কবিপথিক গোবিন্দ ধর: দৃষ্টি যাঁর সামনে
তপন বাগচী

কবি গোবিন্দ ধরের সঙ্গে আমার চাক্ষুষ পরিচয় হয়নি। অথচ ভৌগেলিক দূরত্ব কতই-বা! এই গোবিন্দ ধর-ই যে চৈতন্য ফকির, তা-ও জানা হয় দূরত্ব রেখেই।  যে চৈতন্য ফকির চায়ের কাপে নিজেকে ঢেলে নিজেকে খেতে পারেন, তিনি তো কবি ছাড়া আর কিছু হতে পারেন না। কবি বলেই তিনি চা পানের পর ছুটে যেত পারেন সন্তানের নিকট, বিছানার নিকট, কোন এক প্রকৃতির নিকট।
ত্রিপুরার বাসিন্দা কবি গোবিন্দ ধর একদা কল্লোলিনী তিতাস একটি নদীর নামের পজন্মপ্রতিবেশী। ‘আমার কোনো নদী’ বলে ঘোষণা দিলেও কবি নিজেকে নদীনির্ভর মনে করেন আর জুরীর বুকে সাঁতার শেখার স্মৃতিরোমন্থন করে মনুর উত্তাল স্রোতের কাছে হার-না মানা কবি হয়ে ওঠেন। তিতাসের ডাক কবি শুনতে পান, ইলিশের লাফ অনুভব করেন বুকের ভেতর। তিতাসপাড়ের কবি জয়দুল হোসেন কিংবা সাংবাদিক হয়ে ওঠেন তাঁর আত্মার মানুষ। কী গৌরবের সঙ্গে তিনি উচ্চারণ করতে পারেন ‘নদী নির্ভর এই আমি শঙ্খলাগা দেও’।
গোবিন্দ ধরের কবিতায় বাংলার চিরায়ত প্রকৃতি যেমন উঠে আসে, তেমনি ধরা পড়ে ভূগোলের জটিল ব্যাকরণ। চমৎকার একাত্ম হয়ে তিনি বলতে পারেন—
‘আপনার আহ্নিকগতি আমাকে শেখায় সূর্যোদয়।
আপনার বার্ষিকগতি আমাকে শেখায় নতুন বছরের গল্প।

আমি সেদিন একটু হেলে ছিলাম জ্যোৎস্নার কার্নিভালে
যেখান থেকে পৃথিবীর জোয়ারভাটা হয়।’
এভাবে কবি ছাড়িয়ে যান নিজের ভূগোল, হয়ে ওঠেন বিশ্বপরিমণ্ডলের গর্বিত সদস্য। এই ধারায় অগ্রসর হয়ে কবি ভারত-বাংলাদেশের কঁটাতার ভেদ করে চলে যান বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের স্মৃতিমগ্ন জমিনে। তাঁর কবিতায় এপার-ওপার ভেদরেখা মুছে যায়, যখন বলেন--
‘কিছু স্বপ্ন আমার বাবা ওপারে রেখে গেছেন।
বাবার বাবাও কিছু স্বপ্ন ওপারে দেখতেন।
তাঁর বাবাও কিছু স্বপ্ন বুনতেন ওপারেই।
৫২র ভাষা আন্দোলনের আগে বাবার বাবা
আমাদের সকল স্বপ্নকে পাঁজাকোলা করে
এপারে নিয়ে আসেন।
তখনও কাঁটাতার দুই দেশের সীমানায় বসেনি।
বাবা চাতলা বর্ডার ক্রস করে
তাঁর প্রেমিকাকে ফুল দিতে পারতেন’
এভাবেই এই কবির কণ্ঠে ফুটে ওঠে আক্ষেপের বেদনা।কবি তো সকল বেদনাকে ধারণ করতে পারেন। বেদনার ভেতর থেকেই জন্ম দিতে পারেন আনন্দের ফুল।
গোবিন্দ ধর বাংলা কবিতায় তিরিশোত্তর আধুনিক ধারার সাম্প্রতিক প্রতিনিধি। চল্লিশের সুভাষ  মুখোপাধ্যায়, আহসান হাবীব, কিংবা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; পঞ্চাশের শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা বিনয় মজুমদার, ষাটের উত্তম দাশ, মঞ্জুষ দাশগুপ্ত, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, অসীম সাহা; সত্তরের সুবোধ সরকার, জয় গোস্বামী, আবিদ আনোয়ার, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ প্রমুখেরই বাহিত কবিসত্তা। কবিতাকে তিনি ছন্দের নিগড় থেকে মুক্তি দিয়েছেন। প্রকরণ নিয়ে তিনি বিস্তর ভাবনার চেয়ে তিনি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কাব্যচরণ সৃষ্টি করেছেন। এর ভেতর দিয়েই তিনি খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন নতুন স্বর। বাংলা কবিতা তাঁকে কতটুকু গ্রহণ করবে, সে বিচারের ভার সময়ের উপরেই ছেড়ে দিতে পারি। তিনি কবিতার পথেই আছেন, কবিতার পথকেই প্রশস্ত করে চলছেন, আপতত এই কবিপথিককে আমরা গ্রহণ করতে পারি বাংলাভাষার বিশাল প্রেক্ষাপটেই। সেইটুকুই বা কম কী! কবি যখন বলেন--
‘নিজেকে খুচরো করাই সব নয়
আরো এক অন্তর্গত ক্রোধ রাখি
পায়ের পেশির মতন ঝুলে রাখি
গোপন মানচিত্রে কিছু অসুখ রাখি
তবুও অপেক্ষায় দরজা তবু খোলা।’
--তখন আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে কবি অনেকটা প্রস্তুতি নিয়েই পথে নেমেছেন। আর পথই এনে দেবে পথের ঠিকানা। আমরা জানি যে পথের পাশেই থেকে যায় নিরিবিল বটের ছায়া। সেখানেই হতে পারে কবিতার বিশ্রাম! কিন্তু খানিক বিশ্রাম নিয়ে কবি আবার উঠে দাঁড়ান নৃপেন চক্রবর্ীর নির্দেশ মান্য করে। মোহর মুক্তমঞ্চ কিংবা বইমেলার মাঠ কবিকে ডাকছেন। একজন নৃপেন চক্রবর্তী এভাবেই গোবিন্দ ধরের কবিতায় নতুন ‘মিথ’ হয়ে ধরা পড়ে। আমরা আগ্রহী হয়ে উঠি একজন নৃপেন চক্রবর্তীর খোঁজ নিতে। একজন কবির জন্য এটিও কম গৌরবের নয়। যেহেতু গোবিন্দ ধর সামনে তাকাতে জানেন, তার আর পেছন ফেরার দরকার পড়বে না।
গোবিন্দ ধর কবি। গোবিন্দ ধর কর্মী। গোবিন্দ ধর সাহিত্যসেবী। কবিতা তাঁকে ফেরাবে না। সাহিত্য তাঁকে ফেরাতে পারে না।

--
ড. তপন বাগচী:: কবি-প্রাবন্ধিক। উপপরিচালক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা

0 Comments