পারিবারিক পরিক্রমা :নীরমহলের মহল মহল্লায় কবিতার দেশ ত্রিপুরা 

গোবিন্দ ধর
সৈয়দা আঁখি হক মতিউর রহমান হাসান হরফে পাগল হাসান দুজনই প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার লোকজনাড়ির গভীর আলিঙ্গন করে ওঠে আসা তারুণ্যের উচ্ছাস।
আঁখির সাথে পূর্ব পরিচয় আমার সে ৬/৭ বছর হলো।নিয়মিত যোগাযোগ না হলেও বিচ্ছিন্ন নয়।আঁখি সর্বদা কাজে ডুবে থাকতেই ভালোবাসেন।তাঁর সাথে আমাদের সাংস্কৃতিক বই প্রকাশ এবং বাংলাদেশ ত্রিপুরা বইমেলায়ও উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ করে আসছিলাম বিগত ক'বছর ধরে। কিন্তু আঁখি তাঁর চোখের আলোয় বুঝিয়ে দিতেন এখন নয় তবে আসবো দাদা।আমিও নাছোড়। বিগত এক বছর আগে আমাকে কথা দিয়েছিলেন আসবেন।কিন্তু লোক গবেষক আঁখি শেষমেষ বলেই ছিলেন তিনি ২৯ ডিসেম্বর আগরতলা আসবেন আমার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য। অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলে রাখি ২০১৮ সালে একুশে বইনেলায় শ্রীহট্টীয় প্রকাশনালয়ের স্টলে মোস্তফা ভাই পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পরপরই শুরু হয়েছিল একটি সাক্ষাৎকার কথোপকথন। তারপর তাঁর বিস্তৃত কাজ কর্ম নিয়ে আরো কিছু কাজ রয়ে গিয়েছিল সে অসমাপ্ত কাজের শেষ তুলির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ এই ২৯ ডিসেম্বর। তিনি এলেন।ইতিমধ্যেই জেনেছি ২৯ ডিসেম্বর তাঁর শুভজন্মদিন। 
তাঁকে আজ আমরা সম্মানিত করবো।পাশাপাশি লোকসংস্কৃতি উৎসব উদযাপন উপলক্ষে আগরতলা প্রেসক্লাবের ভূমিতলে ত্রিপুরার কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা উপছে পড়বেন সৈয়দা আঁখি হককে অভ্যর্থণা জানাতে সে বিশ্বাস রাখি। 
এইটুকু ভূনিকার পর বলি গত পরশু ২৭ ডিসেম্বর তিনি আখাউড়া চেকপোস্ট ক্রস করে দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান করেন।বিগত পাঁচ সাত বছর ধরে তাঁকে চেয়েছিলাম ত্রিপুরায়।অবশেষে তিনি এলেন।হোটেল ফিরোজায় ওয়েস্টার্ন ক্লাবের পাশেই বিশ্রাম ও জলখাবারের ব্যবস্থা বিকেলে দেখা হবে ঠিক চারটায় বলে আমি সামান্য কেনাকাটা সেরে চলে এলাম আঁখি ও পাগল হাসানকে দেওয়া নির্ধারিত ত্রিপুরা রাজবাড়ি উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদের গেটের সামনে।এসে দেখলাম দুই পাগল তৃতীয় পাগলের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন।আমি আর গৌরব মিলে এবার চারজন।রাজবাড়ির ভেতরের স্মৃতি জড়ানো ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলো আবার মগজে ঝালিয়ে নিতে নিতে বাইরে এলাম।ভেতরে প্রবেশের আগে ও বেরিয়ে এসেও স্থিরমুহূর্তে মুহূর্তে মুহূর্তে আমরা ক্লিক হচ্ছেিলাম।
কখন রাত নেমে এলো।পুব আকাশে সুন্দর চাঁদ জেগে উঠছে।আমি আর গৌরব অন্য কাজ সেরে গৌরবকে লিচুবাগান পাঠিয়েদিলাম।
তারপর হোটেল ফিরোজা থেকে রয়াল গেস্ট হাউসে তুলে দিলাম দুজনের দুটো নির্দিষ্ট ২০১ ও ২০৪ নম্বর রুমে। আমিও অত:পর লিচুবাগান চলে আসি।কথাছিলো পরদিন মেলাঘর নীরমহল পরিক্রমা হবে।সে মোতাবেক আমি গৌরব সুমিতা হোটেল রয়ালে চলে আসি।বেলা তখন ২৮ ডিসেম্বর সকাল ১০ টা।আমরা বের হওয়ার আগে লোকশিল্পী গীতি কবি পাগলকে ডাকাডাকি করেও নেওয়া গেলো না নীরমহলের শীতল পৌষের কনকনে আবহাওয়ায়। যদিও আজ শীত নেই। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। গ্রীষ্মের দুপুরের মতোই আজ গরম নেমেছে। নীরমহলের জল আগের মতো টলটলে নয়।স্বচ্ছ নয়।আগাছা আর জার্মানী পানায় ভর্তি।শীতপাখি সাইবেরিয়া থেকে সে রকম জলাশয়ে নেই। 
আমরা লঞ্চে টিকিট কেটে উঠলাম।টিকিট জনপ্রতি ৫০ টাকা।ভেতরেও টিকিট কেটে ঢুকতে হয়।এখন তিরিশ চল্লিশ। আগে ভেতরে ঢুকতে টাকার প্রশ্ন ছিলো না।  নীরমহলের শীতল পৌষের কনকনে আবহাওয়ায় যখন নামলাম মহলের উদ্যেশ্যে তখন আমাদের ঘাম ঝরছে।প্রকৃতি ততোটাই উত্তপ্ত।
অবশেষে নীরমহলে পা রাখলাম।মনে হলো আমরা ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে আছি।
হাজার ছবি হলাম।মোবাইলে আর সামলানো কঠিন।ছবির দেশ কবির দেশ ত্রিপুরার ভূ-প্রকৃতি আর আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশের জল আলো আবহাওয়া ভাষা লোকজ সংস্কৃতি এক এবং অভিন্ন তবুও এই বাংলা ও বাঙালিদের বিচ্ছিন্ন করে দিতেই যেন তৎকালীন সময়ে আমাদের দেশ ভারতবর্ষ আর বাংলাদেশ তৎকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে গেলো সিলেটের প্রহসন ঐতিহাসিক গণভোটের মাধ্যমে। যদিও এই গণভোট কতটুকু গণভোট ভয়ডরহীন ছিলো তা ইতিহাসের কালখণ্ডে এখনো ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে আসে।আসবেই ইহা স্বাভাবিক। 
আমরা হনহনিয়ে ঘুরছি।আমাদের সাথে লোকশিল্পী শুক্লা আছেন।না থেকেও শাশ্বতী দাস আছেন।ইতিমধ্যেই বহুবার কথা হলো লোকউৎসবে অতিথিদের জন্য থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা বিষয়ে।
কত কত কাজকর্ম তবুও লোকসম্রজ্ঞী সৈয়দা আঁখি হকের সাথে সময় না দিতে পারলে কথোপকথন পর্বেরও সমাপ্তি টানতে পারছিলাম না।আজ নীরমহলের ব্যস্ত লোকারন্যে সে কাজ সমাপ্তি ঘোষণা করা না গেলেও সম্পূর্ণ হবে সেকথা বলা যায়।
দুপুর তিনটে তখন আমরা নীরমহলের জল থইথই রুদীজলা থেকে উঠলাম।আবার পুচকা ঝালমুড়ি শশা ও না ছবিটবি উঠছেই গৌরব শুক্লা আঁখি।আমাকেও বাদ দেওয়া হচ্ছে না। টটো ধরে মেলাঘরের আর্দশ হোটেলে দুপুরের  আহার  সারলাম। তারপর গাড়ির জন্য অপেক্ষা। কিন্তু বেশীক্ষণ দাঁড়ানোর প্রয়োজন হয়নি।বাস চলে এসছে।তড়িঘড়ি বাসে উঠলাম।সিট পেয়ে গেলাম।সন্ধ্যা হয় হয় আমরা নাগেরজলা এলাম।নেমে আ্খিসহ আমরা হর্কাসে গেলাম।আমি চলে গেলাম শান্তিপাড়া পশ্চিম পাড়ে।এখানে গত তিনদিন আগেই ত্রিপুরার লোকধর্ম ও লোকাচার বইটি কলকাতা থেকে এসে পড়ে আছে কদিন।আজ অশোকানন্দ রায়বর্ধনের বইটি প্রকাশ করা হবে। 
হকার্সে সূর্য চৌমুহনী এসে পাগল যোগ দিলো।আমি ডিজিটেক চলে এসে রাত দশটা অব্দি লোকউৎসবের মেমোন্টো শংসাপত্রগুলো রেডি করে বাসায় এলাম রাত তখন ১১টা।চাঁদ তখন অকাশের মাথার উপর ছাতার মতোই লটকে আছে। 
লিচুবাগান এলাম।ওরা কেনাকাটা সেরে রয়ালে চলে এলো।আমিও রাতের খাওয়ার অপেক্ষা করা সুমিতাকে আস্বস্ত করে খেয়ে নিলাম।আজকের চূড়ান্ত প্রস্তুতি শেষে শুভজন্মদিন জানিয়ে আমি ঘুমাতে গেলাম। কিন্তু সারারাত ঘুম নেই। চোখ জ্বলছে। কিন্তু ঘুম নেই। আজকাল ঘুমবাবাজি ডিগবাজি খেয়েছেন।তিনি আর রাতে আসেন না।কিন্তু চুলদাড়ি সেভ হতে গিয়ে সেলুনের নোংরা চেয়ারে বসলেই আমার চোখ মুদে আসে। গাড়িতে বসলেই আমার ঘুম চলে আসে।নানা আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতে রাত কখন পাখির ডাকে ভোর হয়ে গেলো একটুও বুঝতে পারিনি।

২৯:১২:২০২৩
ভোর:৫টা
লিচুবাগান

0 Comments