ধরে সমশেরের রাণীরা দীঘিতে স্নানে আসতেন তা,গভীর জঙলে ঢাকা অবস্থায় অবহেলায় প্রায় ধ্বংসের কাছাকাছি আছে।এই প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থানকে সংরক্ষণ করলে গঠিত হতে পারে দক্ষিণ ত্রিপুরার নিকট মায়াবী দর্শনীয় এক ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র। সমশের শুধু রাজা নয়।অত্যাচারী শোষক নয়।গরীব প্রজার নিকট বাপ মা।
শমসের গাজী দিঘী ফেনী
------------------------------------
বৃহত্তর নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা। আঠার শতকের মাঝামাঝি দক্ষিণ-পূর্ববাংলায় এক বিপ্লবীর অভ্যুদয় ঘটে। তাঁর নাম শমসের গাজী। ‘বাংলার বীর’, ‘ভাটির বাঘ’ তাঁর উপাধি। মগ-পর্তুগীজ জলদস্যুদের বিরুদ্ধে তিনি গড়ে তোলেন এক লাঠিয়াল বাহিনী। উপকূলীয় জনপদ থেকে বিতাড়িত হয় হার্মাদরা। কবি সৈয়দ সুলতানের উত্তরপুরুষ সৈয়দ গদা হোসেন তাঁর অন্তরে জ্বালিয়ে দিলেন জ্ঞানপ্রদীপ। জমিদারকন্যা দরিয়াবিবির সঙ্গে অসফল প্রেম তাঁর জীবনকে উন্নীত করে ভিন্ন মাত্রায়। কৃষক-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অধিকার করে নেন জমিদারি।
বঙ্গবীর শমসের গাজী বর্তমান ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলাতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল পীর মুহাম্মদ মতান্তরে পেয়ার মুহাম্মদ খান এবং মাতার নাম ছিল কৈয়্যারা বিবি। তিনি প্রথম জীবনে এক জমিদারের ক্রীতদাস ছিলেন।
ছোটবেলা
---------------
ফেনীর ছাগলনাইয়া থেকে গ্র্যান্ড ট্র্যাংক রোড ধরে ৭ কিলোমিটার চট্টগ্রামের দিকে গেলেই সামনে পড়ে কৈয়ারা বাজার। এখানে গ্রামটির নামও কৈয়ারা। এই কৈয়ারা গ্রামটি কৈয়ারা বিবির নামানুসারে রাখা হয়েছে। আর কৈয়ারা বিবি হচ্ছেন শমসের গাজীর মা। শমসের গাজীকে বলা হয় ভাটির বাঘ। তার বাবার নাম পীর মোহাম্মদ। পীর মোহাম্মদ একজন খাজনা আদায়কারী ছিলেন। কোনো এক কারণে তিনি কাজ ছেড়ে দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বেদরাবাদ এলাকায় চলে আসেন। আর্থিক কষ্টে তিনি যখন দিশেহারা তখন নিজকুঞ্জরা মৌজার দানশীল ব্যক্তি নাসির মন চৌধুরী তাকে আশ্রয় দেন। সেই বাড়িতেই শমসের গাজী ভূমিষ্ট হন। শমসের গাজীর বাল্যকাল ছিল বৈচিত্র্যময়। অতি অল্প বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। অভাবের সংসার সত্ত্বেও বালক শমসের ছিলেন খুবই দুরন্ত স্বভাবের। একদিন মায়ের বকুনি খেয়ে তিনি ফেনী নদীর তীরে বসে কাঁদছিলেন। তখন শুভপুরের তালুকদার জগন্নাথ সেন শমসেরকে দেখতে পান। দয়াপরবশ হয়ে তিনি শমসেরকে শুভপুর নিয়ে যান। শুভপুরের তালুকদারের কোনো সন্তান ছিল না। সেখানে স্নেহ-মমতার মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকেন শমসের গাজী। লেখাপড়ার পাশাপাশি কুস্তি, লাঠিখেলা, তীর-ধনুক চালনায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন বিষয়ে হাতে-কলমে তালিম নিতে থাকেন।
জমিদারি লাভ
--------------------
তালুকদার জগন্নাথ সেনের মৃত্যুর পর যুবক শমসের গাজী শুভপুরের খাজনা আদায় শুরু করেন। শুরু হয় তার উত্থান। সে সময় তিনি চোর ডাকাত ও জলদস্যুদের রুখতে এক শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন। গাজীর এই বাহিনীর সেনাপতি ছিল তার জ্ঞাতি ভাই ছাদু পালোয়ান। ১৭৩৯ সালের দিকে ত্রিপুরার মহারাজের সেনাপতি শমসের গাজীর এলাকায় প্রবেশ করলে সেনাপতি ছাদু পালোয়ানের প্রতিরোধে তারা ধরাশায়ী এবং বন্দি হন। ত্রিপুরার মহারাজ তার সেনাপতির মুক্তির শর্তে গাজী কেদক্ষিণশিকের বৈধ জমিদার হিসেবে স্বীকৃতি দেন। শমসের গাজী ছিলেন প্রজাদরদি। পাহাড়িয়া ঢলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হলে তিনি কৃষকের এক বছরের খাজনা মওকুফ করে দেন এবং পরবর্তী তিন বছর মহারাজের রাজকোষে খাজনা দেয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন। এতে ত্রিপুরা মহারাজ ক্ষিপ্ত হয়ে প্রায় ৭ হাজার সৈন্য পাঠায় গাজীকে উচ্ছেদ করার জন্য। ফল হয় বিপরীত। শোচনীয় পরাজয়ে প্রাসাদ ছেড়ে জঙ্গলে আত্মগোপন করেন। ত্রিপুরা রাজ্যের বিরাট অংশ শমসের গাজীর করতলে এসে যায়। শমসের গাজীর রাজত্বকালে ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুরেই ছিল। তবে তিনি বেশিরভাগ সময় রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে ফেনী নদীবেষ্টিত জগন্নাথ-সোনাপুরস্থ চম্পকনগরে তার প্রধান কেল্লা ও রাজপ্রাসাদে থাকতেন।
স্মৃতি ও কীর্তির নিদর্শন
-------------------------------
কৃষক-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অধিকার করে নেন জমিদারি। প্রজাবিদ্বেষী কর্মকান্ডের বিরোধিতা করে রোষানলের শিকার হন ত্রিপুররাজের। শুরু হয় তুমুল লড়াই। গর্জে ওঠেন ভাটির বাঘ। ভুখানাঙা চাষাভুষাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধক্ষেত্রে। হীরকডানায় ভর করে যুদ্ধক্ষেত্র দাপিয়ে বেড়ান তেজোদীপ্ত যবন বীর শমসের। শত্রুসেনা বিনাশ করতে করতে হয়ে ওঠেন অবিনাশী যোদ্ধা, অপ্রতিরোধ্য হন্তারক। অধিকার করে নেন রাজ-সিংহাসন। ত্রিপুরা রাজ্য শাসন করেন টানা এক যুগ। তাঁর কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়ে ইংরেজ বেনিয়ারা।
ছাগলনাইয়ার চম্পকনগরে ভারতের সীমান্ত এলাকাটি শমসের গাজীর স্মৃতি বিজড়িত স্থান। এখানে রয়েছে শমসের গাজীর সুড়ঙ্গ, শমসের গাজীর দীঘি এবং আরও অনেক কিছু। তবে তার প্রাসাদসহ অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ ভারতের ত্রিপুরার মধ্যে ভাগ হয়ে রয়ে গেছে।
নির্মমভাবে হত্যা
----------------------
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর মুর্শিদাবাদের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। বাংলার এমন দুর্যোগ মুহূর্তে স্থানীয় কুচক্রী মহল, ঢাকার নবাবের প্রতিনিধি, ইংরেজ বেনিয়া ও পরাজিত, বিতাড়িত ত্রিপুরার মহারাজ একত্রিত হয় শমসের গাজীর বিরুদ্ধে। শমসের গাজীর দেশপ্রেম ও সাহসিকতা ইংরেজ এবং এ দেশীয় দালাল কুচক্রীদের ভীত করে তুলেছিল। নবাবের নামে মূলত ইংরেজরাই ষড়যন্ত্র করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী এবং যুবরাজ কৃষ্ণমাণিক্যের নেতৃত্বে পাহাড়ী উপজাতীয় যৌথবাহিনী শমসের গাজীর কেল্লা ও উদয়পুরে আক্রমণ চালিয়ে গাজীকে পরাজিত ও আটক করে। তাদের এতটাই আক্রোশ ছিল যে, ত্রিপুরার মহারাজ হাতিসহ হাজার হাজার সৈন্য পাঠিয়ে চম্পকনগরস্থ শমসের গাজীর প্রাসাদ ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে।
শুরু হয় আরেক লড়াই। চম্পকনগর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দী হলেও আবার পালিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। একদিকে তিনি অকুতোভয় বীর, প্রজাদরদি রাজা, বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, অন্যদিকে মনকাড়া বাঁশিওয়ালা। গভীর রাতে বাঁশির সুর শুনে বেরিয়ে আসেন আত্মগোপন থেকে। অমীমাংসিত থেকে যায় তাঁর মৃত্যু।
কিভাবে যাওয়া যায়:
---------------------------
ফেনী থেকে সি এন জি কিংবা বাস দিয়ে পরশুরাম, পরশুরাম থেকে সি এন জি দিয়ে শমসের গাজী দিঘী যাওয়া যায়।ইতিহাসের এক ট্রাজেডি এই শমসের।
শেষপৃষ্টা
------------
ত্রিপুরার আমলিঘাট সম সের গাজির আস্তানা।তিনি আঠারোশো সালের প্রথমার্থে ত্রিপুরার বাসিন্দা ছিলেন। ত্রিপুরার রাজাকে সিংহাসন চ্যূত করে কিছুকাল রাজত্ব করেন বলে রাজমালা ও কৃষ্ণমালায় উল্লেখিত ।তারপর তিনি এক সময় বাংলাদেশ চলে যান।শমসের গাজী ডাকাত সর্দার। শমসের গাজীর নেতৃত্বে ইংরেজদের বিরুদ্ধে হয় কৃষক বিদ্রোহ।তিনি ছিলেন পর উপকারী।গরীবের বন্ধু।নিজে ছিলেন সহায় সম্বল হীন।ত্রিপুরার শেষ সীমানা সাব্রুমের এক প্রান্তিক গ্রাম আমলিঘাটের নিকটবর্তী ফেণি নদীর উত্তাল ঢেউ পাশেই ফেণির মেরুকুম চাঁদ সাগরের ডিঙ্গি দুমড়ে মুছড়ে দিয়েছিলো বলে জনশ্রুতি আজোও লোকের মুখে মুখে।এখান থেকে ফেণি কলকল বঙ্গোপসাগরের সাথে মিশতে লকলক করে এগিয়ে যাচ্ছে।কাছেই বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার চম্পকনগর।এখানে চাঁদ সদাগরের সওদাগরি ছিলো।বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের লৌহার বাসরঘর চম্পকনগরে ছিলো বলে কথিত।কালিদহ এখানেই।প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ফেণি কলকল প্রবাহিত।আমলিঘাটের বাসিন্দা কবি সাঁচীরাম মানিক।আমরা কবি ও প্রাবন্ধিক সঞ্জীব দে ও আমি আজ ডু মারি জলেফা হয়ে মনুঘাট ধরে চলে এলাম আমলিঘাট।মগ ভাষায় জলেফা মানে জলের দেবতা।ফা মানে দেবতা।জলে অথাৎ জলের।এই থেকেই জলেফা।কথিত আছে সারা ত্রিপুরার জল শুকিয়ে গেলেও জলেফাতে জল থাকে।ভৌগোলিক দিক দিয়ে দেখলে এখনো যেকোন সময় এখান দিয়ে সন্ত্রাসবাদী আক্রমন হতেই পারে।প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য আমলিঘাটের ফরেস্ট টু্রিস্ট টাওয়ার থেকে এখনো চাঁদ সদাগরের ডিঙ্গি ডুবার স্থানকে দেখা যায়।মেরুকুম মানে গভীর ডহরলাগা জলাসয় বুঝায়।ফেণী নদীর জল এখানে এসে ডহর তৈরী করেছে।জল এই অঞ্চলে এসে এমন ঘুরপাক খায় বড় ডিঙ্গিও তলিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক।গাজীনামায় পাই শমসের গাজি ত্রিপুরায় ১২বছর রাজত্ব করেন।তিনি প্রথম ত্রিপুরায় দ্রব্যের বিনিময়ে দ্রব্য এই প্রথা চালু করেন।
এখানে এখনে দেখা যায় শমমের গাজীর সুড়্ঙ্গ পথ।এই পথ ব্যবহার হত স্ত্রীদের আসা যাওয়ার নিরাপদ স্থান হিসেবে।আবার শত্রুর আক্রমণ হলেও ব্যবহৃত হতো।সম সের গাজির প্রাসাদের ভংগ্নাশেস।
আছে শিবমন্দির।আছে মামা-ভাগ্নের টিলা।
সব কিছুকে দাবিয়ে রেখে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করলো।
শিবমন্দির আমলিঘাটের একটি দর্শনীয় স্থান।সন্যাসীটিলায় শিব-দুর্গা ধ্যান করেছেন বলে কথিত।বেল গাছগুলো এখনো আছে।এখান থেকেও মেরুকুম দেখা যায়।ফেণি নদীর দুই তীর থেকে বারুনী ও দশমী দিন দুদেশের লোক সমাগম হয়।তখন বর্ডারের আর তেমন বালাই থাকে না।এখান থেকে সুপুর ব্রীজ ফেণি নদীর এক বিশাল ব্রীজ।এখান থেকে লক্ষ করলে দেখা যায়।সারাদিন ঘুরঘুরতে বিকেলে চলে এলাম সাঁচীদার বাসায়।বহুদিন পর দেশি মোররগের মাংস ডাল আর কাঁকড়ার ঝোল খেয়ে বেরিয়ে পড়ি শ্রীনগরের দিকে।রাত ৬:৩০আমি আর সঞ্জীব মনুবাজারে এলাম।পুনম (সঞ্জীবের স্ত্রী)বারবার ফোন করছে আমাদেরে পাচ্ছে না।কারণ সারাদিন আজকের ট্রিপ ছিলো ডিজিটাল ইন্ডিয়ার বাইরে।
তথ্যসূত্র:উইকিপিডিয়া ও স্থানীয়জন।সঞ্জীব দে,সাচীরাম মানিক এবং নিজস্ব ভাবনা।লেখাটি আমার কালেকশন।কোন অবস্থায় সম্পূর্ণ আমার নয়।
১১:১০:২০১৯
ভোর:০৫:২০মি
কুমারঘাট।
0 Comments