সাহিত্যিক নিয়তি রায় বর্মন তাঁকে যেমন দেখেছি

গোবিন্দ ধর 

কথাপৃষ্ঠা 

সাহিত্যিক নিয়তি রায়বর্মনের সাথে আমার পরিচয় প্রাবন্ধিক গবেষক ডক্টর দেবব্রত দেবরায়ের মাধ্যমে।সম্ভবত ২০১৪ সালে।স্রোত প্রকাশনা তখন রাজধানী  আগরতলায় গুটি গুটি করে হাঁটতে শুরু করেছে।যদিও সারা ত্রিপুরায় স্রোত সাহিত্য পত্রিকা ও প্রকাশনার পরিচিতি ইতিমধ্যেই হয়ে আছে।ঐ সময় তিমিরবরণ চাকমা অনুদিত  চাকমা ভাষায় গীতাঞ্জলি অশোকানন্দ রায়বর্ধনের লোকসংকৃতি বিষয়ক একটি বই ও কবি দিলীপ দাসের এক টুকরো মরুভারত তিনটি বই আগরতলা প্রেসক্লাবে প্রকাশ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে জয়নগরের বাসভবনে আমন্ত্রণ করতে যাওয়া। সেই থেকে পরিচয়।তারপর তাঁকে আগরতলায় একজন অভিভাবিকা হিসেবে যখন যেমন প্রয়োজন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। স্রোতের নানাবিধ অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি এখনো উজ্জ্বল। আমি উজ্জীবিত হই।২০১৮ সালে তাঁর গদ্য সংগ্রহ প্রকাশ হয় স্রোত প্রকাশনা থেকে। কতবার তাঁর বাসায় বিনা নোটিশে গেছি।যখনই যাই প্রায় সময় খেয়ে আসতে হবে। তিনি মায়ের মতো আগলে রাখতে পারেন বড় থেকে ছোট সকলকেই। তারপর বিদ্যাসাগর প্রকাশ হয়।হয় মাস্টারদা সূর্য সেন। তাঁর বইগুলো প্রকাশ করার সময় নানাভাবে সহায়তা করেছেন।তাঁর সান্নিধ্যে আসতে পেরে মমতাময়ী নিয়তি রায়বর্মনকে গভীরভাবে জানা হলো আমার।আগরতলায় তাঁকে পেয়ে এক আশ্রয় হয়ে স্রোত প্রকাশনা এগিয়ে যেতে অনেকটা প্রশ্রয় পেয়েছে। তারপর ২০১৮ সালে ত্রিপুরায় পাবলিকেশন ও লিটল ম্যাগাজিনের যৌথ একটি সংস্থা গঠন করার সময়ও তিনিই কাণ্ডারীর মতো ভূমিকা নেন। প্রকাশনা মঞ্চের আত্মপ্রকাশের প্রতিষ্ঠাকালীন তিনিই উৎসাহিত করেছিলেন।এখনো তিনি তাঁরপর থেকে নানা পদ অলঙ্কৃত করেন। আছেন প্রকাশনা মঞ্চের কার্যকরী কমিটিতেও।এক কথায় নিয়তি রায়বর্মন আগরতলায় এক শেল্টার হাউস।তাঁর নিকট যে কেউ একবার পৌঁছলে মায়ের মমতায় ঝড় বাদলায় আগলে রাখেন তিনি।

জন্ম

তাঁর জন্ম উত্তর ত্রিপুরার কুর্তিতে-ঠাকুরদার সরকারি বাসভবনে ৫ জুন ১৯৫৫ সালে। ঠাকুরদা ছিলেন রাজ কর্মচারী। পিতা অসিতবরণ চক্রবর্তী আগরতলায় বিভিন্ন পত্রিকা ও লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রচার বিমুখ অসিতবরণ ছিলেন শক্ত কলমচি। তাঁর সমালোচনা সাহিত্য, কবিতা, সম্পাদকীয় স্তম্ভ (বিবেক, জাগরণ ইত্যাদিতে) প্রকাশিত হয়েছে ষাট এবং সত্তরের দশকে। পরিচিত মহলে তিনি ছিলেন 'এনসাইক্লোপিডিয়া।' কারণ ইতিহাস, রাজনীতি ও সাহিত্যে গভীর জ্ঞান ছিল তাঁর। তিনি 'কেউটে' ছদ্মনামেও লিখতেন।

শৈশব

নিয়তি রায় বর্মন একেবারে শৈশবে মা জ্যোতিদেবীকে হারান।তাঁর দুই ভাই । পড়াশোনা আগরতলার নেতাজি সুভাষ বিদ্যানিকেতনে। নবম শ্রেণিতে বিদ্যালয় বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং নবম, দশম, একাদশ-তিন বৎসর বৃত্তি পান। পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ থেকে হায়ার সেকেন্ডারি ১৯৭১ সালে। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্মানিক স্নাতক। ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এড. ডিগ্রী লাভ। বিবাহ অঞ্জনভূষণ রায়বর্মনের সাথে ১৯৭৯ তে।

কর্ম জীবন

বিষয় শিক্ষিকা হিসাবে যোগদান ১৯৮৩ সালে অমরপুর হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে। এরপর সেকেরকোট হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল এবং মধুবন (ডুকলি) হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে। সহকারি প্রধান শিক্ষিকার পদে উন্নীত হয়ে প্রথমে লক্ষ্মীছড়া রামকৃষ্ণ হায়ার সেকেন্ডারি-তারপর মধুবন (কাঁঠালতলী) এইচ. এস স্কুল থেকে অবসর গ্রহণ ৩০ জুন ২০১৫-য়। শেষ তিনটি বিদ্যালয়ে হাতে লেখা দেওয়াল পত্রিকা যথাক্রমে 'উন্মেষ', 'কিশলয়' এবং 'অঙ্কুর' প্রকাশে উদ্যোগ নেন। এছাড়া বিদ্যালয়গুলিতে বার্ষিক প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন। ছাত্রছাত্রীদের মেধা-মনন, শিল্পকলা, সৌন্দর্যবোধ, সাহিত্য জ্ঞান সৃষ্টিতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতেন।

২০১০ সালে শিক্ষক দিবসে কৃতী শিক্ষিকা হিসাবে বিদ্যালয় পরিদর্শক, বিশালগড় কর্তৃক সম্মানিত হয়েছেন।আর বিদ্যালয় শিক্ষা দফতর কর্তৃক ২০১১ সালে পঞ্চাশতম শিক্ষক দিবসে সম্মানিত হন।

পরিবার

তাঁর স্বামী অঞ্জন রায়বর্মন।তিন সন্তানের জননী নিয়তি রায়বর্মনের লেখালেখি শুরু করেন পিতার অবর্তমানে তবে তাঁর অদৃশ্য অনুপ্রেরণা তো ছিলই। সহযোদ্ধারও এ বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল।তাঁদের এক পুত্র ও এক কন্যা।


লেখালেখির হাতেখড়ি

লেখালেখির প্রথম পাঠক তিনিই হতেন।স্বামীর মৃত্যু ২০০৯ সালে।এক সাক্ষৎকারে তিনি বলেন চলার পথে বিভিন্ন সময় বিভিন্নজন উৎসাহ যুগিয়েছেন তাই এগিয়ে যাওয়া। অদ্বৈত মল্লবর্মন জন্ম জয়ন্তী ২০০৮ সালে ছোটগল্প লিখে পুরষ্কৃত হন। 
লেখালেখি ও বই প্রকাশের ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ যোগাতেন পিতৃবন্ধু গবেষক রমাপ্রসাদ দত্ত। প্রথম প্রবন্ধ সংকলনের ভূমিকা তিনিই লিখে দিয়েছিলেন। তিনি গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, চিঠি, রিপোর্টাজ নিয়মিত লিখেন। আজকাল, ত্রিপুরা দর্পণ, দৈনিক সংবাদ, আরোহন (অধুনা-লুপ্ত), ডেইলি দেশের কথা, উত্তর ত্রিপুরা, মানবী, নানা সাহিত্যপত্র ও পূজা সংখ্যায় তাঁর লেখা দেখা যায়। বিভিন্ন পত্রিকা দফতরের প্রকাশকের দাবি এবং অনুরোধেও লিখে থাকেন। সাম্যবাদী ও মানবতাবাদী নিয়তী রায় বর্মনের চিন্তা ভাবনা মানুষকে কেন্দ্র করেই।
তিনি একাধারে কবি ছড়াকার প্রাবন্ধিক এবং লিটল ম্যাগাজিন 'সপ্তপর্ণা'র সম্পাদক। প্রকাশনা মঞ্চের সাথে যুক্ত হয়ে সপ্তপর্ণা পাবলিকেশনেও অসাধারণ কাজ করেন।


তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ

১। এক পশলা বৃষ্টি (গল্প সংকলন), জ্ঞান বিচিত্রা, ২০০৬
২। একান্ত আপন (কবিতা সংকলন), সকাল প্রকাশন, ২০০৬
৩। প্রবাহ (প্রবন্ধ সংকলন), সকাল প্রকাশন, ২০০৬
৪। বর্ণ পরিচয় ও সাধারণ পাঠ (প্রাক প্রাথমিকের), পৌণমী প্রকাশন,
২০০৭৫। কবিতায় সেঞ্চুরি (কবিতা সংকলন), পৌণমী প্রকাশন, ২০০৯
৬। প্রবাহ দ্বিতীয় খণ্ড (প্রবন্ধ সংকলন), সকাল প্রকাশন, ২০১০
৭। গল্প হলেও সত্যি (গল্প সংকলন), জ্ঞান বিচিত্রা, ২০১২
৮। সমসাময়িক প্রসঙ্গ: চিঠি পত্রে (পত্র সংগ্রহ, অক্ষর, ২০১৩)
৯। রবীন্দ্রনাথ (জীবনী গ্রন্থ), (পৌণমী প্রকাশন, ২০১৪)
১০। সুকান্ত (জীবনী গ্রন্থ), (পৌণমী প্রকাশন, ২০১৬)
১১। অর্ধেক আকাশের তারারা (জীবনী গ্রন্থ), জ্ঞানবীক্ষণ, ২০১৬
১২। শহীদ ক্ষুদিরাম (জীবনী গ্রন্থ), (পৌণমী প্রকাশন, ২০১৭)
১৩। ছড়ার আকাশ (ছড়া সংকলন), তপন পুস্তকালয়, ২০১৮
১৪। নির্বাচিত গদ্য (গদ্য সংকলন), স্রোত প্রকাশনা, ২০১৮
১৫। সময়ের দর্পণ (নির্বাচিত পত্র ও গদ্য), তপন পুস্তকালয়, ২০১৯
১৬। আলোর দিশারি ১ (জীবনী গ্রন্থ), জ্ঞানবীক্ষণ প্রকাশনী, ২০১৯
১৭। আলোর দিশারি ২ (জীবনী গ্রন্থ), জ্ঞানবীক্ষণ প্রকাশনী, ২০২১
১৮। ছড়ায় ছন্দে রূপে গন্ধে (ছড়া সংকলন), তুলসী পাবলিশিং হাউস, ২০২১
১৯। চিরন্তনী (একক কবিতা সংকলন, ২০২১, সপ্তপর্ণা প্রকাশনী)
২০। বিদ্যাসাগর (জীবনী গ্রন্থ) (স্রোত প্রকাশনা, ২০২২)
২১। মাস্টারদা সূর্য সেন (জীবনী গ্রন্থ), ২০২৩, স্রোত প্রকাশনা
২২। সান্ধ্য স্মৃতি (একক গল্প সংকলন), সপ্তপর্ণা প্রকাশনী, ২০২৩
২৩। রবীন্দ্র ভুবনের রাজপথ (প্রবন্ধসংকলন), ৭৭ সপ্তপর্ণা প্রকাশনী, ২০২৪
২৪। আলোর দিশারি ৩ (জীবনী গ্রন্থ), সপ্তপর্ণা প্রকাশনী, ২০২৪

সপ্তপর্ণা প্রকাশনী থেকে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ

১। নীল পাহাড় সোনালি চেউ (দ্বিতীয় সংস্করণ বর্ধিত আকারে, ২০১৭)
২। গুরুমা চারুবালা দত্তের ১৩০ তম জন্মবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ ২০১৭
৩। গুরুমা চারুবালা দত্তের কবিতা সংকলন নিবেদন (বর্ধিত আকারে) দ্বিতীয় সংস্করণ-২০১৮
৪। অসীমান্তিক কবি ও কবিতা (কবিতা সংকলন), সপ্তপর্ণা প্রকাশনী, ২০২১
৫। মর্ত্যের অপ্সরা (কবিতা সংকলন), ২০২২, সপ্তপর্ণা প্রকাশনী
৬। ঈশ্বরের নিকট পত্রালাপে নারী (পত্র সংকলন), ২০২৩, সপ্তপর্ণা প্রকাশনী
৭। প্রবচনমালা - লেখক: আশিস ভট্টাচার্য, ২০২৪
৮। SAFE DRIVE SAVE LIFE - লেখক: পলান সাহা, ২০২৫

সাহিত্য সাময়িকী 'সপ্তপর্ণা'

১। সপ্তপর্ণা বইমেলা সংখ্যা ২০১৭
২। সপ্তপর্ণা পূজা সংখ্যা ২০১৭
৩। সপ্তপর্ণা স্বর্ণকুমারী দেবী বিশেষ সংখ্যা ২০১৮
৪। সপ্তপর্ণা অনুরূপা মুখার্জি ও করবী দেববর্মন বিশেষ সংখ্যা ২০১৯
৫। সপ্তপর্ণা অষ্টাদশ উনবিংশ শতাব্দীতে সমাজ শিক্ষা ও সাহিত্যের আঙিনায় নারী ২০২১
৬। সপ্তপর্ণা ত্রিপুরার কৃতী নারী সংখ্যা প্রথম খণ্ড, ২০২২
৭। সপ্তপর্ণা ত্রিপুরার কৃতী নারী সংখ্যা দ্বিতীয় খণ্ড, ২০২৩
৮। সপ্তপর্ণা প্রভাবতী দেবী সরস্বতী সংখ্যা, ২০২৪


শেষকথা 

তিনি সত্যি সত্যি একজন মমতাময়ী মাতৃসমা। তাঁকে দিদি হিসেবে সম্বোধন করি।কিন্তু স্রোত প্রকাশনা থেকে সুষমারানী ধর স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করে মায়ের আসনেই বসিয়েছি।যখন তাঁর সহযোগিতা যেভাবে চেয়েছি তিনি সহযোগিতার দরাজ হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁকে সত্যি সত্যি শেল্টার হাউস মনে করি আমি।

১৮:০৪:২০২৫

0 Comments