পরিবারকে দেওয়া মেনিফেস্টো

গোবিন্দ ধর 

মৃত্যুর পর এরকম একটি লাল শার্ট পরা ছবি হয়তো কেউ খুঁজে পাবে না।দরকারও নেই। আমার মৃত্যুর পর কোনো শোকসভা স্মৃতিচারণ শোকমিছিল কিচ্ছু হোক চাই না।
কোনো ভোজসভাও না।শাকান্ন রান্নাবান্না কিচ্ছু না।
আমার মৃত্যুর পর শহরের একটি প্রাণীকে জানানো হোক এই চাওয়াচাওয়ি আমার নেই। 

আমার মৃত্যু পরবর্তী সময় উত্তরাধিকারী আত্মজের ভোজ খাওয়ার আয়োজন করা যাবে না। 
না প্রায়শ্চিত্ত করাও আমি বিশ্বাস করি না। আমার মৃত্যুর পর আত্মজ আত্মজা কেউ শোক পালন করুক আমি চাই না।
আমার শরীর কোথাও পৃথিবীর কোনো কাজে লাগানো যায় তো তাতে উৎসর্গ করা হলো।

প্রাসঙ্গিক ভাবে বলে রাখি কবি হিমাদ্রি দেবের মৃত্যুর পর যারা হিমাদ্রি বিরোধী তাদের শোকযাত্রায় সেকি লাইন পড়েছিলো বৃষ্টি বাদল পয়লা এপ্রিলের কৈলাসহরের পথ শুধু দ্বিপদীদের শহরপরিক্রমায় সেদিন সরগরম ছিলো।হিমাদ্রি দেব কবি ছিলেন।তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ ছিলেন। পাশাপাশি তাঁর অসংখ্য শত্রুর আক্রমণে তিনি ক্ষতবিক্ষত ছিলেন জীবিতকালে। অথচ শত্রুদের সেই মিছিলে মাইল মাইল পথ অতিক্রম করতে দেখা গেছে সেদিন।
সেদিন খুব বৃষ্টি ছিলো।কবি চিরনিদ্রায়। শায়িত শববাহী শকটে। শ্মশানে চিরঘুমের আগে কবিকে নিয়ে পরিক্রমা হয় শহর।কবি কোনোদিন চাননি এমন পরিক্রমা। 

হিমাদ্রি দেবের এই শোকযাত্রায় আমি যেতে পারিনি।তখন ৪৫ দিন পক্স আক্রান্ত আমি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছি।কিন্তু পা চালাতে অক্ষম ছিলাম।যেতে পারিনি।
কবির শোকযাত্রায় সেদিন যাদের দেখা যায় তাদের মধ্যে গোবিন্দ ধর উপস্থিত থাকার ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারিনি।

শোকাহত ছিলাম।কিন্তু কবি তো চাননি।তাই হয়তো প্রকৃতি আমাকে অসুস্থ করেছিলো।
এবার ২৬ অক্টোবর ২০২৩ হাংরি আন্দোলনের অন্যতম সৈনিকদের একজন মলয় রায়চৌধুরী চলে গেলেন। এরকমই একেকজন টুপ করে চলে যেতে শুরু করেছেন।এই লাইনে যে কোনো  দিন আমি তুমি সে তাহারা ঢুকে পড়া অস্বাভাবিক নয়।
গতকাল কবি হিমাদ্রি দেবের মৃত্যুর পর যেরকম চোখে জলধারা নেমেছিলো আমার সেরকম জলধারা গড়িয়েছে কথাসাহিত্যিক মলয় রায়চৌধুরীর আকস্মিক মৃত্যুতে। 
এই ধারায় কথাসাহিত্যিক প্রাবন্ধিক কবি মলয় রায়চৌধুরীর মৃত্যু পরবর্তী সময় আবার আমার চোখে বারিধারা নামলো।দেখলাম একশ্রেণির আনন্দ উল্লাস। আর আরেক শ্রেণির কুরুচিকর  অবমাননাকর মন্তব্য। কেউ কেউ গদোগদো। কেউ কেউ তেড়ে আসছেন।স্যসাল মিডিয়ার দুনিয়ায় তিনি নায়ক আবার কেউ কেউ মৃত্যু পরবর্তী শোকজ্ঞাপন না করে শ্রাদ্ধ করেও নিচ্ছেন।

আমি ব্যক্তিগতভাবো চাই না এইসব ডামাডোল। আমি চাই প্রমিনেট কবি সাহিত্যিকেরা মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তার ব্যবহৃত সকল স্মৃতিচিহৃগুলো নিয়ে গড়ে উঠুক মিউজিয়াম। আর সে মিউজিয়াম গড়ে তুলতে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিজন প্রতি বরাদ্দ করার নীতিনর্দেশিকা তৈরী করবেন সাংবিধানিক পরিকাঠামোয়।নীতিগতভাবেই আমেদের দেশ তখন আরো ঐতিহ্যের অধিকারী হবে।সাংস্কৃতিক দিকে দেশ আরো সমৃদ্ধ হবে।আগামী প্রজন্ম হবে ঋদ্ধ। 
কবির শব দান করা হবে সরকারি হাসপাতালে। মেডিকেল কলেজে।
কবি লেখক সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্বদের মিউজিয়াম করা হলে তা থেকে আগামী প্রজন্মের লোকজনের পাঠের প্রতি দায়বদ্ধতা বাড়বে।পাশাপাশি বাড়বে স্মৃতিরক্ষার প্রয়োজনীয়তা।স্মৃতি মুছে ফেললে আমাদের অগ্রসরমান প্রজন্মের নিকট গোলপোস্টহীন একটি সময় অতিবাহিত হবে।তাতে অতিক্রম করার প্রয়োজনীয়তা, দায়বদ্ধতার মনোভাব তৈরী হয় না।এতে ভাবী প্রজন্ম জানার ক্ষেত্রগুলো কি কি তা না জেনে এগোতে থাকবে।
আমাদের সময় প্রজন্মকে এগিয়ে দিতে হবে।
আমি চাই সকল সাংস্কৃতিক মানুষজনের স্মৃতি রক্ষা হোক।
শোক মিছিল যেমন চাই না তেমনি আমার মৃত্যুর পর এগুলোও চাই না।আমার মৃত্যু পরবর্তী সময় আমার লেখা পত্র সব নষ্ট করা হোক।কারণ এই নষ্ট লেখাগুলো কারো কোনো উপকারে আসবে না। 
মৃত্যু পরবর্তী সময় লাফালাফি করা হোক চাই না।শোকমিছিল না।শববাহী গাড়ি যাবে না রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবনের সামনে। কিংবা সুকান্ত একাডেমিতেও না।আমার শববাহী শকট গভীর অন্ধকার রাতে বটতলা মহাশ্মশান পৌঁছে আর পাঁচজন সাধারণের মতো শব ছাই করতে চুল্লীতে ঢুকিয়ে দেবো বডি।কারণ পছনের পূর্বেই চাই নিঃশেষ হোক শরীর।কাউকে আমন্ত্রণ করে শাকাম্ন ভোজন করানো চলবে না।আমার মৃত্যুর পর পারিবারিক শ্রাদ্ধ শাম্তি ভোজন করানো নিষিদ্ধ করা হলো।
আমার মৃত্যু সংবাদ কোনো সংবাদপত্র ছাপলে আমার পরিবার মানহানিকর মামলা করতে পারবেন সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে। পাশাপাশি মানহানীর আর্থিক ক্ষতিপূরণ এক কোটি টাকা ধার্য করা হলো ২৩০০ সাল ইংরেজি অব্ধি। পরবর্তী সময় অর্থের পরিমাণ আরো বাড়বে।
নগরের একটি প্রাণীকেও আমার মৃত্যু সংবাদ দেওয়া যাবে না। 
আমার মৃত্যুর চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার আগে দাহকর্ম সমাপনের জন্য আমার পরিবারের নিকট বলে রাখলাম। 
কোনো কবি মৃত্যুর পর কালখণ্ড অতিক্রম করতে পারবেন কি না তা নির্ধারন করবে কালখণ্ড। সাধারণ পাবলিক এই দায়ভার নেওয়ার প্রয়োজন নেই। 

আমি অতিসাধারণ। আরো তুচ্ছ একজন হতে আপত্তি নেই। আমার বিরুদ্ধে পক্ষে যা খুশি মিথ বসান।বসিয়ে বাতাসে স্ক্যাণ্ডেল করতে চান করুন।শুধু মৃত্যুর পর একটিও স্মৃতিচারণ মূলক সোসাল মিডিয়ায় পোস্ট কেউ লিখতে পারবেন না।লিখলে আপনার বিরুদ্ধেও আমার পরিবার আর্থিক হানির জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নিতে আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে আমার আপত্তি নেই। পাশাপাশি একজনও যেন পরিচিত অল্প পরিচিত কিংবা শত্রুও আমার মৃত্যু সংবাদ জানতে না পারেন এই ব্যবস্থা দৃঢ়ভাবে করতে আমার পরিবার পদক্ষেপ নিতে বাধ্য থাকবেন।
আমার কোনো ঋণ পরিশোধ করার দায়ভার আমার পরিবারের নয়।সুতরাং কারো নিকট আমি ধার চাইলে আমি দিতে পারলেই আপনি ধার দিন।অন্যথায় ধার দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন।
আমার সমস্ত লেখা পত্র স্মৃতি চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে। আমি ছিলাম এই চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করতে যাবতীয় কর্মকাণ্ড আমার পরিবার বহন করতে হবে।

একটি ছবিও কেউ পোস্ট করতে পারবেন না আমার মৃত্যুর পর। না লাল শার্টওয়ালা গোবিন্দ ধর কিংবা সাদা শার্ট পরা গোবিন্দ ধর কোনো ছবিই আমি ফেইসবুকে রাখতে চাই না।আমার মৃত্যুর পর এগুলো আমার পরিবার ছাড়া কেউ ব্যবহার করতে চাইলেও তা বেআইনি হবে।

0 Comments